সুরা কাসাসের অধিকাংশ স্থানে ফেরাউনের সাথে মুসা আলাইহিস সালামের যে ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল, তার আলোচনা করা হয়েছে। হরফে মুকাত্তায়াত-ত-সীন-মীম দ্বারা সুরাটি শুরু হয়েছে। এরপরই কুরআনের সত্যতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এরপর মুসা আলাইহিস সালামের ঘটনা শুরু হয়েছে।
সুরা কাসাসের মাধ্যমে জানা যায়, মিসরের ফেরাউন অত্যন্ত দুরাচার ছিল। অহংকার, জুলুম ও নিষ্ঠুরতার ক্ষেত্রে সে সীমালঙ্ঘন করেছিল। জনগণ যাতে তার ক্ষমতার জন্য কাল হয়ে না দাঁড়ায় এজন্য সে বর্তমানকালের সাম্রাজ্যবাদী নীতিতে মিসরবাসীকে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত করে রেখেছিল।
মিসরের সংখ্যালঘু বনি ইসরাইলকে সে জুলুম-নির্যাতনের বিশেষ টার্গেট বানিয়ে রেখেছিল। একসময় আল্লাহ তায়ালা দুর্বলদের দাঁড় করানোর এবং শক্তিশালী দলকে লাঞ্ছিত করার ইচ্ছা করেন। তখন মুসা আলাইহিস সালামের জন্ম হয়। তার মা অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি জানতেন ফেরাউনের বাহিনী যদি এ নবজাত শিশুর সন্ধান পেয়ে যায় তা হলে তাকে বাচিয়ে রাখবে না। তখন আল্লাহ তায়ালা তার অন্তরে ইলহাম করেন। সেই অনুযায়ী তিনি একটি সিন্দুক তৈরি করেন। প্রিয় কলিজার টুকরা সন্তানকে সিন্দুকে রেখে তা নীলনদে ভাসিয়ে দেন। পানির ঢেউয়ে দুলতে দুলতে সিন্দুকটি ফেরাউনের সেবিকাদের হাতে পড়ে। সেবিকারা সন্তানটি হজরত আসিয়ার (ফেরাউনের স্ত্রী) কোলে এনে দেয়।
ফেরাউন নিষ্পাপ শিশুটিকে হত্যা করতে উদ্যত হয়; কিন্তু আল্লাহর ফয়সালা ছিল ভিন্ন রকম। তিনি যে ফয়সালা করেন তা-ই বাস্তবায়িত হয়। মানুষের চেষ্টা- প্রচেষ্টা, তাদের প্লান-পরিকল্পনা সব ব্যর্থ হয়ে যায়। আসিয়া ফেরাউনকে কিছু কথা বলে। যার ফলে ফেরাউনের পাষাণ দিল নরম হয়ে যায়।
ঐদিকে সন্তান-শোকে মুসা আলাইহিস সালামের মা অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি একদম শাস্তি পাচ্ছিলেন না। তার মনে হচ্ছিল সিন্দুকটি ফেরাউনের বাহিনীর হাতে পড়েছে আর তারা তাকে হত্যা করে ফেলেছে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তার বিচলিত অস্তরে স্থিরতা ও প্রশান্তি দান করেন। তাকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, সন্তানকে অবশ্যই তোমার কোলে ফিরিয়ে দেব। এই মুজিজা কীভাবে বাস্তবায়িত হবে? এ অসম্ভব বিষয় কীভাবে সম্ভব হবে? এটা চিন্তাভাবনা করা তোমার কাজ নয়, এটা আমার কাজ।
ক্ষুধার্ত শিশুকে কয়েকজন ধাত্রী দুধ পান করানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তিনি কারো দুধ গ্রহণেই রাজি হচ্ছিলেন না। এ-দিকে মুসা আলাইহিস সালামের বোন দূর থেকে এসব দৃশ্য দেখছিল। তারা তার পরিচয় জানত না। তিনি (বোন) একটি পরামর্শ দেন। তার পরামর্শের ভিত্তিতে এক মহিলাকে (সন্তানের মাকে) ডেকে আনা হয়। একজন ধাত্রী হিসেবেই তার কোলে বাচ্চা সোপর্দ করা হয়।
ফেরাউনের সিদ্ধান্ত ছিল কোনো ইসরাইলি নবজাত সন্তান যেন তার মায়ের দুধ পান না করতে পারে। তার পূর্বেই যেন তাকে হত্যা করা হয়। কিন্তু আল্লাহর সিদ্ধান্ত ছিল তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে বড় জালেমের জন্য যে শিশু বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে, সে তারই নিকট লালিত-পালিত হবে। সেখানেই বড় হবে। তেমনটাই হয়েছিল। মিথ্যা প্রভুত্বের দাবিদার ফেরাউনের পরিকল্পনা পণ্ড হয়ে গিয়েছিল।
মুসা আলাইহিস সালাম যখন যৌবনে পদার্পন করেন তখন তার হাতে এক কিবতি’ নিহত হয়। এক বিশ্বস্ত লোকের পরামর্শে তিনি মিসর থেকে বেরিয়ে মাদইয়ানের পথ ধরেন। তিনি পথঘাট কিছুই চিনতেন না। সাথে থাকা-খাওয়ার কিছুই ছিল না। আল্লাহর নিকট তিনি দোয়া করেন, ‘হে আল্লাহ, আমি আপনার দয়ার মুখাপেক্ষী।”
একজন মানুষের যেসব জিনিসের প্রয়োজন হয়ে থাকে তখন তার সেব জিনিসের ব্যবস্থা হয়ে যায়। মানুষ যেমন রোদ্র-তাপের মুখাপেক্ষা তেমনিভাবে সে ছায়ারও মুখাপেক্ষী। তার যেমন জাগ্রত থাকা প্রয়োজন তেমনি ঘুমেরও প্রয়োজন।
তিনি একটি গাছের ছায়ায় বসে ছিলেন। তখন দুজন লজ্জাবতী পর্দানশিন মেয়ে বকরি হাঁকিয়ে নিয়ে আসে। তিনি অনুগ্রহ করে কূপ থেকে পানি উঠিয়ে তাদের বকরিকে পান করান।
মেয়েরা বেশ বুদ্ধিমতী ছিল। তারা তাদের পিতা হজরত শোয়াইব আলাইহিস সালামের নিকট অপরিচিত মুসাফিরের শক্তি-সামর্থ্য, আমানতদারি ও তার খোদাভীরুতার প্রশংসা করে। তখন তিনি এক মেয়ের মাধ্যমে তাকে ডেকে পাঠান। এর ফলে শুধু তার শান্তি-সুখের আবাসেরই ব্যবস্থা হয়নি; বরং কিছু শর্তসাপেক্ষে তার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ারও ব্যবস্থা হয়ে যায়।
বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে তিনি মিসর যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে জঙ্গলে তিনি আগুন জ্বলতে দেখলেন। আগুন আনার জন্য গেলে তাকে নবুওয়াত দেওয়া হয়। নবুওয়াত প্রদানকারী আল্লাহ তায়ালা তাকে লাঠি ও উজ্জ্বল হাত মুজিজা হিসেবে প্রদান করেন। তিনি তাকে নির্দেশ দেন, যে জালেম মানুষের জীবন সংকীর্ণ করে দিয়েছে, যে নিজেকে ছাড়া কাউকে বড় বলে জানে না, তার সামনে হকের কালিমা উচ্চারণ করবে। ফেরাউন মানার মতো ব্যক্তি ছিল না। সে মুসা আলাইহিস সালামের দাওয়াত গ্রহণ করেনি। আল্লাহ তায়ালা তাকে লোক-লশকরসহ নীলনদের ঢেউয়ের হাওয়ালা করে দেন।
এই ঘটনায় উল্লেখযোগ্য তিন ব্যক্তি রয়েছেন। হজরত মুসা আলাইহিস সালাম, বনি ইসরাইল ও ফেরাউন। আলোচ্য সুরায় ঘটনার কিয়দংশ উল্লেখ হয়েছে। পুরো ঘটনাটি গোটা কোরআনের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ রয়েছে। এখানে তার সারসংক্ষেপ উল্লেখ করা হল:
১. বিপদে-আপদে ধৈর্য ধারণ করলে দুনিয়া ও আখেরাতে তার উত্তম প্রতিদান পাওয়া যায়।
২. যে-ব্যক্তি সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর উপর ভরসা রাখে, আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই তার বিপদ দূর করে দেন।
৩. আল্লাহর সাথে যার প্রীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠে, বাতিল যতই শক্তিশালী হোক না কেন, তার কাছে তা অতি তুচ্ছ মনে হয়।
৪. যদি কোনো ব্যক্তি হকের পয়গাম নিয়ে দৃঢ়তার সাথে দাঁড়ায় তা হলে শত্রুদের মধ্য থেকেই তার সহযোগী তৈরি করে দেওয়া হয়।
৫. যার অন্তরে ঈমান গভীরভাবে স্থান লাভ করে, সে ঈমানের জন্য টাকা-পয়সা, অর্থকড়ি সব বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত হয়ে যায়।
৬. গোলামির সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর দিক হচ্ছে, এতে মানুষের দৃঢ় সংকল্প ও ইচ্ছাশক্তি হারিয়ে যায় (এ কারণে বনি ইসরাইল পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল)।
৭. পৃথিবীতে ক্ষমতার উত্তরাধিকার তাদের জন্যই, যারা লড়াই ও সংগ্রামের ময়দানে দৃঢ়পদ থাকে।
৮. বাতিল যতই শক্তিশালী হোক, পরিশেষে সে ব্যর্থতার মুখই দেখতে পায়।
৯. আল্লাহর রীতি হচ্ছে, যাদেরকে মানুষ হীন মনে করে একদিন আল্লাহ তাদেরকে জমিনে কর্তৃত্বশালী বানান।
১০. যে-ব্যক্তি বা দল ইচ্ছাকৃতভাবে হক গ্রহণে অবাধ্যতা করবে, আল্লাহ তার থেকে সত্য গ্রহণের মানসিকতা ছিনিয়ে নেন। ফেরাউন ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের বেলায় এমনটিই ঘটেছিল।
১১. হকের অনুসরণ করলে পার্থিকভাবেও সফলতা অর্জিত হবে। সফলতা অর্জিত না হলে তার অনুসরণ করা যাবে না—এরূপ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। বনি ইসরাইল এমনটাই করেছিল।
১২. একটা বড় গোমরাহি হচ্ছে মানুষ হক অনুসরণ করার পরিবর্তে হককেই নিজের প্রবৃত্তির গোলাম বানিয়ে ফেলে। শনিবার দিন তাদেরকে মাছ শিকার করতে নিষেধ করা সত্ত্বেও বনি ইসরাইল হিলা-বাহানা করেছিল।
১৩. কেউ সত্য কবুল করুক বা না করুক দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যাওয়া আবশ্যক। কিছু হকপন্থি শনিবার দিনের অসম্মান করা থেকে লোকদের নিষেধ করতেন।
১৪. মানুষের খারাপ কাজের শাস্তিস্বরূপ তাদের উপর জালেম শাসককে চাপিয়ে দেওয়া হয়।
১৫. নিজ সম্প্রদায়কে গোলামির জীবন থেকে মুক্তি দেওয়া নবীদের সুন্নাত।