হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের ঘটনা ও শিক্ষা

ইয়াকুব আলাইহিস সালামের বারো ছেলে ছিল। হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম তাদের মধ্যে অস্বাভাবিক সুন্দর ছিলেন। তার চেহারা ও চরিত্র —দুটোই সুন্দর ছিল। তিনি ও তার ভাই বিনয়ামিনের সবার ছোট হওয়াও এই ভালোবাসার একটি কারণ ছিল। আর তাদের মায়েরও ততদিনে মৃত্যু হয়ে গিয়েছিল।
ছোট বাচ্চার প্রতি ভালোবাসা মানুষের স্বভাবগত বিষয়। হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহুর মেয়েকে জিজ্ঞাসা করা হয় আপনার নিকট আপনার কোন সন্তান সবচেয়ে বেশি প্রিয়? তিনি উত্তরে বলেন, ছোট সন্তান, যতক্ষণ না সে বড় হয়। অনুপস্থিত সস্থান, যতক্ষণ না সে উপস্থিত হয়। অসুস্থ সন্তান, যতক্ষণ না সে সুস্থ হয়।
এ ভালোবাসার কারণে ভাইয়েরা তার সাথে হিংসা করা শুরু করে। তারা তাদের পিতাকে খেলাধুলার কথা বলে হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালামকে জঙ্গলে নিয়ে যায়। তারপর তাকে কূপে ফেলে দেয়।
কূপের পাশ দিয়ে একটি কাফেলা যাচ্ছিল। পানি নেওয়ার জন্য তারা কূপে বালতি ফেলে। ভেতর থেকে ইউসুফ আলাইহিস সালাম বের হয়ে আসেন। কাফেলার লোকেরা মিসরে নিয়ে তাকে বিক্রি করে দেয়।
মিসরের জনৈক মন্ত্রী তাকে ক্রয় করে বাড়িতে নিয়ে যান। ইউসুফ আলাইহিস সালাম যৌবনে পদার্পণ করলে বাদশাহর স্ত্রী তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। সে মন্দ কাজের জন্য তাকে ফুসলানোর চেষ্টা করে। হজরত ইউসুফ তার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন। মন্ত্রী দুর্নাম থেকে বাঁচার জন্য ইউসুফ আলাইহিস সালামকে জেলে বন্দি করেন।
জেলখানায় তিনি তাওহিদের দাওয়াত দিতে থাকেন, যার কারণে বন্দিরা তাকে অনেক সম্মান করত। তৎকালীন বাদশাহর স্বপ্নের সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়ায় তিনি তার নজরে পড়েন। বাদশাহ তাকে খাদ্যভাণ্ডার, ব্যবসা-বাণিজ্যের দায়িত্বশীল এবং রাষ্ট্রের উজির মনোনীত করেন। মিসর এবং তার আশপাশে দুর্ভিক্ষের কারণে তার ভাইয়েরা রেশন নেওয়ার জন্য মিসর আসে। দুয়েকবার সাক্ষাতের পর তিনি তাদের বলেন, আমি তোমাদের ভাই ইউসুফ। এরপর তার মাতাপিতাও মিসর চলে আসেন। সকলেই এখানে বসতি গড়ে তোলেন।
ইউসুফ আলাইহিস সালামের ঘটনা সংক্ষেপে বর্ণনা করা হল। ঘটনা থেকে যেস শিক্ষা ও উপদেশ পাওয়া যায় আমরা সামনে তা উল্লেখ করব।

কখনো মুসিবতের সুরতে নেয়ামত আসে
১. কখনো কখনো মুসিবতের সুরতে নেয়ামত ও শান্তি আসে। ইউসুফ আলাইহিস সালামকে প্রথমে এক দীর্ঘ বিপদ-সঙ্কটের মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে হয়েছে। তাকে কূপে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। সাথে কোনো সাহায্যকারী ছিল না। মিসরের গোলামদের সাথে তাকে বিক্রির জন্য ওঠানো হয়েছিল। তাকে নারীদের ফেতনা মোকাবেলা করতে হয়েছিল। অনেক বছর বন্দিজীবন কাটাতে হয়েছিল। পরিশেষে তিনি মিসরের বাদশাহ বনে যান। দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মানিত জীবন লাভ করেন।

হিংসা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর রোগ
২. হিংসা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর রোগ। আপন ভাইদের মধ্যে তা সৃষ্টি হলে দুঃখজনক ঘটনার অবতারণা হতে পারে।

উন্নত চরিত্র, উত্তম গুণাবলি ও সঠিক লালনপালনের ফল
৩. সর্বাবস্থায়ই উন্নত চরিত্র, উত্তম গুণাবলি, সঠিক লালনপালনের ফল ভালো হয়ে থাকে। হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের লালনপালন হয়েছিল এক মহান পিতার হাতে, নবীবংশে। উত্তরাধিকারসূত্রে বাপ-দাদার থেকে তিনি মহৎ গুণাবলি লাভ করেছিলেন। উন্নত চরিত্র ও তরবিয়তের কারণেই বহু বিপদ- মুসিবতের সামনেও তিনি অবিচল ছিলেন, যার কারণে কষ্টের পর শান্তি এবং বাহ্য অপদস্থতার পর প্রকৃত সম্মানিত জীবন লাভ করেছেন।

সচ্চরিত্র, বিশ্বস্ততা ও দৃঢ়তা সবার জন্যই কল্যাণের উৎস
৪. নিষ্কলুষতা, আমানত ও ইসতিকামাত নারী-পুরুষ নির্বিশেষ সবার জন্যই সকল কল্যাণের উৎস। দীনের উপর আমল করলে একদিন না একদিন অবশ্যই সম্মানিত জীবন অর্জিত হবে। সত্য যতই লুকিয়ে রাখা হোক, একদিন তা প্রকাশ পাবেই।

বেগানা নারী-পুরুষের নির্জনে অবস্থান ফেতনার কারণ
৫. বেগানা নারী-পুরুষের পরস্পর মেশামেশি ও নির্জনে অবস্থান এক কারণ। এই কারণে ইসলাম পরস্পর মাহরাম নয় এমন মানুষদের নির্জনে অবস্থান হারাম ঘোষণা করেছে। তিরমিজি ও নাসায়ির হাদিসে আছে, নারী-পুরুষ যখন নির্জন জায়গায় একত্র হয় তখন তাদের সাথে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে শয়তান উপস্থিত থাকে।

ঈমান বিপদে সহনশীলতা ও গুনাহমুক্ত থাকা সহজ করে
৬. আল্লাহ তায়ালার উপর ঈমান আনয়ন ও দৃঢ় আকিদার মাধ্যমে বিপদ-আপদ সহ্য করা ও গুনাহ থেকে চরিত্র বাঁচিয়ে রাখা সহজ হয়ে যায়।

কষ্টের সময় আল্লাহ তায়ালার দিকে প্রত্যাবর্তন করা
৭. মুমিনের জন্য উচিত হচ্ছে, সকল কষ্ট মুসিবত ও পেরেশানির সময় আল্লাহ তায়ালার দিকে প্রত্যাবর্তন করা। মিসরের বাদশাহর স্ত্রী মন্দ কাজ না করায় ইউসুফ আলাইহিস সালামকে যখন জেলের হুমকি দিয়েছিল তখন তিনি গুনাহের পরিবর্তে বিপদকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। রবকে ডেকে বলেছিলেন, হে আমার রব, তারা আমাকে যে কাজের প্রতি আহ্বান করছে তার তুলনায় জেলই আমার নিকট উত্তম।
কিছু আল্লাহওয়ালার ব্যাপারে বর্ণিত আছে, অসুখ-বিসুখ ও বিপদ-আপদে আক্রান্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে যখন তাদের সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে তখন তারা বলেছেন, আল্লাহর প্রশংসা করছি, গুনাহে লিপ্ত হইনি, বিপদে আপতিত হয়েছি।

প্রকৃত দায়ী কষ্টের সময়ও দাওয়াত থেকে উদাসীন হয় না
৮. প্রকৃত দায়ী অনেক কষ্ট-মুসিবতের মধ্যেও দাওয়াতের দায়িত্ব থেকে উদাসীন হয় না। ইউসুফ আলাইহিস সালাম কারাগারে থেকেও দাওয়াত তাবলিগ ও ইরশাদের কোনো সুযোগ হাতছাড়া করেননি। যে-ব্যক্তি তার নিকট স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছিল তাকেও তিনি তাওহিদের দাওয়াত দিয়েছেন। এরপর স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলেছেন। বলা হয়, কারাগারের বন্দিরা তার দাওয়াতের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে ঈমান এনেছিল। স্বয়ং মিসরের বাদশাহ ও ইসলাম কবুল করেছিল।

চারিত্রিক পবিত্রতার প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ রাখা উচিত
৯. সাধারণত সকল মুসলমানের আর বিশেষভাবে প্রত্যেক দায়ি এবং অনুসৃত ব্যক্তির চারিত্রিক পবিত্রতার প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ রাখা উচিত। কয়েক বছর কারাগারে থাকার পর যখন ইউসুফ আলাইহিস সালামের মুক্তির ঘোষণা দেওয়া হয়, তখন সাথে সাথেই তিনি বের হয়ে যাননি; বরং যতক্ষণ পর্যন্ত তার চারিত্রিক পবিত্রতা ও নির্দোষিতার ঘোষণা ও স্বীকারোক্তি দেওয়া সানি ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি কারাগার থেকে বের হতে রাজি হননি। তিনি এমন করেছিলেন, যাতে কেউ এই অপবাদ না লাগাতে পারে যে, তিনি প্রকৃত অপরাধীই ছিলেন। অনুগ্রহবশত তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে!

ধৈর্যধারণের ফজিলত
১০. এ ঘটনা থেকে ধৈর্যধারণের ফজিলত এবং তার উত্তম ফলপ্রাপ্তির ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে। হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম কূপের অন্ধকার থেকে নিয়ে জেলখানার একাকিত্ব পর্যন্ত এবং মিসরের বাদশাহর ঘর থেকে নিজে ভাইদের মাফ করে দেওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। এর দ্বারা তিনি যে ফল লাভ করেছেন, তা কারও কাছেই গোপন নয়। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ধৈর্য হচ্ছে শান্তি ও নেয়ামতের দরজার চাবিকাঠি। ঈমানের অর্ধেক। আল্লাহর সাহায্য লাভের অন্যতম প্রধান মাধ্যম।

মাওলানা মুহাম্মদ আসলাম শেখোপুরি রাহ. রচিত খোলাসাতুল কুরআন অবলম্বনে রচিত।

Leave a Comment