রাশিয়া যেভাবে তেল ও গ্যাসের দ্বারা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে

রাশিয়া বিশ্বের প্রধান জ্বালানি শক্তিগুলোর মধ্যে একটি। তাদের প্রচুর তেল ও গ্যাস সম্পদ আছে যা উত্তোলন করে সারা বিশ্বের ফ্যাকটরি, গ্যাস ট্যাংক ও পাওয়ার স্টেশনে সরবরাহ করা হয়। বিশাল জ্বালানি সরবরাহ পুতিনের হাতে এক মারাত্মক ক্ষমতাশালী অস্ত্র তুলে দিয়েছে, যা ব্যবহার করে শত্রুকে শায়েস্তা করতে, বন্ধুদের পুরষ্কৃত করতে এবং বিশ্বের ব্যবসা ও রাজনীতিতে প্রভাব খাটাতে সে দ্বিধা করে না। নানাভাবে জ্বালানিশক্তি সংগ্রহের জন্য ইউরোপের বর্তমান ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা আছে। প্রাকৃতিক গ্যাস কেনার স্পট মার্কেট দিনদিন বড় হচ্ছে। তবুও অন্তত বর্তমানে পুরো মহাদেশ রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। পুতিন মূহুর্তের নোটিশে পুরো উপমহাদেশের অর্থনীতিকে লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারে। জার্মান ফ্যাকটরি, ডাচ বন্দর বন্ধ হয়ে যাবে; ইতালির গ্যাস স্টেশনে বিদ্যুতের অভাবে অন্ধকার নেমে আসবে। তীব্র শীতে পুতিন গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিলে – যে গ্যাস দিয়ে ইউরোপ শীতে নিজেদের উষ্ণ রাখে – অবস্থা কত শোচনীয় হবে তা কল্পনা করলে সবচেয়ে বড় পুতিনবিরোধী সুইড, ডেন বা এস্তোনিয়ানদেরও শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের শীতল স্পর্শ নেমে যাবে।

জ্বালানি বাজার নিয়ে পুতিনের কারসাজিতে শুধু ইউরোপ ভুগবে তা নয়। পুরো বিশ্বের অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়বে যদি পুতিন ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ মাত্র কয়েকদিন বন্ধ রাখে। আরও বাজে ব্যাপার হচ্ছে, চীনাদের সাথে পুতিনের ৪০০ বিলিয়ন ডলারের গ্যাসচুক্তি আছে। এ চুক্তির পূর্ণ প্রভাব কেমন হবে তা বুঝতে অনেক সময় লাগবে। কিন্তু এটি ছিল পুতিন ও তার জ্বালানিকৌশলের জন্য মস্তবড় বিজয়। এরপর তার তালিকায় আছে জাপান ও ভারত।

ইউরোপের জ্বালানিশক্তি ও বৈশ্বিক বাজারের প্রতি পুতিনের নিয়ন্ত্রণকে পুতিন প্রায়ই কাজে লাগায় এবং অন্যান্য দেশকে হুমকি দিয়ে বশ্যতা শিকার করতে বাধ্য করে। যেমনটি সে করেছিল ইউক্রেনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে। রাশিয়ার আগ্রাসনে সামরিকভাবে বাধা দিলে বা কঠোর স্যাংশন আরোপ করলে সে ইউরোপজুড়ে রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহের পাইপলাইন বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেয়। ইউরোপীয় ব্যবসায়ী বা রাজনীতিবিদদের রাশিয়ার তেল বা গ্যাস বন্ধ হওয়ার কথা কল্পনা করলেও গলা শুকিয়ে যায়। ফলে তারা পুতিনের সাথে মিটমাট করে তাকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করে।

কিন্তু পুতিন সর্বদা আরও ক্ষমতা, আরও নিয়ন্ত্রণ চায়। এ জন্য সে বিশ্বের জ্বালানি সরবরাহের ওপর আরো দখলদারিত্ব নেয়ার জন্য কঠিন ও আগ্রাসী সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। বন্ধুত্বপূর্ণ, জ্বালানিপূর্ণ দেশের সাথে সে মিত্রতা সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে সামরিক ও কূটনৈতিক বাহিনীর সাথে শত্রুতা বজায় রাখছে। পুতিন ইতিমধ্যেই ইরানের সাথে একটি জ্বালানিবিষয়ক চুক্তি করার কাজ করছে। প্রেসিডেন্ট ওবামার পরমাণু চুক্তির নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর থেকে তিনি এ কাজটি করার চেষ্টা করছেন। তা ছাড়া, ইরাক ও সিরিয়ায় শিয়ানিয়ন্ত্রিত শাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে রাশিয়া ও ইরান তেল রপ্তানিকারক সৌদি আরবকে ঘেরাও করেছে। রিয়াদের কাছে রাশিয়া কোনো লুকোছাপা না করে তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট করে দিয়েছে। পুতিন আর্কটিকের বিশাল জ্বালানিশক্তির রিজার্ভের আদায়ের দাবিতেও এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনি  সেনা ও জাহাজ মোতায়েন করছেন। ফলে রাশিয়ার সাথে আর্কটিকের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে, বিবাদ বাধছে। রাশিয়ান পাইপলাইনে চীনকে তেল ও গ্যাস সরবরাহ করার দ্বারা ক্রেমলিনের কোষাগার ভরতি করেছেন পুতিন। সে বিবেচনায় মধ্য এশিয়ায় পুতিন সবচেয়ে সফল।

জ্বালানিশক্তির পেছনে পুতিনের দৌড়কে বন্ধ করা, এমনকি ধীরগতির করাও আমেরিকা ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের জন্য চ্যালেঞ্জিং কাজ হবে। সাম্প্রতিককালে কিছু সাহসী পদক্ষেপ দেখেছি আমরা। যেমন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের থার্ড এনার্জি প্যাকেজ এবং সাউথ স্ট্রিমের মতো চুক্তি থামিয়ে দিতে আমেরিকার প্রচেষ্টা। কিন্তু এরপরও আমাদের কৌশল অপর্যাপ্ত, এটা স্বীকার করতেই হবে। দিনদিন পুতিন তেল ও গ্যাসের বৈশ্বিক সরবরাহে রাশিয়ার বাজারকে বড় করছে, বিশ্বের জ্বালানি বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্যের দৌড়ে অনেকটাই নিকটবর্তী সে।

 

রাশিয়ার রিজার্ভ, ইউরোপের নির্ভরতা

পেট্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানিগুলো বিশ্বের জ্বালানি সরবরাহের ৮০ শতাংশ দখল করে আছে। সারা বিশ্বে জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনের দিক দিয়ে রাশিয়া বিশ্বে দ্বিতীয়, সৌদি আরবের ঠিক পেছনে। কয়েক বছর ধরে, পশ্চিমা সমালোচকরা ভবিষ্যদ্বাণী করে আসছেন যে রাশিয়ার জ্বালানিশক্তির মজুদ কমে যাচ্ছে। গত দশক ধরে আমরা প্রায়ই শুনে আসছি, রাশিয়ার তেলের মজুদ প্রায় শেষের দিকে। বিশ্বের নেতৃস্থানীয় তেল উৎপাদনকারী ও সরবরাহকারীর স্থান থেকে খুব শীঘ্রই তাদের পতন ঘটবে। কিন্তু দেখা গেছে, আশা উদ্রেককারী এ পূর্বাভাসগুলি তেল-গ্যাস উভয়টির ক্ষেত্রেই ভুল ছিল। উভয় ক্ষেত্রেই রাশিয়া শীর্ষস্থানীয় স্থান ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর। তারা তাদের এ শক্তিকে প্রতিবেশীদের আতংকে রাখতে ও তাদের নিজ স্বার্থে লাগাতে ব্যবহার করবে।

পুতিন অত্যন্ত কার্যকরভাবে রাশিয়ার জ্বালানি রিজার্ভকে অস্ত্রে পরিণত করেছেন, একে বানিয়েছেন বৈশ্বিক নীতি নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার। এটা ব্যবহার করে বাজার-চুক্তি জয় করছেন, দেশে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রেখেছেন। মস্কো তার জ্বালানিখাতের কারণে ব্যাপক সামর্থ্য লাভ করেছে। রাশিয়ার আছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশী প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ, দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লার মজুদ যা দিয়ে ৪৫৫ বছর সরবরাহ অব্যাহত রাখা যাবে। এ ছাড়া বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহৎ বৈশ্বিক মজুদ তাদেরই। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে রাশিয়া দশ বিলিয়ন ব্যারেল অতিরিক্ত তেলের মজুদ আবিষ্কার করার পর থেকে দেশটির তেল ও গ্যাসের মজুদ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৫ সালেই রাশিয়া সোভিয়েত-পরবর্তী সময়ে উৎপাদনের রেকর্ড চারবার ভেঙ্গেছে। তেলের অত্যধিক সরবরাহের কারণে দামে বিশ্বব্যাপী পতন সত্ত্বেও এটি ঘটে। রাশিয়ার তেল কোম্পানিগুলোর জন্য সরকারের সহজ কর নীতির কারণে মূল্য হ্রাস হলেও তার ঝাপটা সরকারের ওপর দিয়ে যায়। ফলে কোম্পানিগুলো উত্পাদন চালিয়ে যেতে পারে। তেলের দাম বেড়ে গেলে তারা পুনরায় শক্তিশালী অবস্থানে যায়।

রাশিয়া বিস্ময়কর গতিতে তাদের জ্বালানির মজুদ বাড়াচ্ছে আহরণ এবং রপ্তানি করছে: মস্কো বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম গ্যাস রপ্তানিকারক এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল রপ্তানিকারক, এটি বিশ্বব্যাপী জ্বালানি বাজারে প্রচুর প্রভাব ফেলেছে।

তবে জ্বালানি শক্তি এতটা প্রাধান্য পাওয়া ও প্রভাবশালী হওয়ার পেছনে ইউরোপের ভূমিকা আছে। ইউরোপ বিশ্বের সবচেয়ে বড় জ্বালানি আমদানিকারক। তারা তাদের ব্যবহৃত জ্বালানির অর্ধেকের বেশী আমদানি করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক গ্যাসের এক-তৃতীয়াংশ ও অপরিশোধিত তেলের ৩৫ শতাংশ রাশিয়া থেকে আমদানি করে। দুর্বল তো দূরের কথা, মহাদেশটিতে রাশিয়ার জ্বালানির প্রভাব বরং শক্তিশালী হচ্ছে। ২০১০ থেকে ২০১৪ সাথে রাশিয়া ইউরোপে তার গ্যাস রপ্তানির পরিমাণ ৪৮ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬৪ শতাংশে নিয়ে গেছে, যা এক-তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী পরিচালক মারিয়া ভ্যান হোভেন বলেন, “ইউরোপীয় ইউনিয়ন অন্তত কিছু সময়ের জন্য রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল থাকবে, আর এটিই বাস্তবতা।” ছয়টি ইউরোপীয় দেশ তাদের গ্যাসের পুরোটাই আমদানি করে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় জ্বালানি কোম্পানি গ্যাজপ্রম থেকে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে গ্যাস আমদানি করে তার ১৫ শতাংশ ইউক্রেনীয় পাইপলাইন দিয়ে আসে। এতে বোঝা যায়, রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রতি দেশটি কতটা দুর্বল।

বেশ কয়েক বছর ধরে বিশ্ব দেখেছে কীভাবে নিজের রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলে পুতিন জ্বালানি বাজারে রাশিয়ার আধিপত্যকে ব্যবহার করে। ২০০৯ সালে ইউক্রেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইউশচেঙ্কোর পতন ঘটানোর জন্য রাশিয়া ইউক্রেনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। পুতিন তার শাস্তিমূলক জ্বালানি নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বা গ্রাহক হারাবেন এমন ভয় পান না। ২০০৯ সালে ইউক্রেন গ্যাস সরবরাহ বন্ধের সময় পুতিন বুলগেরিয়া, গ্রীস, মেসিডোনিয়া, রোমানিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও তুরস্কের সরবরাহও কেটে দেন। কিন্তু এ দেশগুলোর রাশিয়ার জ্বালানির গ্রাহক হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না। পুতিনের এই পদক্ষেপ “ঘণ্টাখানেকের মধ্যে” ইউরোপকে জ্বালানি সংকটে ফেলে।

  • Putin’s Master Plan: To Destroy Europe, Divide NATO, and Restore Russian Power and Global Influence-থেকে অনূদিত।

Leave a Comment