হারাম রিলেশনশিপের পরিণতি নিয়ে ইবনুল জাওজির পাঁচটি উক্তি

আমি হারাম রিলেশনশিপ নিয়ে একটা বই পড়ছিলাম এবং তার সুন্দর সুন্দর চিন্তাভাবনা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল।

তিনি বলেছেন, আমরা এমন অনেক মানুষকেই দেখেছি যাদেরকে তাদের যৌন তাড়না কাবু করে ফেলেছে, তাদের জীবনকে নষ্ট করে দিয়েছে। কেউ কেউ অবিবাহিত অবস্থায় হারাম রিলেশনশিপে জড়িয়ে যায় আবার কেউ কেউ জীবনসঙ্গিনী থাকার পরেও হারাম রিলেশনশিপে জড়ায়। আত্মমর্যাদান ব্যক্তি ময়লার দিকে তাকায় না পর্যন্ত। খারাপ আচরণের চিন্তাকে লালন করতেও সে পছন্দ করে না। তাই তাকে ধর্মীয় মূল্যবোধ মেনে চলার মধ্যেই সচেষ্ট ও সন্তুষ্ট থাকতে হবে। তাকে পরিতৃপ্ত হতে হবে বাইরে থেকে। এভাবে সে অন্তরের প্রশান্তির সাথে জীবনযাপন করতে পারবে। তার হৃদয় হবে পবিত্র হৃদয় বা তাইবুল কাল্ব। কিন্তু এর চেয়ে বেশী আকাঙ্ক্ষা করলে তার হৃদয় চাহিদায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যাবে এবং তার দীনদারিতা হ্রাস পাবে।

ইবনুল জাওজি রহিমুল্লাহ বলেছেন যে, হারাম প্রেম শয়তানের সাজানো একটি ফাঁদ যার ব্যাপারে আমাদের সচেতন হওয়া উচিত। আমি তার বই থেকে কিছু হারাম সম্পর্কের কিছু উদ্ধৃতি তুলে ধরেছি যেগুলো নিয়ে খুব গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফিক দান করুন এবং হেদায়েত দান করুন।

প্রথম উক্তি

হারাম রিলেশনশিপ হলো নিষিদ্ধ স্বাদ আস্বাদন করা।

নিষিদ্ধ বা হারাম প্রেমে জড়িয়ে যে আনন্দ পাওয়া যায় তা ইসলামে হারাম তো বটেই, এই আনন্দ অতি ক্ষণস্থায়ী হয়। ইসলামি শিক্ষায় নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা ও সীমানা রয়েছে। এই সীমানাগুলো নারী-পুরুষকে এবং সমাজকে নেতিবাচক পরিণতি থেকে রক্ষা করতে এবং নৈতিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখার জন্য সাহায্য করে। যেসব সম্পর্ক অনুমোদনযোগ্য সীমার বাইরে পড়ে অর্থাৎ স্ত্রী ব্যতীত গায়রে মাহরাম কারো সাথে প্রণয়ের সম্পর্ক ইসলামে নিষিদ্ধ।

ইবনুল জাওজির উদ্ধৃতিতে এসেছে যে, যদিও এই ধরনের সম্পর্কে জড়িত হলে সাময়িক আনন্দ বা পরিতৃপ্তি পাওয়া যায় কিন্তু যেহেতু এটি চূড়ান্তভাবে হারাম ও নিষিদ্ধ তাই এটি মানুষের জন্য নেতিবাচক পরিণতি বয়ে নিয়ে আসে। হারাম প্রেমের পেছনে ছুটতে অনেকে প্রলুব্ধ হতে পারে। তবে এটা নৈতিকভাবে ভুল এবং ইসলামের শিক্ষার বিপরীত।

হারাম সম্পর্কের মাধ্যমে সাময়িক আনন্দ কামনা করা ইহকাল ও পরকাল উভয় ক্ষেত্রেই নেতিবাচক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। এটি মুমিনদের ইসলামী শিক্ষা দ্বারা নির্ধারিত নির্দেশিকা অনুসরণ করতে এবং ইসলামী নীতি অনুসারে বৈধ ও পবিত্র সম্পর্ক খোঁজার জন্য অর্থাৎ বিয়ে করতে উৎসাহিত করে।

দ্বিতীয় উক্তি

প্রবৃত্তির অনুসরণের চিন্তা আপনাকে প্রবৃত্তির অনুসরণের পরিণতি ভুলিয়ে রাখে।

যখন কেউ তাদের সাময়িক প্রবৃত্তির সুখ দ্বারা গ্রাস হয়, তখন তারা নিষিদ্ধ বা হারাম কর্মে লিপ্ত হওয়ার দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি বিবেচনা করতে সক্ষম থাকে না।

ইসলামী শিক্ষা অনুসারে, প্রবৃত্তি বা হাওয়া মানব প্রকৃতির অংশ। যাইহোক, আত্মনিয়ন্ত্রণ এর চর্চা করা এবং আমাদের ক্রিয়াকলাপের পরিণতি মূল্যায়ন করতে হবে অর্থাৎ পরিণতি নিয়ে ভাবনা ও ফিকির করতে হবে। এমন সব বিষয় নিয়ে ফিকির করা বেশী জরুরী যেগুলো আমাদের হারামের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

যখন মানুষ পুরোপুরিভাবে ডুবে যায় তার কামনাবাসনা পূরণ করতে, তখন সে ভুলে যায় এসব হারাম কাজ করার নেতিবাচক পরিণতি কি ঘটতে পারে। তারা হারাম কার্যকলাপে জড়িত থাকার সাথে জড়িত আধ্যাত্মিক, নৈতিক এবং সামাজিক পরিণাম বা ফলাফল উপেক্ষা করে।

তৃতীয় উক্তি

বুদ্ধিমান হল সেই ব্যক্তি যে তার দীন ও মর্যাদা রক্ষার জন্য হারাম ত্যাগ করে হালাল (হালাল) এর জন্য তার শক্তি (ক্বওয়াত) সংরক্ষণ করে যাতে সেই শক্তি পুণ্যের পিছনে ব্যয় করা যায়।

চতুর্থ উক্তি

অন্তরের অনুভূতির (সারাঈর) ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। কেননা নিজের বাহ্যিক অবস্থা ভালো থাকা সত্ত্বেও ভেতর (জাহির) কলুষিত হলে তা উপকারে আসে না।

পঞ্চম উক্তি

যে নারীদের প্রতি খুব বেশি ঝুঁকে থাকে সে কখনো জীবনকে উপভোগ করবে না। আর যে মদ সেবন করে সে কখনই সুস্থ মন উপভোগ করতে পারবে না এবং যে ধন-সম্পদ ভালবাসে সে যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন এর দাস হয়ে থাকবে।

 

উপসংহার

আপনার হারাম রিলেশনশিপকে একসময় হালাল করে নিবেন এই নিয়তে কখনো হারাম রিলেশনশিপে ডুবে থাকবেন না। আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন যারা তাওয়া করে এবং নিজেদের পবিত্র করে নেয়। আল্লাহ আপনাকে ভালোবাসেন। তিনি আপনার সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিতে সক্ষম। প্রকৃত ভালোবাসা অনুভব করা যায় বিয়ের মাধ্যমে। বিয়ের মাধ্যমেই আল্লাহর চূড়ান্ত ভালোবাসা লাভ করা যায়। হারাম ভালোবাসাকে আসলে রূপক অর্থে ভালোবাসা বলা গেলেও প্রকৃত অর্থে কখনোই একে ভালোবাসা বলা যায় না। এই ভালোবাসা আপনাকে অন্ধ করে দেয়, বোবা ও বধির করে দেয়, আপনাকে আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা থেকে বহু দূরে সরিয়ে দেয়।

কে ছিলেন ইবনুল জাওযী রহিমাহুল্লাহ?
আবুল ফারজ আবদুর রহমান ইবনে জাওজি রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন সমকালীন যুগের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর যুগে তিনি তাফসির, হাদিস ও ইতিহাস পর্যালোচনায় ছিলেন অনন্য। প্রতিটি বিষয়ে তিনি নিজস্ব জ্ঞানগর্ভ সমৃদ্ধ গ্রন্থ রচনা করেছেন। ইবনুল-জাওজি ৫০৭-১২ হি./১১১৩-১৯ খ্রিস্টাব্দের দিকে বাগদাদের একটি “মোটামুটি ধনী পরিবারে” জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এই পরিবার ছিল “আবু বকরের বংশধর” রাদি আল্লাহু আনহু। তার পিতা-মাতা তাদের ছেলেকে সেই সময়ের সমস্ত প্রধান প্রধান জায়গায় উপযুক্ত শিক্ষার জন্য নিয়ে যান।

শৈশবে মাত্র তিন বছর বয়সে তিনি পিতার স্নেহছায়া থেকে বঞ্চিত হন। মায়ের হাত ধরে ছোটবেলা থেকে কোরআন ও ইলমে তাজবিদের ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। সে যুগের বিখ্যাত মুহাদ্দিসদের কাছ থেকে হাদিস শ্রবণ এবং লিপিবদ্ধ করতে থাকেন। এ জন্য তিনি কঠিন পরিশ্রম করতে থাকেন। অন্য বাচ্চারা যে সময় খেলাধুলায় মত্ত থাকত, তিনি সে সময় কোনো হাদিসের দরসে বসে হাদিস শোনায় ব্যস্ত থাকতেন। অথবা নির্জন কোথাও বসে অধ্যয়নে নিমগ্ন থাকতেন। ছোটবেলা থেকেই আল্লাহ তাআলা তাঁর মাঝে পড়াশোনার প্রতি তীব্র আগ্রহ দিয়েছিলেন। বিস্তৃত লাইব্রেরি থেকে কিতাব অধ্যয়ন করাই ছিল তাঁর নেশা। অধ্যয়নের ক্ষেত্রে তিনি নির্দিষ্ট কোনো শাস্ত্র নিয়ে অধ্যয়ন করতেন না; বরং যা-ই সামনে পেতেন তা-ই আদ্যোপান্ত শেষ করতেন। তিনি এক জায়গায় নিজের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন যে কিতাব অধ্যয়নে কখনোই আমার তৃষ্ণা মেটে না, যখনই আমি কোনো নতুন গ্রন্থের সন্ধান পাই, মনে হয় আমি গুপ্তধন পেয়েছি। আর এই আগ্রহ আমাকে দিন দিন আগে বাড়তে সাহায্য করেছে।

ইবনুল-জাওজি ইবনুল জাঘুনি (মৃত্যু ১১৩৩ হিজরি), আবুর মতো উল্লেখযোগ্য আলিমদের অধীনে অধ্যয়নের সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। বকর আল-দিনাওয়ারী (মৃত্যু ১১৩৭-৮), শায়খ সাইয়েদ রাজ্জাক আলী গিলানি (মৃত্যু ১২০৮), আবু মানসুর আল-জাওয়ালিকি (মৃত্যু ১১৪৪-৫), আবুল ফাদল খ. আল-নাসির (মৃত্যু ১১৫৫), আবু হাকিম আল-নাহরাওয়ানি (মৃত্যু ১১৬৪) এবং আবু ইয়ালা কনিষ্ঠজন (মৃত্যু ১১৬৩)।

লেখালেখি : তিনি এত বেশি পরিমাণে নিজ হাতে হাদিস লিপিবদ্ধ করেন যে মৃত্যুর সময় তিনি অসিয়ত করে যান যে তাঁর গোসলের পানি যেন ওই কাঠপেন্সিল দিয়ে গরম করা হয়, যা দ্বারা তিনি হাদিস লিপিবদ্ধ করেছেন। কারণ তিনি হাদিস লেখার জন্য এত পরিমাণে কাঠপেন্সিল ব্যবহার করেছেন, যা পানি গরম করার জন্য যথেষ্ট ছিল। পরবর্তী সময়ে এমন হয়েছে যে পানি গরম করার পর আরো কাঠপেন্সিল অবশিষ্ট ছিল। তাঁর লিখিত গ্রন্থের পরিমাণ তিন শর বেশি। মহান এই মনীষী ৫৯৭ হিজরি, ১২০১ খ্রিস্টাব্দে মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে পাড়ি জমান।

Leave a Comment