ইসতিগফার কেন করব?

প্রথম কারণঃ মানুষের সহজাত ঘাটতি

প্রকৃতপক্ষে, আল্লাহ যতটা প্রশংসা বা ইবাদত পাওয়ার যোগ্য; মাখলুকের পক্ষে তার ততটা প্রশংসা বা ইবাদত করা সম্ভব না। আর যদি তা সম্ভবও হতো (আল্লাহ যতখানি ইবাদতের যোগ্য তা করা), তবুও আল্লাহ তাকে সে সামর্থ্য দান না করলে তার পক্ষে এটি করা সম্ভব হতো না। আর, বান্দা যদি তার সম্পূর্ণ জীবন ইবাদত ও আল্লাহর আনুগত্যে কাটিয়ে দিত, এরপরও সে আল্লাহর প্রাপ্য হক আদায় করতে পারত না। এরপরও বান্দা যে সামান্য নেক আমল করে আল্লাহ তাতে সন্তুষ্ট থাকেন। এই ইবাদত বান্দার জন্য কঠিন হয় না, তাদেরকে খুব একটা সময় ব্যয়ও করতে হয় না।

সহিহাইনে আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত আছে যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

لَنْ يُدْخِلَ أَحَدًا عَمَلُهُ الْجَنَّةَ قَالُوا وَلاَ أَنْتَ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ لاَ وَلاَ أَنَا إِلاَّ أَنْ يَتَغَمَّدَنِي اللهُ بِفَضْلٍ وَرَحْمَةٍ

তোমাদের কোন ব্যক্তিকে তার নেক আমল জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারবে না। লোকজন প্রশ্ন করলঃ হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকেও নয়? তিনি বললেনঃ আমাকেও নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ আমাকে তাঁর করুণা ও দয়া দিয়ে আবৃত না করেন।[1]

আল্লাহ তার বান্দাদের থেকে পূর্ণ অমুখাপেক্ষী। তার বান্দাদের কাছে কোনো প্রয়োজন নেই, বরং বান্দাই সর্বদা তার ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। এরপরও তিনি তাদেরকে প্রচুর নিয়ামত দান করেন যেমনটি মুসলিমে আবু যার রা. থেকে বর্ণিত আছে যে যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

يَقُولُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ أَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِي بِي وَأَنَا مَعَهُ حِينَ يَذْكُرُنِي إِنْ ذَكَرَنِي فِي نَفْسِهِ ذَكَرْتُهُ فِي نَفْسِي وَإِنْ ذَكَرَنِي فِي مَلإٍ ذَكَرْتُهُ فِي مَلإٍ هُمْ خَيْرٌ مِنْهُمْ وَإِنْ تَقَرَّبَ مِنِّي شِبْرًا تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ ذِرَاعًا وَإِنْ تَقَرَّبَ إِلَىَّ ذِرَاعًا تَقَرَّبْتُ مِنْهُ بَاعًا وَإِنْ أَتَانِي يَمْشِي أَتَيْتُهُ هَرْوَلَةً

আল্লাহ জাল্লা শানুহু বলেন, আমি বান্দার ধারণা অনুযায়ী নিকটে আছি। যখন সে আমার যিকর (স্মরণ) করে সে সময় আমি তার সাথে থাকি। বান্দা আমাকে একাকী স্মরণ করলে আমিও তাকে একাকী স্মরণ করি। আর যদি সে আমাকে কোন সভায় আমার কথা স্মরণ করে তাহলে আমি তাকে তার চেয়ে উত্তম সভায় স্মরণ করি। যদি সে আমার দিকে এক বিঘত অগ্রসর হয় তাহলে আমি তার দিকে এক হাত এগিয়ে আসি। যদি সে আমার দিকে হেঁটে আসে আমি তার দিকে দৌড়িয়ে আসি।[2]

যদিও ইবাদতে বান্দার তেমন একটা সময় ব্যয়িত হয় না; এবং দুনিয়ার বয়সের তুলনায় তার বয়স অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত; এবং আখিরাতের তুলনায় পুরো দুনিয়া চোখের পলকের মতো; এরপরও বান্দা তার ক্ষুদ্র জীবনে যে সামান্য ইবাদত করে আল্লাহ তার জন্য পুরষ্কৃত করেন। এমন পুরষ্কার যা কোনো চোখ দেখেনি, কোনো কান শুনেনি, কোনো মানবহৃদয় কখনো কল্পনাও করেনি। সে জান্নাত এত বিশাল হবে যা আসমান-জমিনের ব্যাপ্তির চেয়েও বিশাল, যে জীবনের কোনো শেষ নেই। সহিহ হাদিসে[3] এসেছে, জান্নাতের সবচেয়ে নিচু মর্যাদার ব্যক্তিও দুনিয়ার দশগুণ বৃহৎ জান্নাত লাভ করবে। এ জায়গায় আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে চাচ্ছি না, কেবল বিষয়টি উল্লেখ করাই উদ্দেশ্য। তাই, আল্লাহর যে ইবাদত প্রাপ্য সেটির সাপেক্ষে বান্দা যখন তার ঘাটতি সম্পর্কে জানতে পারে; এবং তার ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও সে ইয়ামুল কিয়ামাহতে[4] পুরষ্কার হিসেবে যা পাবে তা জানতে পারে, সে ইসতিগফার করার তীব্র প্রয়োজন বোধ করবে।

 

দ্বিতীয় কারণঃ ইবাদতে ঘাটতি

আল্লাহ তার বান্দাকে নানা ফরজ আমল, দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের আদেশ দিয়েছেন যা সম্পর্কে সবাই অবগত। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমলগুলো যেভাবে করেছেন, ঠিক সেভাবে ইবাদতগুলো পালন করার মতো একজনকেও পাওয়া যায় না। এর পেছনে কারণ হিসেবে সামর্থ্যের অভাব, ইলমের অভাব, গাফিলতিসহ অন্যান্য বিষয়কে দায়ী করা যেতে পারে। সুতরাং, কোনো ইবাদতই ত্রুটিমুক্ত নয়। ত্রুটি কমবেশী উভয়ই হতে পারে। সুতরাং, ইবাদতগুলো নির্ঘাত ত্রুটিযুক্ত হবে, অথবা ইবাদত পালনের সময় তাতে রিয়া[5] বা উজব-এর[6] বিষ প্রবেশ করায় সেটির সাওয়াব কমে যাবে। এ কারণে যে কোনো ইবাদতের পর সেটির ত্রুটি পূরণ করার জন্য ইসতিগফারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সহিহ মুসলিমে সাওবান রা. থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সালাত আদায়ের পর তিনবার ইসতিগফার করতেন।[7] আল্লাহ সুবহানাহুতাআলা বলেছেন,

ثُمَّ اَفِیۡضُوۡا مِنۡ حَیۡثُ اَفَاضَ النَّاسُ وَ اسۡتَغۡفِرُوا اللّٰهَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۱۹۹﴾

অতঃপর তোমরা প্রত্যাবর্তন কর, যেখান থেকে মানুষেরা প্রত্যাবর্তন করে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।  [সুরা বাকারা ২ : ১৯৯]

এবং সহিহাইনে ইবনু উমর রা.-এর সূত্রে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজ বা উমরাহ থেকে ফিরে আসার সময় বলতেন:

آيِبُونَ تَائِبُونَ عَابِدُونَ سَاجِدُونَ لِرَبِّنَا حَامِدُونَ

আয়িবুন, তায়িবুন, আবিদুন, সাজিদুনা লিরাব্বিনা হামিদুন

আমরা তাঁরই নিকট প্রত্যাবর্তনকারী, তাঁর কাছেই ক্ষমাপ্রাথী, তাঁরই ইবাদাতকারী, ’আমরা আমাদের রবের উদ্দেশ্যেই সিজদাকারী, তাঁরই প্রশংসকারী।[8]

আল্লাহ সুরা মুজজামিলের শেষ আয়াতে কিয়ামুল লাইলের ব্যাপারে বলেছেন,

وَ اسۡتَغۡفِرُوا اللّٰهَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۲۰﴾

আর তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। নিশ্চয় আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।  [সুরা আল মুজজাম্মিল ৭৩ : ২০]

এবং আল্লাহ বলেন,

اَلصّٰبِرِیۡنَ وَ الصّٰدِقِیۡنَ وَ الۡقٰنِتِیۡنَ وَ الۡمُنۡفِقِیۡنَ وَ الۡمُسۡتَغۡفِرِیۡنَ بِالۡاَسۡحَارِ ﴿۱۷﴾

যারা ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, আনুগত্যশীল ও ব্যয়কারী এবং শেষ রাতে ক্ষমাপ্রার্থনাকারী। [সুরা আলে ইমরান ৩ : ১৭]

আর (এ আয়াতের ব্যাপারে) কিছু আহলুল ইলম বলেছেন যে এটি (ইসতিগফার) করতে হবে কিয়ামুল লাইলের পর। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের ইতি – যে জীবন ছিল দাওয়াহ, জিহাদ ও কল্যাণে ভরপুর – ঘটে ইসতিগফারের মাধ্যমে। যেমনটি সহিহ মুসলিমে আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাম তার মৃত্যুশ্যায় অধিক সংখ্যায় এ দুআ পড়তেন:

سُبْحَانَ اللَّهِ وَبِحَمْدِهِ أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ ‏

সুবহা-নাল্ল-হি ওয়াবি হাম্‌দিহী আস্তাগফিরুল্ল-হা ওয়াতুবু ইলাইহি

মহান পবিত্র আল্লাহ। সমস্ত প্রশংসা তার জন্য। আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি, আমি তার কাছে তওবা করছি, অনুতপ্ত হচ্ছি।[9]

আর অসংখ্য দলিল (ইবাতের পর ইসতিগফার করার) আছে। তাই ইবাদতে যে ঘাটতি ও অপূর্ণতা ছিল আল্লাহর ইচ্ছায় ইসতিগফার বৃদ্ধির দ্বারা সেগুলির ক্ষতিপূরণের চেষ্টা করা হয়।

[1] সহিহ বুখারি : ৫৬৭৩

[2] সহিহ মুসলিম : ২৬৮৭

[3] সহিহ মুসলিম : ১৮৬; তিরমিজি : ৩১৯৮

[4] কিয়ামতের দিবস।

[5] লোক দেখানো।

[6] অন্তঃ অহংকার, গৌরব থাকা। লেখক এখানে এমন ব্যক্তির কথা বলছেন যে ইবাদতের কারণে নিজেকে সম্মানিত ও আত্মগৌরবের দৃষ্টিতে দেখে।

[7] সহিহ মুসলিম : ৫৯১

[8] সুনানু আবি দাউদ : ২৭৭০

[9] সহিহ মুসলিম : ৪৮৪

সূত্রঃ শায়খ আহমাদ মুসা জিবরিলের “The Causes of Istighfar” সিরিজের অবলম্বনে রচিত ও অনূদিত।

Leave a Comment