স্মরণসভার প্রস্তুতি গণহত্যা দিবসে সমাবেশের অনুমতি নেই

বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চার বছর পূর্তি হচ্ছে আগামীকাল বুধবার (২৫ আগস্ট) মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের মুখে কয়েক লাখ রোহিঙ্গার । সীমিত আকারে হলেও ‘গণহত্যা দিবসে’ সভা-সমাবেশ করে তাঁরা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ঘৃণা জানাতে চান কক্সবাজারের বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা বলছেন এই কথা । মসজিদে স্মরণসভা করার প্রস্তুতি চলছে তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনুমতি না পাওয়ায় আশ্রয়শিবিরগুলোর ।

উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবির কক্সবাজার শহর থেকে ৪৭ কিলোমিটার দূরে । একটি মুদিদোকানে বসে কয়েকজন রোহিঙ্গা নাগরিককে আড্ডা দিতে দেখা যায় আজ মঙ্গলবার সকাল ১০টায় আশ্রয়শিবিরের । তবে সবার মুখে ২৫ আগস্টের রোহিঙ্গা নিপীড়নবিরোধী ‘গণহত্যা দিবস’ নিয়ে আলোচনা। আমরা চাইছি সীমিত আকারে হলেও গণহত্যা দিবসের সভা-সমাবেশ করে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ঘৃণা জানাতে আবদুল গফ্ফার (৬৫) নামের এক রোহিঙ্গা বলেন। তবে পারব বলে মনে হচ্ছে না। তবে আশ্রয়শিবিরগুলোতে করোনা সংক্রমণ রোধে আগে থেকেই বিধিনিষেধ জারি করা আছে বলে জানান তারা । আমরা ২৫ আগস্টের গণহত্যা দিবসটি পালন করতে পারিনি গত দুই বছরও আশ্রয়শিবিরগুলোতে ।’

অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে একই অভিমত জানা গেছে সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত উখিয়ার কুতুপালং, মধুরছড়া, বালুখালী, লম্বাশিয়া, জুমশিয়া এবং টেকনাফের শালবন, জাদিমুরা শিবির ঘুরে । আশ্রয়শিবিরগুলোর বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসায় মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠানের জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে বলে জানা যায় । তবে আশ্রয়শিবিরের বিভিন্ন পয়েন্ট এবং রাস্তার মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিয়েছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) সদস্যরা ।

২০১৯ সালে ২৫ আগস্ট কুতুপালং শিবিরের ফুটবল মাঠে কয়েক লাখ রোহিঙ্গার গণহত্যাবিরোধী মহাসমাবেশটি বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছিল কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা বলেন। তবে সংরক্ষিত আশ্রয়শিবিরের অভ্যন্তরে বড় ধরনের রোহিঙ্গা সমাবেশ করতে অনুমতি দিয়ে বেকায়দায় পড়েছিলেন প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেকে । আর মূলত এর পর থেকে ২৫ আগস্টের সমাবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না ।

২০১৯ সালের ২৫ আগস্টের ওই মহাসমাবেশে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রোহিঙ্গা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান মুহিবউল্লাহ। তবে সমাবেশে তিনি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান, নিরাপত্তা, রাখাইনে ফেলে আসা জন্মভিটা ফেরতসহ সাত দফা দাবি পূরণ না হলে কোনো রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে যাবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। আর এখনো একই দাবিতে অনড় রোহিঙ্গারা।

তবে মুহিবউল্লাহ কয়েক দিন ধরে ২৫ আগস্টের গণহত্যা দিবস পালনের অনুমতি চেয়ে বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ করছেন । তিনি রংপুর ডেইলীকে বলেন, রোহিঙ্গা নিপীড়নবিরোধী দিবসটি পালনের জন্য অনুমতি চেয়ে উখিয়া ও টেকনাফের ২৭টি ক্যাম্পের শতাধিক নেতার যৌথ স্বাক্ষরে সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) বরাবরে আবেদন করা হয়েছে । তবে এখনো সম্মতি মেলেনি । ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যা অথবা কালো দিবসটি’ মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরবসহ বিশ্বের ১১টি দেশে পালিত হবে বলে জানান তারা । বাংলাদেশে আশ্রয়শিবিরগুলোতে মসজিদ-মাদ্রাসায় দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিহতদের স্মরণ এবং মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ঘৃণা জানানো হবে । তবে দোয়া মাহফিল হবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে।

সমাবেশ প্রসঙ্গে জানতে একাধিকবার চেষ্টা করেও আরআরআরসি শাহ রেজওয়ান হায়াতের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। অন্য সরকারি কর্মকর্তারাও কথা বলতে রাজি নন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরআরআরসি কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, এবারও আশ্রয়শিবিরের অভ্যন্তরে ২৫ আগস্টের গণহত্যা দিবসের সমাবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। রোহিঙ্গারা যেন সভা-সমাবেশ করতে না পারে, সে ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তৎপর রাখা হয়েছে।

রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক ও পুলিশ সুপার নাইমুল হক রংপুর ডেইলীকে বলেন, করোনা মহামারি উপলক্ষে আশ্রয়শিবিরগুলোতে আগে থেকেই লোকসমাগম, সভাসমাবেশ নিষিদ্ধ আছে। তাই ২৫ আগস্টের দিনেও কোনো সমাগম সেখানে ঘটতে দেওয়া হবে না। তবে রোহিঙ্গারা আশ্রয়শিবিরের বিভিন্ন মসজিদে মিলাদ মাহফিল করে রাখাইনের আগস্টের বর্বর অত্যাচার নির্যাতনের ঘটনায় নিহতদের স্মরণ করবে। তবে এর বাইরে অন্য কিছু করতে দেওয়া হবে না। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় আট লাখ রোহিঙ্গা। এর আগে আসে আরও কয়েক লাখ। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১১ লাখ।

প্রত্যাবাসন শুরুর দাবি স্থানীয়দের :


চার বছরেও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ায় ক্ষুব্ধ জেলার রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া নিয়েও ক্ষোভ আছে তাঁদের মধ্যে। রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর বলেন, চার বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। মিয়ানমারের অনীহা এবং দেশি-বিদেশি কতিপয় এনজিও ও সন্ত্রাসী গ্রুপের ইন্ধনে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার চক্রান্তে লিপ্ত। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন জোরদার করার দাবিতে বুধবার (২৫ আগস্ট) সকালে কক্সবাজার পৌরসভা ভবন চত্বরে গণসমাবেশ আহ্বান করা হয়েছে।

রোহিঙ্গা সমস্যাকে ‘বিষফোড়া’ আখ্যায়িত করে উখিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গারা এখন মাদক, সোনা চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েছে। এ নিয়ে প্রায় মারামারি, খুনখারাবিতে জড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা। স্থানীয়দের ওপরও হামলা চালাচ্ছে তারা। ইয়াবার টাকায় অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে চুরি-ডাকাতি, অপহরণ, ধর্ষণের ঘটনায় লিপ্ত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। জেলার শ্রমবাজারও অনেকটা রোহিঙ্গাদের দখলে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বলেন, মানবিক কারণে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া হলেও তারা নানা অপরাধকর্ম, মাদক চোরাচালান, খুনখারাবিতে জড়িয়ে পড়েছে। ক্যাম্প ছেড়ে লাখো রোহিঙ্গা দেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ছে, যা দেশের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।

Leave a Comment