ঢাকা কলেজ থেকে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে বেচছেন পান-সিগারেট

ভালো একটা চাকরি আর সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে ১৪ বছর আগে বরিশাল থেকে রাজধানী ঢাকায় এসেছিলেন মোহাম্মাদ মনিরুজ্জামান। ভর্তি হন তিতুমীর কলেজে। খরচ জোগাতে শুরু করেন ‘ছোটখাটো’ চাকরি। এভাবে সেখানে স্নাতক শেষে ঢাকা কলেজ থেকে করেন স্নাতকোত্তরও। এরপর পুরোদমে চাকরি শুরু করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে; করেন বিয়েও।

ওই চাকরি দিয়ে মোটামুটি ভালোই চলছিল মনিরুজ্জামানের দিনকাল। আরেকটু ভালো থাকতে সরকারি চাকরির আশায় পরিচিত একজনকে সাড়ে তিন লাখ টাকা দিয়ে ধরা খান।

তারপরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন ভালো একটা চাকরির। সেটা নিশ্চিতও হয়েছিল। কিন্তু গত বছরের প্রথম দিকে করোনা লণ্ডভণ্ড করে দেয় তার স্বপ্ন। নিশ্চিত চাকরিটাও করতে পারেননি।

এমন পরিস্থিতিতে লাজলজ্জা ভুলে এক বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার করে রাস্তার পাশে দেন পান-সিগারেটের দোকান। এই দোকান থেকে যা আয় হয়, তা দিয়ে কোনোমতে চালিয়ে যাচ্ছেন জীবনসংগ্রাম। পাশাপাশি খুঁজছেন স্বপ্নের সেই চাকরি। কিন্তু করোনার কারণে কোথাও ঢুকতে পারছেন না। এদিকে বয়সও বাড়ছে। সব মিলিয়ে চরম হতাশার মধ্যে রয়েছেন ৩২ বছর বয়সী এই যুবক।

সম্প্রতি ধানমন্ডির শংকর এলাকায় পান-সিগারেটের ওই দোকানে তার সঙ্গে কথা বলে নিউজবাংলা। মনিরুজ্জামান জানান, তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। ছয় বছর আগে তিনি বিয়ে করেন। তার বউ-বাচ্চা থাকেন বরিশালের গ্রামের বাড়িতে বাবা-মায়ের সঙ্গে।

তিনি জানান, গত বছর করোনার শুরুতেই বন্ধুর কাছ থেকে ২২ হাজার টাকা ধার করে দোকানটি দেন, ওই বন্ধুর বাসায়ই থাকছেন তিনি। মাসে ৫-৬ হাজার টাকা বাড়ি পাঠান। কিন্তু বন্ধুর পরিবার আসছে সামনের মাসেই। তাই তাকে ভাড়া বাসায় উঠতে হবে। তাহলে গ্রামে বাবা-মা ও স্ত্রী-সন্তানের জন্য টাকা পাঠাবেন কীভাবে, সে চিন্তায় যেন ‘ঘুম হারাম’ তার।

এই যুবক জানান, গত বছরের মার্চ মাসে করোনা মহামারি শুরুর আগে একটি বেসরকারি হাসপাতালের কাস্টমার সার্ভিসে রিপোর্ট ডেলিভারিম্যান পদে চাকরি করতেন। ওই চাকরি দিয়ে মোটামুটি ভালোই চলছিল। তবে গত বছর লকডাউনের আগে হঠাৎ রাজশাহীতে বদলি করায় সেই চাকরি ছেড়ে দেন।

তিনি বলেন, ‘সে সময় রাজধানীর আরেকটি হাসপাতালে অন্য একটা চাকরি হয়েই গিয়েছিল। এপ্রিলে সেখানে যোগ দেয়ারও কথা ছিল। কিন্তু মার্চে লকডাউন শুরু হলে তারা ওই নিয়োগ স্থগিত করে দেয়, আর লোক নেয়নি।’

মনিরুজ্জামান বলেন, ‘এরপর আমি চরম হতাশায় পড়ে যাই। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। পরে আমার এক কাছের বন্ধুর পরামর্শে তার কাছ থেকে ২২ হাজার টাকা ধার করে এই পান-সিগারেটের দোকান দিই।

‘লজ্জা নিয়ে বসে থাকলে তো আর আমার জীবন চলবে না। কিছু একটা তো আমাকে করতেই হবে। গ্রামের বাড়ি স্ত্রী ও দেড় বছর বয়সী মেয়ে আছে। তারা থাকছে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সঙ্গে। তাদের তো বাঁচাতে হবে।’

‘করোনা হয়ে একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে’

করোনার কারণেই বেকার হয়ে রাস্তার পাশে দোকানদারি করলেও একদিক থেকে ভালোই হয়েছে বলে মনে করেন এই যুবক।

বলেন, ‘করোনা হয়ে একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। মাস্ক পরে দোকানদারি করি। রাস্তা দিয়ে অনেক পরিচিত চলে যায়। কেউ কলেজের বন্ধু, কেউ দেশের বাড়ির পরিচিত, আরও কত পরিচিত আছে। মাস্ক পরা থাকার করণে তারা আমাকে চিনতে পারে না। আর চিনলেইবা কী? আমার কাজ আমি করি। এই কাজ করেই জীবন চালাই।’

‘সবাই বলছে, করোনায় কোনো নিয়োগ হবে না’

এভাবে নিজেকে একপ্রকার সান্ত্বনা দিলেও ভেতরে ভেতরে সারাক্ষণই যে দুশ্চিন্তা করেন, চরম হতাশায় ভোগেন, তাও তিনি জানিয়েছেন নিউজবাংলার সঙ্গে আলাপকালে।

মনিরুজ্জামান বলেন, ‘এখন খুব হতাশার মধ্যে আছি ভাই। আমার বয়স ৩২ বছর চলছে। ৩৫ বছর পর আর কোনো বেসরকারি চাকরিও হবে না আমার। এক জায়গায় ইন্টারভিউ দিয়েছি, চাকরি হয়নি। আরও কয়েক জায়গায় কথা বলেছি। সবাই বলছে, করোনার ভেতরে কোনো নিয়োগ হবে না।

‘আর এই করোনা কবে যাবে, সেটাও তো বলা যাচ্ছে না। লাজলজ্জা ভুলে বেঁচে থাকার তাগিদে এই ব্যবসা হয়তো কিছু দিন করা যাবে। কিন্তু সারা জীবন তো আর করা যাবে না। সব মিলিয়ে চরম হতাশার মধ্যে আছি, ভাই।’

‘কেউই জানত না পান-সিগারেটের ব্যবসা করি’

লজ্জায় প্রথম দিকে পরিবারের কাউকেও পান-সিগারেটের দোকান দেয়ার কথা জানাতে পারেননি এই যুবক।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘প্রথম দিকে আমার পরিবারের কেউই জানত না আমি পান-সিগারেটের ব্যবসা করি। সবাই জানত একটা বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করি। কিন্তু কত দিন আর লুকানো যায় বলেন? তাই পাঁচ মাস আগে বউকে এই ব্যবসার কথা প্রথম জানাই। আস্তে আস্তে মা-বাবাসহ পরিবারের সবাই জেনে যায়।’

মনিরুজ্জামান বলেন, ‘ছয় বছর আগে বিয়ে করে সংসার গড়ি। দেড় বছরের একটা মেয়ে আছে আমার। বউ আর মেয়ে আমার মা-বাবার সঙ্গে গ্রামের বাড়ি থাকে। আমরা তিন ভাই ও দুই বোন। আমি সবার ছোট।’

কেমন চলছে দোকান, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন তিন-চার হাজার টাকার বেচাকেনা হয়। সেখান থেকে চার-পাঁচ শ টাকা লাভ থাকে। এই টাকা থেকে প্রতি মাসে বাড়িতে পাঁচ-ছয় হাজার পাঠাই। বাকি টাকা দিয়ে আমি ঢাকায় চলি। এর মধ্যে যে টাকা জমাতে পারি, দুই-তিন মাস পরপর বাড়ি গেলেই তা শেষ হয়ে যায়।’

‘বড় চিন্তা সামনের মাস থেকে থাকব কই’

মনিরুজ্জামান বলেন, ‘ঢাকায় আমি আমার ওই বন্ধুর বাসায় থাকি। সে আমার সবই জানে। তাই আমার কাছ থেকে বাসা ভাড়া নেয় না। আমি শুধু মাঝে মাঝে বাজার করে দিই। কিন্তু কয়েক দিন পরেই বন্ধু তার পরিবারকে ঢাকায় নিয়ে আসবে। তাই তার বাসা আমাকে ছেড়ে দিতে হবে। এখন বড় চিন্তা সামনের মাস থেকে আমি কই থাকব। এখন তো বাড়ি ভাড়া দেয়া লাগে না। অন্যখানে গেলে তো বাড়ি ভাড়া, খাওয়া খরচ সব লাগবে। তখন চলব কীভাবে?’

শিক্ষাজীবন সম্পর্কে জানতে চাইলে এই যুবক বলেন, ‘এসএসসিতে এ গ্রেড পেয়েছি, এইচএসসিতে বি গ্রেড পেয়ে তিতুমীর কলেজে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্সে ভর্তি হই, সেকেন্ড ক্লাস পাই। পরে মাস্টার্স করার জন্য ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। ২০১৩ সালে ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে বের হই।’

‘সব শেষ হয়ে যায় ২ বছর আগেই’

মনিরুজ্জামান জানান, ঢাকায় পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি করে কিছু টাকা সঞ্চয় করেছিলেন। সরকারি এক হাসপাতালে চাকরির আশায় সেই সঞ্চয় এবং ধার করে মোট সাড়ে তিন লাখ টাকা দিয়েছিলেন এক পরিচিতকে। কিন্তু সেই চাকরি হয়নি, টাকাও ফেরত পাননি। পেয়েছেন শুধু ঋণের বোঝা।

তিনি বলেন, ‘আমার সব শেষ হয়ে যায় দুই বছর আগেই। পড়াশোনা করা অবস্থায় চাকরি করে কিছু টাকা জমাইছিলাম। হঠাৎ পরিচিত একজন আমার কাছে প্রস্তাব দেয় সাড়ে তিন লাখ টাকা দিলে আগারগাঁওয়ের সরকারি চক্ষু হাসপাতালে একটা চাকরি দিয়ে দেবে। আমি লোভে পড়ে আমার জমানো কিছু টাকা আর ধারদেনা করে তাকে মোট সাড়ে তিন লাখ টাকা দিই। এরপর সেই চাকরিও আমার হলো না, আর সেই টাকাও পাইলাম না। তখনই আমার সবকিছু শেষ হয়ে যায়।’

‘মাস্ক পরা ছবি তোলেন, ভিডিও কইরেন না ভাই’

মনিরুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভাই, আমার ভিডিও কইরেন না। রিপোর্টের জন্য ছবি দরকার হলে মাস্ক পরা ছবি দিয়েন।’

এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বোঝেনই তো ভাই। পরিবারের লোকজন জানে আমি পান-সিগারেট বেচি। কিন্তু বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, এলাকার মানুষজন তো জানে না। আমার সহপাঠীদের কেউ সরকারি কর্মকর্তা, কেউ সরকারি শিক্ষক, কেউ ব্যাংকার। এভাবে রাস্তায় পান-সিগারেট বেচতে দেখলে তারাও অনেক কষ্ট পাবে।’

Leave a Comment