রাশিয়া জ্বালানি নিয়ে যে খেলা খেলছে তা রাশিয়ার অন্যান্য আক্রমণাত্মক দিক – সামরিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক – এর মতো। এগুলি যেমন গুরুতর ও শক্তিশালী তেমনি আপন মৃত্যুর বীজ এর ভেতরেই বপিত আছে। তাই এর বিরুদ্ধে শক্তিশালী পশ্চিমা প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এখন পর্যন্ত আমরা পশ্চিমে এটারই অভাব দেখেছি। অথচ পুতিনের জ্বালানি খেলায় তাকে পরাজয় ঘটানোর রাস্তা স্পষ্ট।
পাজলটি সমাধানের একটি রাস্তা হচ্ছে, ইউরোপকে একটি এনার্জি ইউনিয়ন তৈরী করতে হবে যার মাধ্যমে সদস্য দেশগুলোর অর্থনীতির মধ্যে সমন্বয় বাড়বে এবং রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমবে। এই ইউনিয়নের আইডিয়া বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। তবে একে বাস্তবায়িত করতে হলে সদস্য দেশগুলোর জাতীয় জ্বালানি নীতিতে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। ফরাসিরা নিউক্লীয় শক্তির ওপর অধিক নির্ভরশীল, অন্যদিকে জার্মানরা সহনীয় মূল্যে রাশিয়ানদের থেকে গ্যাস কেনে। বাল্টিক সাগরের তলদেশ দিয়ে যাওয়া পাইপলাইন নর্ড স্ট্রিমের মাধ্যমে রাশিয়া জার্মানিতে গ্যাস পাঠায়। অন্য দেশগুলোও ভালো দামে রাশিয়ান গ্যাস পাওয়ায় নতুন ইউনিয়ন গড়ে গ্যাস পাওয়ার সুবিধাকে ঝুঁকিতে ফেলতে চাইছে না। অন্যদিকে পোল্যান্ড রাশিয়ার গ্যাসের ওপর তত নির্ভরশীল নয়। তারা কয়লা ব্যবহার করে। তবে কয়লায় প্রচুর কার্বন নির্গমন হওয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য দেশের এটি পছন্দ নয়। যেমন, জার্মানি কার্বন নির্গমন হ্রাসের ব্যাপক প্রয়াস চালাচ্ছে এবং নবায়নযোগ্য উৎসের দিকে ঝুঁকছে। কিন্তু পোলিশদের কাছে জ্বালানি নিরাপত্তাই মুখ্য, পরিবেশগত দিকটি গৌন।
দেশগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক এসব প্রতিযোগিতামূলক ও বিরোধপূর্ণ লক্ষ্যগুলি সমাধান করতে হবে। জ্বালানিশক্তির সমস্যা, সংস্থান ও নীতিগুলির উপর যদি একটি ঐক্যবদ্ধ ইউরোপীয় জ্বালানি ইউনিয়ন গড়ে তোলা যায়, তবে তা রুশদের দেখানো অর্থনৈতিক ভীতি ও ব্ল্যাকমেইলের বিরুদ্ধে শক্তিশালী বাধা হয়ে দাঁড়াবে। আর তারা রাশিয়ান গ্যাসের বড় গ্রাহক হয়ে উঠলে ইউরোপীয় জ্বালানি ইউনিয়ন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। ফলে এর সদস্যদেরও আরও সুবিধাজনক জ্বালানির দাম নির্ধারণ করার সক্ষমতা তৈরী হবে। বর্তমানে প্রতিটি দেশ আলাদাভাবে এই কাজ করছে, যার কারণে তারা সুবিধা করে উঠতে পারছে না। সে ক্ষেত্রে ইউরোপীয় জ্বালানি ইউনিয়নের ওপরে কথা বলার সামর্থ্য কেবল গ্যাজপ্রমের থাকবে। গ্যাসের ক্ষেত্রে রাশিয়ার সাথে ইউরোপের সম্পর্ক যত বেশি নিরাপদ হবে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রগুলি তাদের জ্বালানিশক্তির বাজারে বৈচিত্র্য আনতে এবং আরও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করতে সক্ষম হবে।
তবে জ্বালানি রাশিয়ার শক্তি হলেও এটা তাদের দুর্বলতাও। আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলি রাশিয়াকে আক্রমণের ক্ষেত্রে এ দিকটি বেছে নিতে পারে। রাশিয়ার অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে তেল ও গ্যাসের বিশাল মজুদের ওপর নির্ভরশীল। এটি এক গুরুতর দুর্বলতা। এরপরও পুতিন একে কাজে লাগিয়ে বৈশ্বিক বাজারকে প্রভাবিত করে, নির্দিষ্ট কিছু দেশকে শাস্তি দেয় এবং অন্য দেশকে এমনভাবে তাদের ওপর নির্ভরশীল করে যেন রাশিয়ার জ্বালানি ক্রেতারা ক্রেমলিনের ইচ্ছার বাইরে কাজ করতে না পারে। ইউরোপীয় অর্থনীতি ভুলেও ক্রেমলিন থেকে আমদানিকৃত তেল ও গ্যাসের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারে না। সস্তা, ঝামেলামুক্ত এ রাশিয়ান গ্যাসের প্রবাহ বন্ধের যে কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শক্তিশালী কর্পোরেট গ্রুপগুলো লবিইং করে। ইউরোপীয় রাজনীতিবিদদের অর্থের বিনিময়ে কিনে নিতে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত্ব জ্বালানি কোম্পানিগুলোর কোনো বিবেকের দংশন হয় না। এতে লাভবান হয় রাশিয়াপন্থী দল ও এর নেতারা। এভাবে সোভিয়েত স্টাইলের দূর্নীতি অনেক ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানে ঢুকে পড়েছে।
রাশিয়ান তেল এবং গ্যাস সরবরাহকে আমেরিকান এবং ইউরোপীয় জ্বালানি উত্স দিয়ে প্রতিস্থাপন করাই এই নির্ভরতা ও দুর্নীতির দুষ্টচক্র থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়। একটি প্রতিযোগিতামূলক জ্বালানি বাজার তৈরির জন্য ইউরোপকে পদক্ষেপ নিতে হবে। ইউরোপের উচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করা। এ ছাড়া তারই নিজস্ব তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস উভয়ই প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ইউরোপে অন্তত একটি প্রজন্ম চালানোর মতো যথেষ্ট গ্যাসের মজুদ রয়েছে; সুইডেনের ২৫০ বছর টিকে থাকার মতো গ্যাস আছে। অন্যান্য দেশেও সমৃদ্ধ মজুদ রয়েছে। কিন্তু সমস্যা কোথায়? এগুলো নিষ্কাশন করতে হাইড্রোলিক ফ্র্যাকিংয়ের প্রয়োজন হবে।
আমেরিকা ফ্র্যাকিংয়ের ক্ষেত্রে বিপ্লবসাধন করেছে। মাত্র অর্ধযুগের মধ্যে এটি আমেরিকাকে বিশ্বের প্রধান গ্যাস উৎপাদনকারীতে পরিণত করেছে। কিন্তু ফ্র্যাকিং বিপ্লব পোল্যান্ড বা ব্রিটেন বাদে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলিকে তেমন প্রভাবিত করতে পারেনি।
আমেরিকার ফ্র্যাকিংয়ের দ্বারা ব্যাপকভাবে লাভবানের প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু ইউরোপের কঠোর পরিবেশবাদী নীতি ও নিম্বিজমের কারণে এ মহাদেশে ফ্র্যাকিং নিষিদ্ধ। এ ছাড়া রাশিয়াও ফ্র্যাকিংবিরোধী আন্দোলনে অর্থ ঢালে। ন্যাটো মহাসচিত অ্যান্ডার্স ফগ রাসমুসেন বলেন, “রাশিয়া চায় ইউরোপ তার থেকে আমদানিকৃত গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল থাকুক।” কিন্তু ইউরোপের এখন ফ্র্যাকিংকে আঁকড়ে ধরা ছাড়া গতি নেই। এটি জ্বালানির দাম কমাবে, কার্বন নিঃসরণ কমবে, যেহেতু প্রাকৃতিক গ্যাস কয়লার চেয়ে অধিক পরিবেশবান্ধব। তা ছাড়া, ইউরোপও জ্বালানি খাতে আত্মনির্ভরশীল হবে। শেল গ্যাস রাশিয়ার জ্বালানিকেন্দ্রিক শোষণের বিরুদ্ধে একটি গুরুতর বাধা।
এমন পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা ইউরোপে গড়ে উঠছে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি ২০১৪ সালের একটি প্রতিবেদনে সতর্ক করে যে, ইউরোপকে তার জ্বালানি সরবরাহে বৈচিত্র্য আনতে হবে, বিশেষ করে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্ষেত্রে (LNG)। যদিও আমেরিকান এলএনজি সরবরাহ এশিয়ার বাজারেই অনেকটা চলে যাচ্ছে। ফলে ইউরোপের জন্য তা পর্যাপ্ত হবে না। এজেন্সিটি ইউরোপকে শেল গ্যাসের দিকে নজর দেওয়ার এবং আমেরিকার অভিজ্ঞতা থেকে শেখার আহ্বান জানিয়েছে। তাদের কাছে ফ্র্যাকিংয়ের পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে তথ্য আছে। এজেন্সিটির মতে, “ইউরোপীয় ইউনিয়নের তাদের জ্বালানিশক্তির বিকল্প কমানো অনুচিত। তাদের নিউক্লিয়ার, কয়লা, অপ্রচলিত গ্যাস ও তেল – সবগুলোকেই ব্যবহার করতে হবে।
-
Putin’s Master Plan: To Destroy Europe, Divide NATO, and Restore Russian Power and Global Influence – থেকে অনূদিত।