শিক্ষার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য কী? কোন শিক্ষা কোন বয়সে দিতে হবে? শিক্ষার মাধ্যম কী হবে? একটি দেশের স্থপতি অর্থাৎ সরকার যারা চালায় তাদের এই প্রশ্নগুলোর সুস্পষ্ট উত্তর জানা থাকতে হবে শিক্ষার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। তবে তাদের এটাও বোঝার ক্ষমতা থাকতে হবে যে একটি দেশ এখন আর কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ না। গোটা পৃথিবীই এখন একটি স্মল-ওয়ার্ল্ড নেটওয়ার্ক। তাই সব প্রশ্নের উত্তর হতে হবে গ্লোবাল পার্সপেক্টিভ থেকে এবং একই সঙ্গে আমাদের দেশের বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে। শিশু বয়সেই শিক্ষাটা শুরু হয়। আর সেই শিক্ষা ভাষা দিয়ে মায়ের হাত ধরে শিক্ষার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। এজন্য সেই ভাষাকে আমরা মাতৃভাষা বলি। মা শিশুর সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলে ভাবের আদান-প্রদান করে শিশু সে ভাষাতেই চিন্তা করে। সেই ভাষার প্রতিটি শব্দের একটি ছবি শিশুর মানসপটে তৈরি হয়ে যায়।
বিবর্তনের মাধ্যমে শিশুর ব্রেইন এমনভাবে তৈরি হয় যে আমরা জেনে গেছি ওই বয়সেই ভাষা শিক্ষার শ্রেষ্ঠ সময় শিক্ষার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। ওই বয়সেই উচ্চারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ জিহ্বার মোচড় শিখে। ২০ কিংবা ৩০ অথবা আরও পরে বিদেশে গিয়ে যত বছর ধরেই বসবাস করি না কেন সেই দেশের ভাষা কখনো পুরোপুরি রপ্ত করতে পারি না কারণ ওটা ভাষা শেখার বয়স না। ওই বয়সে শব্দের পেছনের ছবি আমাদের মানসপটে তৈরি হয় না। ফলে ওই ভাষায় প্রথম চিন্তা আসে না। প্রথম চিন্তাটা আসে মাতৃভাষায় এবং বিদেশি ভাষাটা অনেক সময় মাতৃভাষা থেকে অনুবাদ করে বলি শিক্ষার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। ফলে ভাষার গঠনটা অনেক ক্ষেত্রেই ঠিক হয় না।
মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় শব্দের পেছনের ছবি মানসপটে আঁকা হয় না। এজন্যই গায়ক এবং গীতিকার প্রতুল মুখোপাধ্যায় লিখেছেন ‘আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলায় দেখি স্বপ্ন, আমি বাংলায় বাঁধি সুর, আমি বাংলায় ভাসি, বাংলায় হাসি, বাংলায় জেগে রই, বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার আর আমি সব দেখেশুনে খেপে গিয়ে-করি বাংলায় চিৎকার।’ এজন্যই শিক্ষার মাধ্যম হতে হবে মাতৃভাষা।
পৃথিবীতে এমন একটি দেশ খুঁজে পাওয়া যাবে না যে দেশের ছাত্রছাত্রীরা ভিন দেশের ভাষায় লেখাপড়া করে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও অর্থবিত্তে উন্নত হয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হতে পারে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, ইংল্যান্ড ছাড়া বাকি ইউরোপিয়ান দেশগুলো। চীন জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্থবিত্তে এত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে কীভাবে? এরা ইউরোপ, জাপানের উন্নতিকে গবেষণা করেছে শিক্ষার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। এরা বুঝতে পেরেছে মাতৃভাষায় শিক্ষার মাধ্যমেই দেশের মানুষকে দেশ উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে এফিসিয়েন্টভাবে প্রস্তুত করা যায়। পড়াশোনার ক্ষেত্রে এরা তাই প্রথম যেই কাজটি করেছে সেটি হলো সব পাঠ্যবই তারা ধীরে ধীরে চীনা ভাষায় প্রণয়ন করেছে। এর আগে জাপান, কোরিয়া, জার্মানি, ইতালি প্রভৃতি দেশও একই কাজ করেছে।
অথচ ভিন ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করতে এবং মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সংগ্রাম করার বিরল ইতিহাস যে জাতির আছে, যুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়ার ইতিহাস যে জাতির আছে সে জাতিতে স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও কেউ ইংরেজিতে কথা বলতে পারলে তাকে জ্ঞানী ভাবা হয় শিক্ষার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। এজন্য স্কুল-কলেজে শিক্ষার জন্য ইংরেজি মাধ্যম সবচেয়ে জনপ্রিয়। এমনকি বাংলা মাধ্যমকে ইংরেজি বানিয়ে পড়াও খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ইংল্যান্ড, কানাডা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায় তো সেলুনের নাপিতও অনেক ভালো ইংরেজি বলতে পারে যেখানে কোরিয়া, জাপান বা চীনের বড় বড় বিজ্ঞানীও হয়তো ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন না। ইংরেজি তো বাংলারই মতো আরেকটি ভাষা। পড়াশোনা সত্যিকারভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে হলে মাতৃভাষায় পড়ার কোনো বিকল্প নেই শিক্ষার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। অথচ আমরা আজ পর্যন্ত এটা শুরুই করিনি বরং আমরা উল্টো পথে হাঁটছি। আমরা ভিনদেশি ভাষা অবশ্যই শিখব কিন্তু সেটা কখনোই মাতৃভাষার বিনিময়ে নয়। আগে মাতৃভাষা। ইউনেসকোও মনে করে, শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার ব্যবহার শিক্ষার গুণগত মানের জন্য অপরিহার্য।
৫০ বছর হয়ে গেল দেশ স্বাধীন হয়েছে অথচ এখনো আমাদের নীতিনির্ধারকরা এই কথাটিই বুঝল না শিক্ষার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে গর্বের ধন সত্যেন বোস অনেক আগেই এই কথাটি বলে গেছেন। আমাদের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সদ্য প্রয়াত শিক্ষক অধ্যাপক হারুন অর রশিদ স্যারও সব সময় এই কথাটি বলেছেন। তিনি বাংলায় পদার্থবিজ্ঞানের অনেকগুলো বইও লিখেছেন। শুধু তা-ই নয়, বিদ্যাসাগর এবং রবীন্দ্রনাথও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষাকে সুপারিশ করে গেছেন।
দুঃখজনক কি জানেন? আমাদের একটা নতুন শিক্ষাক্রম তৈরি হচ্ছে, যা ২০২৪ সাল থেকে চালু হবে। নতুন সেই শিক্ষাক্রমে পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, রসায়ন ও উচ্চতর গণিতকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে কী হবে? ইংরেজি মাধ্যম আরও জনপ্রিয় হবে। যাদের টাকা আছে তারা আর তাদের সন্তানদের বাংলামাধ্যমে পড়াবে না শিক্ষার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। এর ফলে সমাজে ধনী-গরিবের বৈষম্য আরও চরমে উঠবে। এখন যেমন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কেবল গরিবরা পড়ে, তখন পুরো বাংলা মাধ্যম হবে কেবল গরিবদের জন্য। দেশে ইংরেজি মাধ্যম এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েরই জয়জয়কারের দিন আসছে সামনে, যার মাধ্যমে সমাজে ধনী-গরিবের বৈষম্য প্রকট থেকে প্রকটতর হবে।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন, কুদরত-এ-খুদা কমিশন তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থার সাধারণ, মাদ্রাসা ও ইংরেজি বিলোপ করে এক ধারার শিক্ষার প্রস্তাব করেছিল। তার পেছনে জোরালো যুক্তি আছে। যুক্তিটা হলো, দেশের মধ্যে একই সমাজে এক ধরনের নাগরিক তৈরির প্রয়াস। আর আমরা এখন কী করছি? ধনী-গরিবের বিভাজন, সুযোগ-সুবিধার বিভাজন আরও প্রকট করছি। একটি ক্লাস কেবল কামলা হবে আর অন্য আরেকটি ক্লাস কেবল চুষে খাবে।
বাংলাদেশের শিক্ষানীতি কারা প্রণয়ন করেন তা আমার কাছে এক অপার বিস্ময়ের ব্যাপার। জিপিএ সিস্টেম চালুর আগে এসএসসি ও এইচএসসির কারিকুলাম কি খুব খারাপ ছিল? আমার মতে বেশ ভালো ছিল। তখন কিংবা এখন যা করা উচিত তা হলো শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানো এবং ভালো শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া। সমস্যা আমাদের শিক্ষকদের মানে। সেই দিকে না গিয়ে আমরা জিপিএ সিস্টেম চালু করলাম শিক্ষার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। আর জিপিএর বন্যা বইয়ে দিলাম। এর মাধ্যমে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের সময় এইচএসসিতে ৩৫-৪০ শতাংশ পাস করত গড়ে প্রতিটা বোর্ড থেকে আর স্টার মার্কস পেত ২-৫ শতাংশ। আর এখন জিপিএ ফাইভ শুরুতে ২০০১-এ পেয়েছিল ৭৫ জন আর এখন পায় লাখের বেশি শিক্ষার্থী। তাতে কি শিক্ষার মান বৃদ্ধি পেয়েছে? এই বৃদ্ধির কোনো প্রতিফলন কি সমাজে আছে? দেশের শিক্ষানীতির সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে অভিন্ন সিলেবাস। নাম শুনে যতই সুন্দর মনে হোক না কেন এটি হবে শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের মূল হাতিয়ার। এই শিক্ষানীতিতে বিজ্ঞানের বর্তমান সিলেবাস কমিয়ে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ করে দেওয়া হবে।
আর উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা আরও বেশি জরুরি। কারণ উচ্চশিক্ষায় বিষয় এবং এর ব্যাপ্তি আরও কঠিন। সেখানে বিদেশি ভাষা ওই কঠিনেরে আরও কঠিন করে তোলে। তখন শিক্ষার্থীরা বিষয় শিখবে না ভাষা বুঝবে? বিদেশি ভাষার কারণে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও অনেক কিছুই হৃদয়ঙ্গম করা কঠিন। এতে করে একসময় অনেক শিক্ষার্থীর আগ্রহটাই হারিয়ে যায়। আমি যখন পদার্থবিজ্ঞানে প্রথমবর্ষে পড়ি তখন যেটা পড়তে এক ঘণ্টা লাগার কথা ভাষার কারণে সেটা লাগত আরও অনেক বেশি। আবার অনেক বেশি সময় দিয়েও খুব ভালো বুঝতাম এমনটা অনেক পরে ঘটেছে। শিক্ষার মাধ্যম বাংলা হলে অনেক কম প্রচেষ্টায় অনেক বেশি কিছু আত্মস্থ করা সম্ভব হতো। তবে অনুবাদের ভাষা সহজ এবং প্রাঞ্জল হওয়াটা খুবই জরুরি। তবে সেটা তো আসবে বিবর্তনের মাধ্যমে। প্রথম চেষ্টাতেই সবকিছু সুন্দর এবং প্রাঞ্জল নাও হতে পারে। কিন্তু চেষ্টা জারি রাখতে হবে। কারণ উন্নত এবং উদ্ভাবনী রাষ্ট্র হতে চাইলে এর কোনো বিকল্প নেই।
আমার স্ত্রী ইতালিয়ান। তার সঙ্গে এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করলে সে আমার সঙ্গে এ বিষয়ে শতভাগ একমত পোষণ করে। কারণ সে ভাষার শিক্ষার্থী, তাই ভাষার গুরুত্ব বোঝে। আমার বড় মেয়ের জন্মের আগেই আমাকে বলে দিয়েছে আমি যেন কখনো আমার সন্তানের সঙ্গে বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় কথা না বলি। সেও কখনো ইতালিয়ান ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় কথা বলেনি। ফলে সে দুটো ভাষা জন্মগতভাবেই পেয়ে গেছে। আমার স্ত্রী বলে সে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে একাধিক ভাষা শিখেছে আর আমাদের মেয়ে এমনি এমনি দুটো ভাষা শিখে গেছে। আর তৃতীয় ভাষা সে স্কুলের কারণে পড়াশোনা করে শিখেছে। মাঝেমধ্যেই আমার স্ত্রী আক্ষেপ করে বলে দুজন বাংলাদেশি একসঙ্গে হলে তারা কেন ইংরেজিতে বা আধা ইংরেজি আধা বাংলায় কথা বলে? আজ থেকে ২০ বছর আগে প্রথম বাংলাদেশে আসে, তখন থেকেই তার এই প্রশ্ন। পৃথিবীতে এমন আরেকটি দেশ পাওয়া যাবে না যেখানে নিজ দেশে বসে নিজ দেশের মানুষের সঙ্গে ভিনদেশি ভাষায় কথা বলে। দুজন ইতালিয়ান একসঙ্গে বসে ইংরেজি ভাষায় কথা বলছে এটা অকল্পনীয়। আমরা ইংরেজি বলি কারণ ইংরেজিকে আমরা জ্ঞান প্রকাশের মাধ্যম মনে করি। আমাদের মানসপটে গেঁথে আছে যে যত ভালো ইংরেজি বলতে পারে সে তত জ্ঞানী। আমি লন্ডনে থাকা অবস্থায় দুজন পাকিস্তানি একসঙ্গে হলে কখনো তাদের ইংরেজিতে কথা বলতে দেখিনি।
ইউরোপ, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবপেজগুলো একটু ঘুরে দেখুন। প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবপেজ তাদের নিজ ভাষা এবং ইংরেজি দুটোতেই আছে। যার যেটা পছন্দ সেটা ক্লিক করে পড়ছে শিক্ষার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। বাংলাদেশের এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় পাবেন না যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবপেজ বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষাতেই আছে। অথচ আমাদের একটা ভাষা শহীদ দিবস আছে। সেই দিবসটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কি দুর্ভাগ্য আমাদের যে, আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এখনো মাতৃভাষায় করতে পারলাম না। তার চেয়ে দুর্ভাগ্যের হলো উল্টো আমরা বাংলা মাধ্যমকে ইংরেজি বানিয়ে সেটার নাম দিয়েছি ভার্সন। সত্যিই কি সেলুকাস!
লেখক : অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দেশ রূপান্তর পত্রিকার বিশেষ ক্রোড়পত্রে মাতৃভাষায় শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে আমার লেখা।