হাসান আজিজুল হককে তাঁরা পর্দায় এনেছেন

হাসান আজিজুল হককে শেষশ্রদ্ধা জানাতে আরও অনেকের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা থেকে রাজশাহী ছুটি গিয়েছিলেন দুই নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিম ও আকরাম খান। দুজনই এই কথাসাহিত্যিকের গুণমুগ্ধ ভক্ত। প্রিয় হাসান স্যারের গল্পে বাংলাদেশ সরকারের অনুদানে ২০১৭ সালে আকরাম খান নির্মাণ করেছিলেন পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র খাঁচা। যাতে অভিনয় করেছেন আজাদ আবুল কালাম ও জয়া আহসান। পরে বিটিভির জন্য বানিয়েছিলেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উত্তর বসন্ত। আর গল্পকারের ‘বিধবাদের কথা’ গল্প অবলম্বনে গত বছর শেষ করেছেন পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নকশিকাঁথার জমিন–এর শুটিং। এটিও অনুদানের ছবি। এতে অভিনয় করেছেন জয়া আহসান, ইরেশ যাকের। অন্যদিকে গিয়াস উদ্দিন সেলিম ‘গুনিন’ গল্প থেকে সম্প্রতি শেষ করেছেন একই নামের একটি সিনেমা, যাতে অভিনয় করেছেন পরীমনি, শরিফুল রাজ। ছবিটি প্রযোজনা করছে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চরকি।
গিয়াস উদ্দিন সেলিম জানালেন, তারুণ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহে ভালো মানুষ হয়ে ওঠার যে চেষ্টা ও চর্চা তিনি করেছিলেন, এর পেছনে যেসব মানুষের অবদান ছিল, তাঁদের অন্যতম হাসান আজিজুল হক। তিনি বলেন, ‘স্যার ছিলেন দর্শনের শিক্ষক, আমি বিপণনের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে একবার তাঁর বক্তৃতা শুনে থমকে যাই।

একটা মানুষ কত সুন্দর করে যুক্তিপূর্ণ সব কাজের কথা বলে যাচ্ছিলেন। পরে ধীরে ধীরে তাঁকে জানলাম, তাঁর সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হলাম। পরিণত বয়সে তাঁর গল্প পড়তে গিয়ে ধাক্কা খেলাম। মনে হলো, পৃথিবীর যেকোনো ভাষার মাস্টার রাইটারদের একজন তিনি।’ গুনিন’ গল্পটি নিয়ে সিনেমা বানানো হবে, শুনে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন হাসান আজিজুল হক। প্রথমবার তাঁর গল্প থেকে সিনেমা বানানো প্রসঙ্গে গিয়াস উদ্দিন সেলিম বলেন, ‘“গুনিন” পড়ে আমার স্ট্রাইকিং লেগেছে। তাঁর বেশির ভাগ গল্পের পটভূমি রাঢ় বাংলা। আর “গুনিন” আমাদের ডেল্টা অঞ্চলের। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গল্পটা কানেক্ট করতে পেরেছি। এ কারণেই ছবির জন্য গল্পটি বেছে নেওয়া। যদিও এটা একটা ছোটগল্প, কিন্তু এর ভেতরে একটা ফিচার ফিল্মের সম্ভাবনা লুকিয়ে ছিল। স্যার আমাকে স্নেহ করতেন। তাঁর গল্পে ছবি বানাব শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন।’

হাসান আজিজুল হককে গুরুবৎ শ্রদ্ধা করতেন নির্মাতা আকরাম খান। দুঃখ করে বললেন, ‘শুটিং শেষ, অথচ নকশিকাঁথার জমিন স্যারকে দেখানো হলো না। খাঁচা বানানোর পর মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার আগে স্যারকে দেখিয়েছিলাম। দেখে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। বলছিলেন, “আমি তো দেশভাগের ওই সময়ে ফিরে গিয়েছিলাম।” প্রান্তিক মানুষের ভেতরটা দেখতে পেতেন স্যার। গল্পে সেটা তিনি দেখাতেও পারতেন চমৎকার। তাঁর সঙ্গে ১০টি বছর এমনভাবে মেশার সুযোগ পেয়েছি, এটা আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সঞ্চয়। এই মানুষটির সঙ্গে অল্প কিছু সময় আড্ডা দিলেও অনেক কিছু শেখা যেত।’ হাসান আজিজুল হকের গল্প থেকে রাজীব আহসান নির্মাণ শেষ করেছেন নামহীন গোত্রহীন। ছবিটি শিগগিরই মুক্তি পাবে। তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন প্রকল্পের অংশ হিসেবেও হাসান আজিজুল হকের ‘সাক্ষাৎকার’ গল্পটি নিয়ে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য বানিয়েছিলেন তিনি। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ প্রয়াত মোহাম্মদ খসরু অনেক দিন ধরে হাসান আজিজুল হকের একটি গল্প থেকে সিনেমা বানানোর স্বপ্ন বুনেছিলেন।

হাসান আজিজুল হকের গল্প থেকে ছবি নির্মাণ প্রসঙ্গে আকরাম খান বলেন, ‘স্যারের গল্পে ছবি বানাতে হলে সাহিত্য ও ভূখণ্ডটাকে বুঝতে হবে। মানুষের বেদনা উপলব্ধি করতে হবে। সিরিয়াস সাহিত্যপাঠ যেমন কমে গেছে, তেমনি কমেছে এ রকম সাহিত্য থেকে ছবি বানানো। ধরা যাক দেশভাগের যন্ত্রণা যদি কেউ হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে না পারে, তাহলে “খাঁচা” গল্প থেকে সিনেমা বানালে সেটা হবে একটা বাজে সিনেমা।’ গিয়াস উদ্দিন সেলিম বলেন, ‘হাসান স্যার যা লিখে গেছেন, অসাম্প্রদায়িক মতাদর্শ, দেশ বিভাগের যন্ত্রণা, মুক্তিযুদ্ধ—এসবের চর্চা করলে জাতি উপকৃত হবে। হাজার বছর টিকে থাকবে তাঁর সাহিত্য। আমি মননশীল অনেক তরুণ নির্মাতাকে চিনি, যারা হাসান স্যারের মতো ভালো সাহিত্য নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী।’

Leave a Comment