মুনাফিকদের জন্য ইবাদত করা খুব কঠিন

ইসলামে নামাজ এক পবিত্র অনুশীলন যা একজন বিশ্বাসী এবং তাদের সৃষ্টিকর্তার মধ্যে সরাসরি সংযোগ হিসাবে কাজ করে। এটি বিশ্বাসের একটি স্তম্ভ, আধ্যাত্মিকতার উৎস এবং নির্দেশনা ও ক্ষমা চাওয়ার একটি মাধ্যম। তবুও, এর গভীর তাৎপর্য থাকা সত্ত্বেও, এমন কিছু ব্যক্তি আছেন যারা স্রষ্টার সাথে সঠিকভাবে কথা বলতে পারে না, সম্পর্ক তৈরী করতে পারে না। নফসের সাথে সংগ্রামের মুখোমুখি হয়। ইসলামী শিক্ষায়, এই ধরনের ব্যক্তিদের “মুনাফিক”  বলা হয়।

তার এই রোগের জন্য তার অন্তরে বাসা বাঁধা সংশয়বাদই দায়ী। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَ اسۡتَعِیۡنُوۡا بِالصَّبۡرِ وَ الصَّلٰوۃِ ؕ وَ اِنَّهَا لَکَبِیۡرَۃٌ اِلَّا عَلَی الۡخٰشِعِیۡنَ ﴿ۙ۴۵﴾ الَّذِیۡنَ یَظُنُّوۡنَ اَنَّهُمۡ مُّلٰقُوۡا رَبِّهِمۡ وَ اَنَّهُمۡ اِلَیۡهِ رٰجِعُوۡنَ ﴿۴۶﴾

তোমরা ধৈর্য্য ও সলাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর, আর তা আল্লাহভীরু ব্যক্তিবর্গ ছাড়া অন্য সকলের কাছে নিশ্চিতভাবে কঠিন। যারা নিশ্চিত বিশ্বাস করে যে, তাদের প্রতিপালকের সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ ঘটবেই এবং তাঁরই দিকে তারা ফিরে যাবে। [সুরা বাকারাঃ ৪৫-৪৬]

আল্লামা শানকীতী বলেন, ধৈৰ্য্যের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করা সুস্পষ্ট বিষয়। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলে এক সময় তার উপর আল্লাহর রহমত নাযিল হবে এবং সে সফলকাম হবে। কিন্তু সালাতের মাধ্যমে কিভাবে সাহায্য প্রার্থনা করবে? এর উত্তর হচ্ছে, সালাতের মাধ্যমে অন্যায় অশ্লিল কাজ থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয় সালাত অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে দূরে রাখে। [সূরা আল-আনকাবুত: ৪৫] এটা নিশ্চয় এক বিরাট সাহায্য।

তাছাড়া সালাতের মাধ্যমে রিযকের মধ্যে প্রশস্তি আসে। আল্লাহ বলেন, “আর আপনার পরিবারবর্গকে সালাতের আদেশ দিন ও তাতে অবিচল থাকুন, আমরা আপনার কাছে কোন জীবনোপকরণ চাই না; আমরাই আপনাকে জীবনোপকরণ দেই এবং শুভ পরিণাম তো তাকওয়াতেই নিহিত [সূরা ত্বা-হা: ১৩২] আর এ জন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোন বিষয়ে সমস্যায় পড়তেন বা চিন্তাগ্রস্ত হতেন তখনই তিনি সালাতে দাঁড়িয়ে যেতেন”। [মুসনাদে আহমাদ: ৫/৩৮৮]

সুতরাং যে কোন বিপদাপদে ও সমস্যায় সালাতে দাঁড়িয়ে আল্লাহর সাথে সম্পর্কটা তাজা করে নেয়ার মাধ্যমে সাহায্য লাভ করা যেতে পারে। সালফে সালেহীন তথা সাহাবা, তাবেয়ীন ও সত্যনিষ্ঠ ইমামগণ থেকে এ ব্যাপারে বহু ঘটনা বর্ণিত আছে। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমার নিকট তার ভাই ‘কুছাম’ এর মৃত্যুর খবর পৌছল, তিনি তখন সফর অবস্থায় ছিলেন। তিনি তার বাহন থেকে নেমে দু রাকাআত সালাত আদায় করেন এবং এ আয়াত তেলাওয়াত করলেন। আবার অনুরূপভাবে আবদুর রহমান ইবনে আউফ রাদিয়াল্লাহু আনহু অসুস্থ অবস্থায় পড়লে একবার এমনভাবে বেহুশ হয়ে যান যে সবাই ধারণা করে বসেছিল যে, তিনি বুঝি মারাই গেছেন। তখন তার স্ত্রী উম্মে কুলসুম মসজিদে গিয়ে আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে সবর ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করলেন। [মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/২৬৯]

এটা তো পরিষ্কার কথা যে, যে ব্যক্তি কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার সাথে সাক্ষাৎ এবং নামাজ ইত্যাদি ইবাদাতের জন্য কষ্ট ও মুজাহাদার প্রতিদান লাভের কথা বিশ্বাস করে তার জন্য ইবাদাত করা মোটেও কঠিন কিছু নয়। উল্লেখিত আয়াতে ‘ধারণা করে’ অর্থ দৃঢ় বিশ্বাস রাখে। আর মুনাফিকের অন্তরে দীনের কোনো বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাস থাকে না।

মুনাফিকমাত্রই কিয়ামতের দিনের ব্যাপারে হয় সংশয়ে ভোগে অথবা অবিশ্বাস করে বসে থাকে। এ কারণেই নামাজের মতো ইবাদাত তার পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই সে নামাজের সময় নিয়ে গড়িমসি করে। নামাজ শুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলির পরোয়া করে না। নামাজ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস না থাকায় দুনিয়ার সকল চিন্তাভাবনা ঝেড়ে ফেলে একাগ্রচিত্তে নামাজ পড়তে পারে না। রাসূল বলেছেন,

إِنَّ أَثْقَلَ صَلاَةٍ عَلَى الْمُنَافِقِينَ صَلاَةُ الْعِشَاءِ وَصَلاَةُ الْفَجْرِ وَلَوْ يَعْلَمُونَ مَا فِيهِمَا لأَتَوْهُمَا وَلَوْ حَبْوًا وَلَقَدْ هَمَمْتُ أَنْ آمُرَ بِالصَّلاَةِ فَتُقَامَ ثُمَّ آمُرَ رَجُلاً فَيُصَلِّيَ بِالنَّاسِ ثُمَّ أَنْطَلِقَ مَعِي بِرِجَالٍ مَعَهُمْ حُزَمٌ مِنْ حَطَبٍ إِلَى قَوْمٍ لاَ يَشْهَدُونَ الصَّلاَةَ فَأُحَرِّقَ عَلَيْهِمْ بُيُوتَهُمْ بِالنَّارِ

“মুনাফিকদের জন্য সবচাইতে ভারী সালাত হলো ঈশা ও ফজরের সালাত। তারা যদি এই দুই সালাতে কী মর্যাদা আছে জানতে পারত; তবে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও এ দুই সালাতে উপস্থিত হতো। আমি মনস্থ করেছিলাম যে, আমি সালাত সম্পর্কে আদেশ করি যে, ইকামত দেওয়া হোক। এরপর একজনকে নির্দেশ করি যে, সে লোকদের নিয়ে সালাত কায়েম করুক। তারপর আমি লাকড়ির বোঝাসহ একদল লোক নিয়ে সেই সব লোকের ঘরে চলে যাই যারা সালাতে উপস্থিত হয় না। অতঃপর তাদের ঘর আগুন দিয়ে তাদের সহ জ্বালিয়ে দিই।” [সহিহ মুসলিমঃ ৬৫১]

ঈশা ও ফজরের নামাজে জামাআতে হাজির হওয়া মুনাফিকদের জন্য কষ্টকর কেন? কারণ, এই দুই ওয়াক্ত নামাজের উপস্থিতি সাধারণত আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অন্য কারও নজরে পড়ে না। মুনাফিকের দল অন্যান্য নামাজের সময় মুমিনদের পাশে থেকে বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে আত্মরক্ষা করে। তা ছাড়া অন্যান্য নামাজের সময় বরাবরই তারা জাগ্রত থাকে। তাই জামাআতে শরীক হতেও তেমন বেগ পেতে হয় না। যদি তারা আখিরাত, জান্নাত ও জাহান্নাম ইত্যাদি পরকালীন বিষয়ে বিশ্বাস রাখত, তবে কোনো কিছুই তাদের নামাজ ও ইবাদাতকে নষ্ট করতে পারত না। কিন্তু তাদের তো এসবে তেমন বিশ্বাস নেই। আর ঈশা ও ফজরের নামাজের সময় দুটিও রাতের আঁধারে ঢাকা। সরলমনা মুমিনগণ সাধারণত কে এল কে এল না তা নিয়ে মাথাও ঘামায় না। তা ছাড়া উভয় নামাজের সময়ই ঘুমের সময়। মুনাফিকের কাছে এক ঘণ্টার ঘুম “আসমান-জমিন বিস্তৃত জান্নাতের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ! জান্নাত তার কাছে অলীক কল্পনার বস্তু। এর প্রতি তার এতটুকু বিশ্বাস জন্মেনি যে এর জন্য কষ্ট স্বীকার করবে। অদৃশ্য ও সংশয়পূর্ণ বস্তুর জন্য বেগার খাটার চেয়েও সুন্দর স্বপ্নময় নিদ্রা তার কাছে অনেক প্রিয়।

হাদীসে বলা হয়েছে “তারা যদি জানত এই দুই নামাজে কী (বিনিময়) আছে?” অর্থাৎ তারা যদি চিরস্থায়ী পরকাল ও উত্তম বিনিময়ের বিশ্বাস রাখত; তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও ফজর ও ঈশার জামাআতে হাজির হতো। যেমনটা নিজের দুনিয়ার ব্যাপারে করে থাকে। দুনিয়ার সামান্য বিষয়েও তারা শুধু হাত-পায়ে ভর দিয়ে হামাগুড়ি নয়, বরং এরচেয়ে নিচে নামতেও দ্বিধা করে না।

আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেন, রাসূল বলেছেন,

وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَقَدْ هَمَمْتُ أَنْ آمُرَ بِحَطَبٍ فَيُحْطَبَ ثُمَّ آمُرَ بِالصَّلاَةِ فَيُؤَذَّنَ لَهَا ثُمَّ آمُرَ رَجُلاً فَيَؤُمَّ النَّاسَ ثُمَّ أُخَالِفَ إِلَى رِجَالٍ فَأُحَرِّقَ عَلَيْهِمْ بُيُوتَهُمْ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوْ يَعْلَمُ أَحَدُهُمْ أَنَّهُ يَجِدُ عَرْقًا سَمِينًا أَوْ مِرْمَاتَيْنِ حَسَنَتَيْنِ لَشَهِدَ الْعِشَاءَ

যার হাতে আমার প্রাণ, তাঁর শপথ! আমার ইচ্ছা হয়, জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে আদেশ দিই, অতঃপর সালাত কায়েমের আদেশ দিই, অতঃপর সালাতের আযান দেয়া হোক, অতঃপর এক ব্যক্তিকে লোকদের ইমামত করার নির্দেশ দিই। অতঃপর আমি লোকদের নিকট যাই এবং তাদের (যারা জামাআতে শামিল হয়নি) ঘর জ্বালিয়ে দিই। যে মহান সত্তার হাতে আমার প্রাণ, তাঁর কসম! যদি তাদের কেউ জানত যে, একটি গোশতহীন মোটা হাড় বা ছাগলের ভালো দুটি পা পাবে, তাহলে অবশ্যই সে ‘ঈশা’র নামাজের জামাআতেও হাজির হতো। [সহিহ বুখারিঃ ৬৪৪]

হাদীসে স্পষ্ট বলে দেয়া হলো যে, ঈশার জামাআতে হাজির হওয়ার বিনিময়ে গোশতহীন মোটা হাড় বা ছাগলের ভালো দুটি পা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও মুনাফিক ছুটে এসে ঈশার জামাআতে হাজির হতো। আর জান্নাত তো “আসমান- জমিন বিস্তৃত”। বরং এর চেয়েও বহুগুণ বড়। অথচ মুনাফিকের কাছে জান্নাত এক টুকরো গোশতের মূল্যও রাখে না!

*ড. ইয়াদ কুনাইবি হাফি. রচিত “নিফাক থেকে বাঁচুন” অবলম্বনে

Leave a Comment