যেভাবে সৃষ্টি হলো পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের

জিন্নাহ, ইকবালের মতো মানুষেরা বুঝতে পেরেছিলেন যে যদি মুসলিম ও হিন্দু দুটো আলাদা রাষ্ট্র না করা হয় তাহলে উভয়ের মধ্যে সমস্যা ঘটবেই। এ জন্যই তারা দুটো ভিন্ন রাষ্ট্রের জন্য আন্দোলন করা শুরু করেন। তাদের কথা ছিল, আমরা কখনোই একত্রিত বা এক রাষ্ট্র হয়ে চলতে পারব না। নিঃসন্দেহে কিছু আন্তরিক লোক কংগ্রেসে ছিল। তাদের কারো কারো উত্তম উদ্দেশ্যও ছিল যেমন গান্ধী। আমি মনে করি, তার অধিকাংশ কাজই ভাল ছিল। যদিও তার সব কাজের সাথে আমরা একমত নই। তবে তার উদ্দেশ্য ভাল ছিল। তিনি ঐক্যবদ্ধ ভারত চেয়েছিলেন। একটা উত্তম ভারত যেখানে থাকবে মুসলিম, হিন্দু, শিখ সবাই।

কিন্তু গান্ধী ছিলেন আদর্শবাদী, বাস্তববাদী নয়। তিনি বাস্তবতাকে এড়িয়ে চলছিলেন। সেসময় নানা জায়গায় বিশৃঙ্খলা বাধছিল। তিনি অনশনেও গেছিলেন। কারণ, হিন্দুরা মুসলিমদের হত্যা করছিল, মুসলিমরা হিন্দুদের। আমরা কীভাবে এই অবস্থানে পৌঁছালাম তা একটা ভালো প্রশ্ন। ব্রিটিশ রাজের এর পেছনে ব্যাপক ভূমিকা ছিল। তারা ডিভাইড এন্ড রুল কৌশল এখানে খাটিয়েছিল। এটা সবসময় তাদের পক্ষে কাজ করেছিল। আমার বিশ্বাস, যদি দুটো বিশ্বযুদ্ধ না হতো তাহলে হয়তো এখনও ভারতকে ব্রিটিশরা শাসন করত। তাহলে কোন জিনিসটা পরিবর্তন আনল? প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধই সবকিছু বদলে দেয়। আর ব্রিটিশরাও ভারতীয়দের কাছ থেকে প্রচুর কর আদায় করছিল। ব্রিটেন থেকে ভারতে সংযোগকারি যে রেইলওয়ে ছিল গুরত্বপূর্ণ মালামাল আদানপ্রদানের জন্য, সেটা ভারতীয়দের সুবিধার জন্য করা হয়নি। কারণ, ১৯৪৭ সালে ভারতে যখন ব্রিটিশ শাসনের সমাপ্তি ঘটে তখন ভারতীয়রা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠী। ৯০ শতাংশ ভারতীয়ই দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল। তাহলে কীভাবে সেই রেইলওয়ে লাইন ভারতীয়দের উপকৃত করেছিল?

এক কথায় উত্তর হচ্ছে – করেনি। এটি মূলত ছিল পরিকল্পিত চুরি। ভারতে ব্রিটিশ শাসন সরকারী পর্যায়ে পরিকল্পিতভাবে অপরাধ করছিল। সরকারই ছিল মূল কালপ্রিট। আমি এখানে রাণী ভিক্টোরিয়াকে দায়ী করছি না। তবে তার শাসনকে দায়ী করছি। শাসনভারপ্রাপ্ত লোকগুলো যা করেছে তার দায়ভার সেই লোকদের। তারা বর্ণবাদী, ধর্মান্ধ, শ্রেষ্ঠত্ববাদী ইত্যাদি। তাদের অনেকেই ছিল শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী। তার মধ্যে উইনস্টন চার্চিলও ছিল।

ভিক্টোরিয়া নিজে ছিলেন অতি দয়ালু নারী, উত্তম নারী। তার সাম্রাজ্যে কি ঘটছে সে ব্যাপারে অধিকাংশ সময়েই তার কোনো ধারণা থাকত না। তিনি জানতেন না তার লোকেরা, তার প্রশাসকরা ভারত, আফ্রিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় আদিবাসীদের সাথে কি করছে। তবে তিনি দয়ালু ছিলেন। রাণী ভিক্টোরিয়া ও তার এক মুসলিম দাসের ব্যাপারে একটি মর্মস্পর্শী গল্প প্রচলিত আছে। তিনি তাকে নিজের পালক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। তার নাম ছিল আবদুল কারিম। আপনার “Victoria and Abdul” নামের বইটি পড়া উচিত। এর ওপর একটি সিনেমাও বানানো হয়েছে। অর্থাৎ এটি একটি সত্য গল্প হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ববাসীর কাছ থেকে এটি লুকিয়ে রাখা হয়েছে প্রায় শতবর্ষ ধরে। এই বইটি প্রকাশ হওয়ার আগে কয়জন ভিক্টোরিয়া ও আবদুলের ব্যাপারে জানত? এমনকি আমি নিজেও জানতাম না। আমি নিজেকে ইতিহাসের সিরিয়াস ছাত্র হিসেবে বিবেচনা করি। আমার নিজেরও কোনো আইডিয়া ছিল না কারিমের ব্যাপারে।

ভিক্টোরিয়া আবদুল কারিমের কাছ থেকে উরদু শিখছিলেন। কারিম ভিক্টোরিয়ার ব্যাক্তিগত ডায়েরিতে উরদু লেখাও শেখাচ্ছিলেন। তিনি তার এতটা নৈকট্য অর্জন করেছিলেন যে তিনি ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুশ্যায়ও উপস্থিত ছিলেন। তিনি ছিলেন তার পুত্রের মতো। আমি জানি না তিনি রাণীর প্রতি কতটা আন্তরিক ছিলেন। সে অসুস্থ হয়ে পড়লে রাণী নিজে তার সাথে দেখা করতে যেতেন। এতে রাণীর পরিবার হিংসুক হয়ে পড়ে। সে সময় রাজপরিবারে কিছু বর্ণবাদী, ধর্মান্ধ ছিল। এর মধ্যে ভিক্টোরিয়ার পুত্র ও ভবিষ্যত রারা এডওয়ার্ডও ছিল।

তারা সবাই হিংসা করতে থাকে যে, কেন এই ভারতীয় লোকটি রাণী ভিক্টোরিয়ার এত নিকটে? আর সে তো মুসলিম। রাণীর সাথে তার এত খাতির কেন? তাই রাণী ভিক্টোরিয়া মারা গেলে তাকে জোর করে তার ঘর থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তাকে ভারতে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। রাণীর সাথে তার সম্পর্ক ও যোগাযোগের বিষয় ও রেকর্ডগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়। যেটুকু বাদ পড়েছিল সেগুলোও গোপন রাখা হয়। লেখক সেই তথ্যগুলো সংগ্রহ করতে সক্ষম হন এবং “Victoria and Abdul” গ্রন্থটি রচনা করেন।

তো ভিক্টোরিয়া খুব দয়ালু নারী ছিলেন। তিনি ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের নৃশংসতা বন্ধ করেন। তাই তাকে দোষ দেওয়া যায় না। বরং যে বর্ণবাদী ভাইসরয়, যে জেনারেল ও প্রশাসকরা এই কাজ চালাচ্ছিল মূল দোষ তাদের। তারা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী ছিল, ভারতীয়দের প্রতি কোনো সম্মান ছিল না তাদের। এই জন্য যারা এই নির্যাতন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত তীব্র।

আপনি জানেন কেন গান্ধী গান্ধী হতে পেরেছিলেন? তিনি ছিলেন অ্যাটর্নি এট ল। তিনি ব্রিটেনে পড়াশোনা করেছেন। তিনি এরপর সাউথ আফ্রিকায় যান। সেখানে গিয়ে তিনি এমন এক ট্রেনে বসেন যেখানে কেবল শ্বেতাঙ্গরাই বসতে পারত। তাই কন্ডাকটর এসে তাকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি এখানে কি করছ? তুমি তো ভারতীয়। তুমি সাদাদের জায়গায় কি করছ।”

তিনি জবাব দেন, “আমি অ্যাটর্নি অ্যাট ল।”

সে  বলে, “তাতে কোনো যায় আসে না। তুমি ভারতীয় তাই বেরিয়ে যাও।”

গান্ধীকে ট্রেন থেকে বের করে দেওয়া হয়। তাই গান্ধী বুঝেছিলেন যে এসব কেন ঘটছে। এটা ঘটছে কারণ তারা আমাদেরকে দাস মনে করে।

এরপর গান্ধী দেশে ফিরে আসেন। মোহাম্মদ আলি জিন্নাহও শ্বেতাঙ্গদের ভক্ত ছিল। তিনি মুসলিম ছিলেন, ইসমাইলি পরিবার থেকে এসেছেন। এরপর তিনি তার ধর্ম পরিবর্তন করে সুন্নি মুসলিমে পরিবর্তিত হন। কারণ, তিনি তার উইলে লিখে গিয়েছিলেন যে তার জানাজা যেন মুফরি শাব্বির আহমাদ উসমানি পড়ান।

জিন্নাহ মারাত্মকভাবে বদলে গিয়েছিলেন। অনেকেই তার দিকে তাক করে বলে এই লোকটা সেকুলার ছিল, ব্রিটিশপ্রিয় ছিল, বেকন স্যান্ডউইচ খেত, কুকুর পালত। কিন্ত ৩০ বছর বা ৪০ বছর বয়সী জিন্নাহর দিকে তাকানো যাবে না। তাকাতে হবে আরো পরে। ৭০-এর দিকে জিন্নাহ বেশ ধার্মিক হয়ে যান। তিনি কংগ্রেস পার্টির একনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন। যখন তিনি বুঝেছিলেন যে এই পার্টি মুসলিমদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করবে না তখন সেটার সদস্যপদ পরিত্যাগ করেন। তাই তিনি ব্রিটেনে ফিরে যান এবং অত্যন্ত উঁচু মাপের ব্যারিস্টার হন। তিনি সেসময় ব্রিটেনের সবচেয়ে সফল ও ধনী ব্যারিস্টার ছিলেন। তার একজন ইংরেজ শোফার ছিল। কোনো ভারতীয়র জন্য ইংরেজ শোফার থাকা মানে বিশাল ব্যাপার।

তো ইকবাল জিন্নাহর কাছে আসেন এবং মুসলিমদের নেতৃত্ব দিতে এবং স্বাধীনতার যুদ্ধে যোগ দিতে বলেন। সেসময় তেমন কোনো আন্তরিক নেতৃত্ব ছিল না। তাই মোহাম্মদ ইকবাল জিন্নাহকেই নির্বাচন করেন। জিন্নাহ ফিরে যান এবং মুসলিম লিগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ভারতের কিছু হিন্দু অ্যাক্টিভিস্টদের মতে, ব্রিটিশরা মুসলিম লীগ তৈরী করেছিল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য। এটা ব্রিটিশদের জন্য সত্য হতে পারে। তবে মুসলিম নেতারা বৃটিশদের হয়ে কাজ করছিলেন না। ব্রিটিশরা তাদের নিজেদের লক্ষ্য পূরণ করতে চেয়েছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল মুসলিমদের জন্য আলাদা ভূমির ব্যবস্থা করা যেন তারা সেই পরিস্থিতিতে না জড়ায় যার মুখোমুখি আজ তারা হচ্ছে, যেখানে মুসলিমদের ওপর নিয়মিত নির্মমতা চালানো হচ্ছে। তাদেরকে বলা হচ্ছে, হয় জয় শ্রীরাম বল নয়তো মর।

তাদের মসজিদগুলোতে নিয়মিত আক্রমণ করা হচ্ছে। তাদের দেহ থেকে কাপড় ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। মুসলিম নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে। কিন্তু এসবের পেছনে যারা আছে তাদের শাস্তি দিচ্ছে না আদালত।

কংগ্রেস পার্টি নামক সেকুলার দলের নেতা রাহুল গান্ধী বলেছেন যে, তারা শুধু একটি রাজনৈতিক দল অর্থাৎ বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ছেন না বরং একটি সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়ছেন।

কারণ বিজেপি তার কালপ্রিট ও এজেন্টদের প্রতিটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের স্তরে স্তরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। মিলিটারিতে তাদের লোক, পুলিশে তাদের লোক, বিচারব্যবস্থায় তাদের লোক, পৌরসভায় তাদের লোক। সব জায়গায় তারা আছে। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে ভারতকে মুসলিমমুক্ত করা। আমি বানিয়ে বলছি না। আপনি বিজেপির নেতা ও মুখপাত্রদের মুখেও এ ধরনের কথা শুনতে পারবেন। তারা উন্মুক্তভাবে, প্রকাশ্যে মুসলিম গণহত্যার আহ্বান জানাচ্ছে। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং সুপরিচিত।

পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতারা যেই জিনিসটির ভয় করেছিলেন সেটাই ঘটেছে। ভারতে মুসলিমরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়েছে, যাদের কোনো নিরাপত্তা নেই। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের সময় জিন্নাহ বলেছিলেন যে, এখন ভারতীয় মুসলিমদের তাদের বাকি জীবন কাটাতে হবে ভারতের প্রতি নিজেদের আনুগত্য প্রমাণ করতে।

দুঃখজনকভাবে এখন সেটাই ঘটছে। অনেক ভারতীয় মুসলিমকে তাদের ভারতের প্রতি আনুগত্য প্রকাশকারী কথা বলতে হবে। ঠিক এই কারণেই ভিন্ন স্বদেশের প্রয়োজন ছিল।

Leave a Comment