ব্রিটিশরা যেভাবে ডিভাইড এন্ড রুলের খেলা খেলেছিল ভারতবর্ষে

ভারত ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দীর্ঘদিন অন্যদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত থাকার পরে একটি স্বাধীন দেশ হয়ে ওঠে। কিন্তু এই আনন্দের সময়টাও দুঃখজনক ছিল “দেশভাগ”-এর কারণে। এই সময় ভারত দুই ভাগে বিভক্ত হয়: পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে। এই বিভক্তের কাজটি করে দিয়ে যায় ব্রিটিশরা।

তারপর থেকে এখন ৭০ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু আসলে কী ঘটেছিল তা ভাবাটা আজও কঠিন। মারামারি, মানুষকে আহত করা, সম্পত্তি ধ্বংস করার মতো অনেক খারাপ ঘটনা ঘটে৷ প্রচুর লোককে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে যেতে হয়েছিল এবং প্রচুর সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছিল।

কয়েক মাসের পরই ভারত ও পাকিস্তান কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যার ফলাফল আজও আমাদের প্রভাবিত করছে।

এই বিভাজনের ফলে বন্ধুত্ব ধ্বংস হয়েছে, পরিবার ভেঙ্গে পড়েছে, মানুষকে স্থানান্তর করতে হয়েছে, হৃদয়-মন ভেঙ্গে পড়েছিল।

হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে বৈরিতা সৃষ্টি ও এটাকে স্থায়ী করা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী নীতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব। একে বলা হতো ডিভাইড এন্ড রুল।  ঔপনিবেশিকরা তাদের শাসন অব্যাহত রাখার সুবিধার্থে ধর্মীয় বিরোধিতাকে উস্কে দিয়েছিল এবং ১৯৪৭ সালে তা মর্মান্তিক চরমে পৌঁছায়।

ব্রিটিশরা অন্যান্য দেশে নতুন সীমান্ত তৈরি করতে পছন্দ করত। তারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে মধ্যপ্রাচ্যে এবং পরবর্তীতে ভারতেও এটি করেছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হলে দেশটি ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি অংশে বিভক্ত হয়। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের কারণে এই বিভাজন হয়েছিল।

ব্রিটিশদের দ্বারা সীমান্তরেখা অঙ্কন ছিল এক অত্যন্ত বিপজ্জনক কাজ। লোকেরা সীমান্তের ডান দিকে থাকার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিল। এর ফলে প্রচুর সহিংসতা ও মৃত্যু ঘটেছিল। দুঃখজনকভাবে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায় এবং প্রায় ২ কোটি মানুষকে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে যেতে হয়। অনেক বাড়িঘর ও জিনিসপত্রও ধ্বংস হয়ে যায়। সীমান্তরেখা টানার কারণে মানুষের জীবনে একটি বড় পরিবর্তন আসে।

ব্রিটিশরা সহজে তাদের ক্ষমতা ছাড়তে চাচ্ছিল না। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ এবং ভারতীয় স্বাধীনতাকামী নেতাদের পক্ষ থেকে চাপে তারা ভারত ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ভারতকে শাসন করতে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি ব্রিটিশরা দিলেও তারা তার অনুসরণ করেনি। এটি প্রমাণ করে যে, ভারতকে একটি দায়িত্বশীল ও স্বশাসিত দেশে রূপান্তর করতে ব্রিটেনের আগ্রহী ছিল না। ব্রিটেন পদ্ধতিগতভাবে হিন্দু ও মুসলিমদের ভেতর রাজনৈতিক বিভেদ তৈরী করে।

১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সময় বিদেশী অত্যাচারীর বিরুদ্ধে হিন্দু ও মুসলিমদের জোটবদ্ধ হয়ে লড়াই করতে দেখে ব্রিটিশরা আতঙ্কিত হয়। তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে এটা আর ঘটতে দেওয়া যাবে না। লর্ড এলফিনস্টোন লিখেছেন, “ডিভাইড এন্ড রুল ছিল  পুরানো রোমান প্রবাদ। আমরাও সেটা ব্যবহার করব।” প্রকাশ্য ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষকতায় দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে পৃথক চেতনা জাগানোর একটি নীতি চালু করা হয়। যখন সীমিত ভোটাধিকার ভারতীয়দের ক্ষুব্ধভাবে মঞ্জুর করা হয়েছিল, তখন ব্রিটিশরা পৃথক সাম্প্রদায়িক নির্বাচকমণ্ডলী তৈরি করেছিল, যাতে মুসলিম ভোটাররা মুসলিম আসনের জন্য মুসলিম প্রার্থীদের ভোট দিতে পারে। বিভাজনের বীজ বপন করা হয়েছিল, একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে প্রতিরোধ করার জন্য যা ব্রিটিশদের উৎখাত করতে পারে। বিভিন্ন ধর্মের লোকেরা যেন কেবল তাদের নিজ ধর্মের নেতাদের ভোট দিতে পারে এই ব্যবস্থা করা হয়। এটি বিভাজন সৃষ্টি করে এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য জনগণের জন্য একসাথে কাজ করা কঠিন করে তোলে। এতে ব্রিটিশরা আশা করে তারা দীর্ঘকাল ভারতে তাদের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ জনগণ অনেক সমস্যার মধ্য দিয়ে যায়। তারা আহত হয় এবং অনেক কিছু হারায়। সুতরাং, যুদ্ধ শেষ হওয়ার সময় তাদের আর ভারত এবং সাম্রাজ্যের অন্যান্য অংশ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা বা সম্পদ কোনোটাই ছিল না। তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে হতো যেন ভারত স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। কিন্তু তারা এটা ঘটতে দিতে চায়নি। তারা ভারতকে চিরকাল তাদের সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে রাখতে চেয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তারা জার্মানির বোমা হামলায় ভীত হয়ে পড়ে, যুদ্ধে পরাজয়ের কারণে বিচলিত হয়। তাদের অসংখ্য সৈন্য বন্দি হয়। ভারতীয় সৈন্যদের পরিত্যাগ এবং ভারতীয় নাবিকদের বিদ্রোহে টলে গিয়েছিল তারা। ১৯৪৫-১৯৪৬ সালের শীতকাল তাদের প্রচণ্ড কাবু করে ফেলে কারণ কয়লার ঘাটতি থাকায় তারা শীতে উষ্ণতার ব্যবস্থা করতে পারেনি। তারা তাদের নিজের দেশ নিয়েই খুব ব্যস্ত ছিল। নিজেদের সাম্রাজ্য নিয়ে চিন্তার সময় তাদের ছিল না, এর মধ্যে ভারতও অন্তর্ভুক্ত।

তাদের অর্থনীতিও ভেঙ্গে পড়েছিল। আমেরিকার ঋণ তাদের অর্থনীতিকে চালু রেখেছিল এবং সেগুলো পরিশোধের দরকার ছিল। ভারতের কাছেও তাদের ঋণ ছিল। বেরিয়ে যাওয়াই ছিল তাদের একমাত্র উপায়। কিন্তু প্রশ্ন ছিল, তারা কি রেখে যাবে? তারা কি একটি সংযুক্ত ভারত রেখে যাবে নাকি এটিকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করবে?

যুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা এমন কিছু করেছিল যাতে তারা ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে, মুসলিম লীগ যেন শক্তিশালী হয়ে ওঠে। মুসলিম লীগ মুসলিমদের জন্য আলাদা দেশ চেয়েছিল। এর ফলে ভারতের একক দেশ হিসেবে থাকার ধারণা দুর্বল হয়ে যায়। ব্রিটিশদের ভারতকে নিয়ন্ত্রণে রাখার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু এই পরিকল্পনাটি খুব ভালভাবে কাজ করে। ব্রিটিশরা চলে গেলে ভারত একটির পরিবর্তে দুটি পৃথক দেশে পরিণত হয়।

ভারতকে বিভক্ত করে দুটি পৃথক দেশে পরিণত করার কাজ দেওয়া হয়েছিল স্যার সিরিল র‌্যাডক্লিফ নামের এক ব্যক্তিকে। তিনি আইনজীবী ছিলেন। কখনও ভারতে যাননি। ভারতের ইতিহাস, সংস্কৃতি বা জীবনধারা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। দুটি দেশ কোথায় হবে তা দেখানোর জন্য তাকে মানচিত্র তৈরি করতে হয়েছিল। তিনি মাত্র ৫ সপ্তাহের মধ্যে কাজটি করেছিলেন। তিনি ভারতে প্রচুর ঘামছিলেন কারণ সেখানে খুব গরম ছিল, তিনি এতে অভ্যস্ত ছিলেন না। তিনি মানচিত্র তৈরির কাজ শেষ করার পর দ্রুত ভারত ছেড়ে ব্রিটেনে ফিরে যান। তিনি আর কখনও ফিরে আসেননি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশরা দ্রুত ভারত ছেড়ে চলা যায়। ভারতের জনগণ মরুক বা বাঁচুক তাতে ব্রিটিশদের যায় আসেনি।

ভারতকে দুটি পৃথক দেশে বিভক্ত করার প্রভাব আজও টের পাওয়া যায়। ব্রিটিশদের বর্তমান ভারতের গণতন্ত্র নিয়ে গর্ব করা অনুচিত। কারণ তারা ২০০ বছর ধরে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল, আঘাত করেছিল এবং তাদের সাথে খারাপ আচরণ করেছিল।

ব্রিটিশরা যেভাবে ভারত ছেড়ে চলে গিয়েছে সেটাই ছিল তাদের সবচেয়ে বড় ভুল। তারা দাবি করে তারা ভারতকে শাসন করে এর উন্নয়ন ঘটিয়েছে। অথচ তারা যেভাবে ভারত ছেড়ে যায় এতে প্রায় ১০ লাখ লোকের মৃত্যু হয়, প্রায় ২ কোটি লোক ঘরবাড়ি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়, প্রচুর পরিমাণে সম্পত্তি ধ্বংস হয় এবং সারাদেশে তীব্র সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ে। ভারতে যেভাবে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটেছিল তা ছিল তার ব্যর্থতা ও ত্রুটির সবচেয়ে শক্তিশালী প্রমাণ।

Leave a Comment