সিলেট জেলায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জেলার ১৩টি উপজেলা এবং সিলেট মহানগরের একাংশের প্লাবিত এলাকায় বৃহস্পতিবার পানি আরও বেড়েছে। তবে সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে।
বৃষ্টি এবং ভারত থেকে নেমে আসা উজানের ঢল অব্যাহত থাকায় বন্যা দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। সিলেটে বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে মানুষের দুর্ভোগ দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকটে পড়েছেন অনেকে। সরকারি উদ্যোগে যে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। এমনকি অনেকে এখনো কোনো ত্রাণ পাননি বলে অভিযোগ করেছেন।
বন্যাকবলিত এলাকায় চর্মরোগ, পেটের পীড়াসহ নানা অসুখও ছড়িয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় বন্যার্তদের চিকিৎসার জন্য ১৪০টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সিলেট জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র। বন্যাকবলিত অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহও বন্ধ রয়েছে। বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে পানি ঢোকায় এবং বিদ্যুতের তার পানির কাছাকাছি চলে আসায় ঝুঁকি বিবেচনায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। এদিকে জেলার প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ছয় শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্যার কারণে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সিলেট নগরীর বাগবাড়িতে অবস্থিত সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া সুরমা নদীর তীর ঘেঁষে অবস্থিত নগরীর বন্যাকবলিত এলাকাগুলোর মানুষের কষ্ট-দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। বাসাবাড়ি, দোকানের মূল্যবান জিনিসপত্র ভিজে নষ্ট হচ্ছে। অনেকে বাধ্য হয়ে গিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন।
নগরীর শাহজালাল উপশহর, তেররতন, মেন্দিবাগ, সোবহানীঘাট, চালিবন্দর, ছড়ারপাড়, মাছিমপুর, কালীঘাট, শেখঘাট, কাজিরবাজার, লালাদীঘিরপাড়, বাগবাড়ি, কানিশাইল প্রভৃতি এলাকায় গতকাল বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। এছাড়া জেলার সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, জকিগঞ্জ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম জানান, সুরমা ও কুশিয়ারা নদীসহ সিলেটের সব নদ-নদীর পানি বাড়ছেই। পরিস্থিতি দেখে বন্যা দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। গতকাল সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সিলেটে ১৯ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর আগে বুধবার গভীর রাতে সিলেটে বয়ে যায় প্রবল ঝড়। এতে বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ আতঙ্কে রাত কাটান।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান জানান, সিলেটে পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করছেন।
সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানায়, গতকাল পর্যন্ত জেলায় পানিবাহিত রোগে শতাধিক লোক আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। জেলার ১৩টি উপজেলার ১০৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ৬০টি বন্যাকবলিত। এসব ইউনিয়নে কাজ করছে মেডিকেল টিম।
সিভিল সার্জন ডা. এসএম শাহরিয়ার গতকাল দেশ রূপান্তরকে জানান, বন্যার্তদের জরুরি চিকিৎসায় গঠিত প্রতিটি টিমে চিকিৎসক, নার্সসহ সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন। মেডিকেল টিম ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে।
সিলেট জেলা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, বন্যাকবলিত হওয়ায় জেলার ৬৭৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া আজ শুক্রবার অনুষ্ঠিতব্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগের সিলেট জেলার পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। আগামী ৩ জুন এ পরীক্ষা হবে।
লন্ডন থেকে ফিরেছেন মেয়র : সিলেট মহানগরী যখন বন্যায় বিপর্যস্ত তখন যুক্তরাজ্য সফরে ছিলেন সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। এ নিয়ে নাগরিকদের মধ্যে ক্ষোভ ছিল। অনেকে ফেইসবুকে নানা সমালোচনা করছিলেন। এ অবস্থায় ১৩ দিনের সফর শেষে গতকাল সকালে যুক্তরাজ্য থেকে সিলেটে ফেরেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। এরপর তিনি নগরীর বন্যাকবলিত কয়েকটি এলাকা পরিদর্শন করে ভুক্তভোগীদের সমবেদনা জানান।
সুনামগঞ্জ : সদর, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। গতকাল বিকেলে সুনামগঞ্জের নদ-নদীর পানি বিপদসীমায় ২১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল বলে জানিয়েছে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের সূত্রে জানা যায়, পাঁচ উপজেলার বন্যাকবলিত মানুষের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ১৫ মেট্রিক টন চাল, প্রতিটি উপজেলায় ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলায় সাত হাজার পরিবার বন্যার দুর্ভোগে পড়েছে। দুই উপজেলায় ১৩টি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং পাঁচটি উপজেলায় ২৮টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
এদিকে জেলায় ২১৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্লাবিত হয়েছে। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে পাঠদান। এছাড়া ২৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করায় পুরোপুরি বন্ধ রাখা হয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের সূত্রে জানা য়ায়, গত মঙ্গলবার সকাল থেকে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জ সদর, তাহিরপুর, ছাতক, দোয়ারাবাজার উপজেলাসহ জেলার পাঁচটি উপজেলার ২১৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্লাবিত হয়েছে। ছাতকে ১৭২, দোয়ারাবাজারে ২৩, সদর উপজেলার ২০ এবং শান্তিগঞ্জের ১টি স্কুলসহ ২১৬টি স্কুলে পানি প্রবেশ করেছে।