পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ, এই দুঃখী বাংলাদেশে

২০০৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের ৩২তম বিজয় দিবসের প্রাক্কালে এক দুঃসময়ের কালপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে আমাদের জাতীয় জীবনের ওপর দিয়ে। চারদিকে খারাপ খবর। ১৯ নভেম্বর চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ৭০ বছর বয়স্ক তেজেন্দ্র সুশীল পরিবারের চার দিনের শিশু কার্তিকসহ ১১ জনকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলার ক্রমাবনতিতে গৃহে অগ্নিসংযোগ এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ২২ নভেম্বর পাবনা জেলার বেড়া থানার মালদাপাড়া গ্রামের দিনমজুর আবদুল আজিজের ঝাপড়া ঘর থেকে তার স্ত্রী, পুত্র ও শাশুড়ির অগ্নিদগ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। সারা দেশে যেসব অগ্নিসংযোগ ও গৃহদাহের খবর আসছে তা ভয়াবহ। আবার জবাই করে হত্যার খবরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ওই দিন, অর্থাৎ ২২ নভেম্বর প্রতিপক্ষের গুলিতে আহত হয়ে যুবলীগ নেতা রহমত আলী মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি হয় চিকিৎসার জন্য। ঘাতকরা তাদের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করেছে হাসপাতালে ঢুকে সকলের সম্মুখে রহমত আলীকে খুন করে।

দেশে দ্রুত বিচার আইনের বদৌলতে খুনের মামলা আগের চেয়ে দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে। প্রাণদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্তদের সংখ্যা নরহত্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অস্বাভাবিক রকম বৃদ্ধি পেয়েছে। আইনশৃঙ্খলা সংস্থার অদক্ষতা ও গড়িমসির জন্য যেসব খুনখারাবির বিচার বিলম্বিত হচ্ছে তার মধ্যে বেশকিছু ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বীর হাতে এবং অন্তর্দ্বন্দ্বে বহু সন্ত্রাসী খতম হয়ে যাচ্ছে। সমাজের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে এ এক ধরনের অস্বাভাবিক প্রতিকার ব্যবস্থা।

১৯৭২ সালের পর বৈধ ও অবৈধ উভয় পন্থায় অর্থকরী কর্মকাণ্ডের নানা সুযোগ বৃদ্ধি পায়। লুণ্ঠন, দস্যুতা ও ছিনতাইয়ে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার যেমন বৃদ্ধি পায় তেমনি গণপিটুনিতে হত্যার দৃষ্টান্তও বাড়তে থাকে। সমঙ্রতি নোয়াখালীর চরাঞ্চলে বনদস্যু নামে কথিত ৪০ জনকে হত্যা করা হয়েছে এবং ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই নৃশংসতা মুষ্টিমেয় লোকের কাজ বলে সান্ত্বনা পাওয়ার কারণ নেই। বিচারের পরিবর্তে এই ধরনের গণপিটুনির মাধ্যমে নরহত্যাকে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে বলে কী ক্ষমা বা অবজ্ঞা করা যায়!

সমঙ্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্সের গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের রিপোর্টে বাংলাদেশকে বিপজ্জনক দেশ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অবশ্য বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদে কোনো বাংলাদেশী জড়িত থাকার এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আরো বলা হয়েছে, শুধু বাংলাদেশ নয় আরো কয়েকটি দেশকে ‘বিপজ্জনক’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষ এসব কথায় কোনো সান্ত্বনা বা স্বস্তি পায় না। তারা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারে দেশের শিরে সংক্রান্তি-বিপজ্জনক অবস্থা-কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে।

গত পাঁচ বছরে দেশে বোমা হামলায় শতাধিক লোক প্রাণ হারিয়েছে। ছায়ানটের পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে, ময়মনসিংহে চারটি সিনেমা হলে, নারায়ণগঞ্জ, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য স্থানে যেসব শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণ ঘটেছে তার এখনো কোনো কিনারা হয়নি। হত্যাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ৫০ হাজার মামলা তদন্তের অপেক্ষায়। বগুড়া, চট্টগ্রাম এবং সর্বশেষ রাজধানীর কুড়িল-বাড্ডা থেকে বেশ কিছু অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। এসব ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত এবং পেছন থেকেইবা কারা কলকাঠি নাড়ছে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের কাছে কুড়িলে যেসব গোলাবারুদ পাওয়া গেছে সে সমের্ক তদন্তের জন্য মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই উত্সাহ প্রদর্শন করে। আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য ইজ্জত রক্ষার জন্য না-করে দিয়ে মুখ রক্ষা করার চেষ্টা করেছে।

আজকাল ট্র্যাফিক পুলিশ ট্রাকচাপা পড়ছে। পুলিশের সোর্স খুন হচ্ছে, একেবারে বেঘোরে খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যাচ্ছে। দারোগার আগ্নেয়াস্ত্র খোয়া যাচ্ছে। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে গুলিবিনিময়ে পুলিশের জানমালের ক্ষতি তুলনামূলকভাবে বেশি হচ্ছে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলছেন, পুলিশ এক টাকাও ঘুষ নেয়। এ যেন কালীপুজোর রাত্রে নিশিকুটুম্ব কোনোকিছু চুরি করতে না পেরে কুঁড়েঘর থেকে দুটো খড় হাতিয়ে নিয়ে পেশার স্বার্থে সাত্ করল। উপর থেকে নিচে তদারকির অভাব, হুকুম তামিল না হওয়া ও শৃঙ্খলাভঙ্গের যথাযথ শাস্তি প্রদান না করার জন্য এবং রাজনীতিকদের হস্তক্ষেপের ফলে পুলিশ প্রশাসনে এমন দুরবস্থা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের জরিপে পরপর তিন বছর দুর্নীতির শীর্ষস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।

রাজনীতিকরা বাংলাদেশের জনগণকে সঙ্গে করে প্রথমে পাকিস্তান পরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছে। কিন্তু ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর জনগণের শরিকানা ও সহযোগিতার বিষয়ে তেমন দৃষ্টি দেয়নি। রাজনীতিকরা নিজেদের বেতন ও ভাতাদি বৃদ্ধির দিকে নজর দিয়েছে এবং শ্রমিক ও কৃষকদের ধৈর্য ধরার নসিহত করেছে। জনগণের শরিকানা স্বীকার না করায় দেশে অযথা অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। জেলা পর্যায়ে সংবিধান নির্দেশিত স্থানীয় সরকার এখনো প্রতিষ্ঠিত হলো না। উদ্ভট সব রাজনৈতিক সমাধানের জন্য অলীক সব কথাবার্তা চলছে। তারপর মানুষের সহ্যশক্তি যখন আর থাকে না, তখন উপবিপ্লবের মাধ্যমে স্বল্পকালের জন্য হয়তোবা অবস্থার উন্নতি হয়। কিন্তু অতি দ্রুত যথাপূর্বং তথাপরং অবস্থায় দেশ আবার হতাশায় নিমজ্জিত হয়। এখন এমন একটা হতাশাগ্রস্ত আবহাওয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যাই হোক হতাশার কথা বলে কর্মবিমুখ হয়ে খেটে খাওয়া মানুষ তার কাজ বন্ধ করতে পারে না।

সাম্রাজ্যের স্বার্থে এবং স্বদেশের পার্লামেন্টের সম্মুখে জবাবদিহিতার ঝঞ্ঝাট এড়াতে ভারতের ব্রিটিশ প্রশাসনে এক ধরনের নিরপেক্ষতা এবং প্রশাসনের কার্যকারিতার জন্য এক ধরনের সততার মান রক্ষা করার চেষ্টা করা হতো। প্রদেশে সীমিত স্বায়ত্তশাসনের সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনের যে সামান্য আত্মীয়করণ ও দলীয়করণের সূত্রপাত হয়েছিল, তা স্বাধীনতা-উত্তরকালে দারুণভাবে বৃদ্ধি পায়। নির্বাচিত সরকারের আমলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে সরকারি কর্মকমিশনকে পাশ কাটিয়ে প্রশাসনকে যেভাবে কুক্ষিগত করা হয়েছে তার ভয়াবহ ফল এখন আমাদের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা।

দেশের মানুষ সংসদ সমের্ক নিরাশ। কালেভদ্রে সিভিল সমাজকে সোচ্চার হতে দেখা যায়। সংবাদপত্রের প্রতি জনসাধারণের যে প্রত্যাশা তা সামরিক আমলে বিনষ্ট হয় এবং তখন সামরিক বাহিনীর তত্পরতাকে অস্বীকার করা কঠিন হয়ে যায়। নির্বাচিত সরকারের সময় সংবাদপত্র তুলনামূলকভাবে প্রত্যাশিত ভূমিকায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং প্রতিযোগিতামূলক আবহাওয়ায় সংবাদপত্র নিছক একপেশে কাজসারা খবর বা প্রতিবেদন প্রকাশ করে খালাস হতে পারছে না।

বিংশ শতাব্দীতে দক্ষিণ এশিয়ায় এক চরম বিরোধমূলক রাজনীতি কাজ করেছে। তার কুফল আমাদের দেশেও বিদ্যমান। ব্রিটিশ-ভারত ভাগ করে ভারত ও পাকিস্তান এবং পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসে এক অভাবিত ফল। ১৯৭১ সালের আগে স্বাধীন বাংলার কথা তেমন কেউ চিন্তা করেনি। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির কারণে নতুন দেশের জন্ম বড় সামঞ্জস্যপূর্ণ ও স্বাভাবিক হয়েছে।

পৌষ মাস আমাদের নবান্নের মাস। বিজয়ের মাস। বিজয় দিবসে দুঃখের পাঁচালি একেবারে বেমানান। আমরা আহাজারি বন্ধ করে কিছু সুখবর শুনতে চাই। কোথায় সেই সুখবর। চোখে পড়ার মতো নয় কেন!

১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে ইংল্যান্ডের একটি ইন্ডিপেনডেন্ট থিঙ্কট্যাঙ্ক ডিমস এক জরিপ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল যে, বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মানুষের দেশ। লন্ডন সানডে টাইমস-এ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। বছর দুয়েক পরে সুপার মডেল ক্লডিয়া শিফার বাংলাদেশ সফর করতে এসে বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বল্প আয়ের বস্তির মানুষের মুখে যে সুখের আভা দেখা যায়, অনেক শত কোটিপতির চেহারায়ও তা থাকে না।’ দুর্যোগ কাটিয়ে দারিদ্র্য ও দুরবস্থাকে সহনীয় করার একটা প্রযুক্তি আমরা যে অর্জন করেছি তা বলতেই হবে।

Leave a Comment