তরুণীর লাশ ট্রাঙ্কে ভরে ঢাকায় পাঠানোর ৬ বছর পর রহস্য উন্মোচিত

গত ছয় বছর ধরে ভেবেছিলাম শম্পা পাচার হয়েছে অথবা কোনো কারণে নিখোঁজ রয়েছে। আমার বিশ্বাস ছিল সে একদিন আমার বুকে ফিরে আসবে। কিন্তু গত বুধবার জানতে পারলাম শম্পা ছয় বছর আগেই খুন হয়েছে।’

শনিবার দুপুরে এ প্রতিবেদককে কথাগুলো বলতে গিয়ে অঝোরে চোখের পানি পড়ছিল নিহত শম্পা বেগমের (২৫) বাবা অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য ইলিয়াস শেখের।

রাজধানীর ধানমন্ডিতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সদর দপ্তরে ইলিয়াস শেখ দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রথম থেকেই আমার সন্দেহ ছিল রেজাউল করিম স্বপনের ওপর (শম্পার কথিত স্বামী)। শম্পা নিখোঁজের পর আমি তাকে থানায় জিডি করতে বললে সে আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে।’   

মেয়ে নিখোঁজের পর থেকে শম্পার মা অসুস্থ উল্লেখ করে তিনি বলেন, শম্পার মা লিভার ও কিডনির সমস্যায় ভুগছে। তা ছাড়া শম্পা নিখোঁজের পর থেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে।’

তিনি বলেন, ‘আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে শম্পাকে নির্মম ভাবে হত্যাকারী স্বপনের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।’

শম্পার ভগ্নিপতি আব্দুল মান্নান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দুই বোন এক ভাইয়ের মধ্যে শম্পা ছিল মেজো। সে খুলনা আজম খান সরকারি কমার্স কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল। শম্পা আমাদের বলেছিল সে স্বপনকে বিয়ে করেছে। স্বপনের আরেক বউ ও সন্তান আছে জানতে পারার পর তাদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়। শম্পা তার বোনকে জানায় স্বপন তাকে নির্যাতন করে। শম্পা নিখোঁজের পর থানায় জিডি করলেও তার কোনো খোঁজ পাইনি।’

তিনি আরও বলেন, স্বপন থানায় আমার সামনে পুলিশকে জানায় শম্পা তার স্ত্রী না। শম্পা নিখোঁজের আগে স্বপনের সাথে কোথায় কোথায় ছিলেন তার প্রমাণ পুলিশকে দিয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশ বলে বিয়ের কাবিন দেখাতে। আমাদের কাছে কাবিন ছিল না। স্বপন নৌবাহিনীর চাকরি করায় পুলিশও কোনো জোরালো পদক্ষেপ নেয়নি। পরে তার বিরুদ্ধে দুই দফায় নৌবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করি। পরে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় ২০১৯ সালে স্বপনকে চাকরি থেকে অবসরে পাঠায়।’   

উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ৩ মে বিকেলে গাবতলী বাস স্ট্যান্ডে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী ঈগল পরিবহনের একটি বাসের মালামাল রাখার বাংকারে করে আসা ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে এক অজ্ঞাতনামা মহিলার লাশ উদ্ধারের ঘটনায় হওয়া মামলার তদন্তে নামে পিবিআই।

পিবিআই এর তদন্তে বের হয়ে আসে ওই অজ্ঞাত লাশের পরিচয়। লাশটি শম্পা বেগমের নিশ্চিত হওয়ার পর উদ্‌ঘাটন হয় হত্যার রহস্য। এ ঘটনায় গত শুক্রবার শম্পার কথিত স্বামী নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য স্বপনকে গ্রেপ্তার কর করা হয়। সে হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দিয়েছে। 

এর আগে ২০১৫ সালের ৩ মে সকাল থেকে নিখোঁজ ছিলেন শম্পা বেগম। সেদিন কথিত স্বামী স্বপনের চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর বাসা থেকে বাবার বাড়ি খুলনার দৌলতপুরে যাওয়ার কথা ছিল শম্পার। স্বামী স্বপন শম্পার বাবা ইলিয়াস শেখকে ফোনে জানান শম্পাকে টার্মিনাল থেকে বাসে তুলে দিয়েছেন। কিন্তু গত ৬ বছরেও বাড়িতে ফেরেনি শম্পা।

শম্পা হত্যার রহস্য উদ্‌ঘাটনের পর পিবিআই বলছে, বিয়ে না করেই ২০১৪ সাল থেকে একসাথেই থাকত শম্পা ও স্বপন। যদিও শম্পা তার বাবা-মাকে জানায় তারা বিয়ে করেছে। ঘটনার কয়েক দিন আগে থেকে শম্পা বিয়ের জন্য স্বপনকে চাপ দিচ্ছিল। কিন্তু স্ত্রী-সন্তান থাকায় শম্পাকে বিয়ে করতে রাজি হয় না স্বপন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিবাদের সৃষ্টি হয়। ২০১৫ সালের ২ মে দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে তাদের মধ্যে কলহের সময় স্বপন শম্পার গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাস রোধে হত্যা করে। পরে লাশ ট্রাঙ্কে ভরে বাসে করে ঢাকা পাঠিয়ে দেয়।

শম্পা নিখোঁজের পর ২০১৫ সালের ১০ জুন চট্টগ্রামের পাহাড়তলি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন শম্পার ভগ্নিপতি বিজিবির ল্যান্স নায়েক আব্দুল মান্নান।

মামলার তদন্তকারী পিবিআই কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, ২০১৩ সালে স্বপন খুলনা তিতুমীর নৌ-ঘাঁটিতে কর্মরত থাকাকালে শম্পা হাসপাতালে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজ করতেন। হাসপাতালে শম্পার মায়ের চিকিৎসার সময়ে আসামি স্বপনের সাথে তার পরিচয় হয়। এই পরিচয়ের সূত্রে প্রথমে প্রেম এবং পরে শম্পা তাকে বিয়ের জন্য চাপ দিলে সে বদলি হয়ে চট্টগ্রামে চলে আসে। এরপর শম্পাও কিছুদিন পরে চট্টগ্রামে চলে আসে। চট্টগ্রামে শম্পা তার এক ফুফুর বাসায় কিছুদিন থাকে। এরপর ফয়েজ লেক এলাকায় একটি হোটেলে কিছুদিন অবস্থান করে। পরে পাহাড়তলী থানাধীন উত্তর গ্রিনভিউ আবাসিক এলাকায় অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য আনোয়ার হোসেনের টিনশেড বাড়ির একটি বাসায় সাবলেট নিয়ে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে স্বপন ও শম্পা একসঙ্গে বসবাস শুরু করে। এভাবে তারা ২০১৪-২০১৫ সালের মে মাস পর্যন্ত একত্রে বসবাস করে।

শম্পা হত্যার রহস্য উদ্‌ঘাটনের পর শনিবার বেলা ১২ টায় রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআই সদর দপ্তরে বিস্তারিত জানান পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. ইকবাল, পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর) এর ইউনিট ইনচার্জ জনাব মো. জাহাঙ্গীর আলম।

ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ঘটনার দিন চট্টগ্রাম এ কে খান মোড়ে ঈগল পরিবহনের কাউন্টারে টিকিট কেটে একজন ব্যক্তি একটি ট্রাঙ্ক তুলে দেয় বাসের বাংকারে। বাসের হেলপারকে তিনি বলেন সামনের ভাটিয়ারি কাউন্টার থেকে টিকিটের যাত্রী উঠবে। কিন্তু পরবর্তী কাউন্টারে কোনো যাত্রী না ওঠায় বাসটি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করে। ওইদিন বিকেল ৫ টা ৪৫ মিনিটে বাস গাবতলীতে পৌঁছায়। শেষ গন্তব্যে সকল যাত্রী যে যার মতো তাদের জিনিসপত্র নিয়ে নেমে যায়। পরে হেলপার দেখে একটি ট্রাঙ্ক বাসের বাংকারে মালিকবিহীন পড়ে আছে। তখন বাসের ড্রাইভার হেলপার মিলে ট্রাঙ্কটি নামিয়ে দেখে এটি খুব ভারী। তাদের সন্দেহ হওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে তারা বিষয়টি দারুসসালাম থানায় জানান। খবর পেয়ে থানা-পুলিশ হাজির হয়ে ট্রাঙ্কটি খুলে একজন অজ্ঞাতনামা তরুণীর লাশ দেখতে পান। লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে পোস্টমর্টেম এর জন্য হাসপাতালে পাঠায়।

তিনি বলেন, লাশের পরিচিতি শনাক্ত না হওয়ায় অজ্ঞাত পরিচয় লাশ হিসেবে দাফন করা হয়। কেউ বাদী না হওয়ায় থানা-পুলিশের পক্ষে এসআই জাহানুর আলী বাদী হয়ে আসামি অজ্ঞাত উল্লেখ করে দারুস সালাম থানায় মামলা করে। মামলাটি হওয়ার পর থেকে শুরুতে প্রায় তিন মাস থানা-পুলিশ তদন্ত করে। থানা-পুলিশের পরে সিআইডি দীর্ঘ চার বছর তদন্ত করে। কিন্তু লাশের পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় এবং হত্যা রহস্য উন্মোচিত না হওয়ায় আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করে সিআইডি। দাখিলকৃত চূড়ান্ত রিপোর্ট গ্রহণ না করে আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআইকে দেয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে পিবিআই। পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর) উক্ত মামলাটির তদন্ত শুরু করে। পিবিআই এর ইন্সপেক্টর আশরাফুজ্জামান ভিকটিমকে শনাক্ত করার জন্য প্রচলিত সকল পদ্ধতি প্রয়োগ করে। পরে শম্পার ভগ্নিপতি আব্দুল মান্নানের জিডির সূত্র ধরে ভিকটিমের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়।

অবশেষে এ হত্যার ঘটনায় গত শুক্রবার ভোরে কুমিল্লা জেলার ইপিজেড এলাকায় ভাড়া বাসা থেকে স্বপনকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। আসামি স্বপন ঘটনার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করেছে।

Leave a Comment