ডিপ ওয়ার্ক-বুক রিভিউ

শিরোনাম: ডিপ ওয়ার্ক-বুক রিভিউ

বই: Deep Work: Rules for Focused Success in a Distracted World

লেখক: ক্যাল নিউপোর্ট

প্রকাশক: পিয়াটকাস

পৃষ্ঠা: ২৯৬ (পেপারব্যাক)

প্রথম প্রকাশ: ২০১৬

আমি কিছুদিন আগে Deep Work: Rules for Focused Success in a Distracted World বইটা পড়া শেষ করি। স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি, প্রোডাক্টিভিটি ও ফোকাস ডেভেলপমেন্টের ওপর এটা আমার পড়া অন্যতম সেরা একটি বই। আমি ডিপ ওয়ার্ক বইটি নিয়ে এই লেখায় সব তথ্য তুলে ধরব যেমন লেখকের ব্যাপারে কিছু তথ্য, বইটা নিয়ে কথা, আমি বইটা পড়ে কি শিখেছি, কোন কোন বিষয় ভালো লেগেছে এবং কি কি ভালো লাগেনি, বইটা পড়া উচিত কী না, কারা বইটা পড়বে ইত্যাদি। লেখক দিয়েই শুরু করা যাক।

লেখকের পরিচয়

ক্যাল নিউপোর্ট ১৯৮২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন আমেরিকান নন-ফিকশন লেখক যিনি তাঁর বিভিন্ন বইয়ের জন্য সুপরিচিত যেমন

  • Deep Work: Rules For Focused Success in a Distracted World
  • So Good They Can’t Ignore You: Why Skills Trump Passion in The Quest For Work You Love
  • Digital Minimalism: Choosing a Focused Life in a Noisy World।

ক্যাল নিউপোর্ট ২০০৯ সালে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে কম্পিউটার সাইন্সে পিএইচডি অর্জন করেন। তিনি বর্তমানে জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সাইন্সের সহযোগী অধ্যাপক।

ডিপ ওয়ার্ক বইটা কি নিয়ে?

ডিপ ওয়ার্ক হল প্রোডাক্টিভিটির ওপর একটি বই। লেখক বলেছেন যে, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সফল হতে হলে আপনাকে অবশ্যই গভীরভাবে মনোযোগের সাথে নিরঃবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে হবে। এই বইটি ডিপ ওয়ার্ক (মনোযোগসহ কাজ) এবং শ্যালো ওয়ার্ক (মনোযোগহীন কাজ) এর মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে। ডিপ ওয়ার্ককে বইজুড়ে উৎসাহিত করা হয়েছে।

বইটি ভূমিকা দিয়ে শুরু হয়েছে। ভূমিকায় লেখক কিছু বাস্তব জীবনের উদাহরণ দিয়ে ডিপ ওয়ার্ক এবং শ্যালো ওয়ার্কের ধারণা ব্যাখ্যা করেছেন। এই আইডিয়াটি বইয়ের প্রথম অংশে তিনটি অধ্যায়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে আমরা আধুনিক অর্থনীতিতে নিজের উন্নতির জন্য কী করতে পারি এবং কীভাবে গভীরভাবে পরিশ্রম করলে সেটা আমাদের জন্য সফলতা বয়ে আনতে পারে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে লেখক বিভিন্ন কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর উদাহরণ দিয়েছেন যারা সবাই ডিপ ওয়ার্ককে প্রাধান্য দেয়। তৃতীয় অধ্যায়ে স্নায়বিক, দার্শনিক এবং মনস্তাত্ত্বিক যুক্তি দিয়ে ডিপ ওয়ার্কের গুরত্ব বর্ণনা করা হয়েছে।

বইয়ের দ্বিতীয় অংশে লেখক কিছু নিয়ম-শৃংখলার তালিকা উল্লেখ করেছেন যেগুলো আমাদের সাহায্য করবে ডিপ ওয়ার্কের অভ্যাস গড়ে তুলতে। দ্বিতীয় অংশটি চারটি অধ্যায় নিয়ে গঠিত। প্রথম অধ্যায়ে ডিপ ওয়ার্কের চারটি পদ্ধতি উল্লেখ করা রয়েছে, যা আমরা আমাদের সুবিধা অনুযায়ী বেছে নিতে পারি। এই অধ্যায়ে 4Dx নীতি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। লেখকের মতে, এই নীতি আমাদের ডিপ ওয়ার্ক করতে সাহায্য করতে পারে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে একাকিত্ব ও একঘেয়েমির গুরত্ব বোঝানো হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে যুক্তি দেওয়া হয়েছে কেন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া ছেড়ে দেওয়া উচিত। শেষ অধ্যায়ে শেখানো হয়েছে কীভাবে শ্যালো ওয়ার্কে সময় সময় ব্যয় করা কমানো যায়। বইটি শেষ হয়েছে উপসংহার টানার মাধ্যমে। সেখানে কয়েকজন মহান ব্যক্তিত্বের উদাহরণ রয়েছে যারা উল্লেখযোগ্য ফলাফল অর্জনের জন্য ডিপ ওয়ার্ক করেছেন।

ডিপ ওয়ার্ক থেকে কি শিখেছি?

আমই ডিপ ওয়ার্ক থেকে পাওয়া কিছু উল্লেখযোগ্য শিক্ষা তুলে ধরছি০

১. ডিপ ওয়ার্কের অভ্যাস গড়ে তোলা

আমাদের উত্পাদনশীলতা ও কর্মদক্ষতা কোনো একটা কাজে ফোকাসের তীব্রতা এবং কাজটায় ব্যয়িত সময়ের সরাসরি সমানুপাতিক। সময় সীমিত একটা রিসোর্স কারণ প্রত্যেকের হাতে দিনে আছে ২৪ ঘন্টা। কিন্তু আপনি কতটা ফোকাস করবেন তার সীমা নেই। যেই ব্যক্তি বেশি ফোকাস করতে পারবেন কাজে, তিনি কম ফোকাস করা ব্যক্তির চেয়ে একই সময়ে অধিক কাজ করতে সক্ষম হবেন। হাই ফোকাসে করা কাজই হলো ডিপ ওয়ার্ক।

তাই মাথা খাটানো লাগে এমন কাজ যেমন একটি জটিল গণিত সমস্যা সমাধান করা, একটি গল্প লেখা, একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম লেখা ইত্যাদি হাই ফোকাসের সাথে, অনেক মনোযোগের সাথে করা হলো ডিপ ওয়ার্ক। অন্যদিকে শ্যালো ওয়ার্ক হচ্ছে এমন কাজ যা করতে তেমন মনোযোগের দরকার পড়ে না। এসব কাজের মূল্যও কম। এসব কাজ করাও যায় খুব সহজে। যেমন, ইমেইল চেক করা, ইনস্টাগ্রাম বা ফেসবুক স্ক্রোল করা, ইউটিউব দেখা ইত্যাদি সবই শ্যালো ওয়ার্ক।

ডিপ ওয়ার্ক আমাদের প্রোডাক্টিভিটি বাড়ায়, কম সময়ে অধিক কাজ করার সক্ষমতা প্রদান করে, অচিন্তনীয় ফলাফল পেতে সাহায্য করে, কাজে স্যাটিসফ্যাকশন এনে দেয়। কিন্তু শ্যালো ওয়ার্কের মাধ্যমে মূল্যবান কিছু করা যায় না। সময়কে অপচয় করার দুর্দান্ত মাধ্যম এটি। তাই আমি প্রথম যা শিখেছি তা হল, ডিপ ওয়ার্কে সময় ব্যয় করা এবং শ্যালো ওয়ার্ক এড়িয়ে চলা।

২. আপনার মনোযোগ সীমিত

আমি যখন ভার্সিটি অ্যাডমিশনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখন প্রচুর পরিশ্রম করেছি। সব ক্লাসে গেছি, কোচিং করেছি, প্রচুর ম্যাথ, ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রির সমস্যা সমাধান করেছি। এরপরও নিজের কাজে সন্তুষ্ট হতে পারছিলাম না। সবসময় ক্লান্ত লাগত। এমনকি সকালেও আমি ঠিকমতো ফোকাস করতে পারতাম না। এভাবে চলতেই থাকে। আমি কোনো সমাধান খুঁজে পাইনি কারণ খোঁজার চেষ্টাও করিনি। ভেবেছিলাম খালি কঠোর পরিশ্রম করলেই হয়ে যাবে।

কিন্তু চার বছর পর ডিপ ওয়ার্ক পড়ার পর বুঝতে পারলাম সেই সময় আমি কী ভুল করছিলাম। আমি প্রতিদিন আমার সমস্ত সীমিত মনোযোগ আজেবাজে কাজে ব্যবহার করছিলাম। তাই আমার ফোকাস সবসময় কম ছিল। এটি আমার প্রোডাক্টিভিটি কমিয়ে দেয়। তাই নিজের কাজে সন্তুষ্ট হতে পারতাম না।

অ্যাটেনশন রেস্টোরেশন থিওরি অনুসারে, কোনো কাজে ফোকাস করতে হলে সরাসরি মনোযোগ দিতে হয়। সরাসরি মনোযোগের পরিমাণ যেহেতু সীমিত, তাই এটা শেষ হয়ে গেলে মনোযোগ দেওয়া কঠিন হয়।

আমি বইটি থেকে শিখেছি যে, মনোযোগ সংরক্ষণ করতে হলে যখন নিজের কাজের সময় শেষ হয়ে যাবে তখন সব কাজ বন্ধ করে দিতে হবে পরের দিন পর্যন্ত। রাতের বেলা হালকা কাজ করে নেওয়া যাবে না। আপনি রাতের বেলা কাজ করলে নিজের সব সরাসরি মনোযোগ ব্যবহার করে ফেলবেন এবং পরের দিন ফোকাস করতে পারবেন না। ফলে ওভারল ফলাফল যা দাঁড়াবে তা হল, আপনি পরের দিন সব কাজ শেষ করতে পারবেন না। পূর্ণ মনোযোগও পাবেন না।

তাই বিকেলে বা সন্ধ্যায় সব কাজ থেকে ইস্তফা দিন। এ সময়টা পরিবারের সাথে কাটান, ইবাদত করুন, এক্সারসাইজ করুন, প্রকৃতিতে সময় দিন। এগুলো আপনার সীমিত মনোযোগকে পরের দিনের জন্য রিচার্জ করবে। এটি ডিপ ওয়ার্ক বইয়ের সবচেয়ে পাওয়ারফুল শিক্ষার একটি।

ডিপ ওয়ার্ক বইটা কেন পড়বেন?

ডিপ ওয়ার্ক বইটা আপনাকে বর্তমান অর্থনীতিতে টিকে থাকার সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ অভ্যাসটি গড়ে তুলতে সাহায্য করবে আর সেটা হল, গভীর মনোযোগের সাথে কাজ করার অভ্যাস। এই বইয়ে ডিপ ওয়ার্ক করার অনেকগুলো পদ্ধতি উল্লিখিত হয়েছে যা প্রয়োগ করে আপনি অসাধারণ কিছু সৃষ্টি করতে পারবেন। এখানে নানা অনুপ্রেরণাদায়ক উদাহরণ দেওয়া হয়েছে যা দিয়ে আপনি সহজেই ডিপ ওয়ার্কের গুরত্ব বুঝতে পারবেন। বুঝতে পারবেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটানো আপনার উচিত হচ্ছে কী না। বুঝবেন, ডিপ ওয়ার্ক করে কাটানো জীবনই যে জীবন পরিচালনার সর্বোত্তম উপায়। আপনি মানসিক, শারীরিক, আর্থিক এবং আধ্যাত্মিকভাবে অসাধারণ জীবন অতিবাহিত করবেন। অবশ্যই বইটা পড়তেই হবে আপনাকে।

কারা পড়বে বইটা?

যারা নিজেদের প্রোডাক্টিভ মনে করে না এবং তাদের মনে হয় তারা সামাজিক মাধ্যমে অনেক সময় অপচয় করছে, যারা তাদের কর্মজীবন নিয়ে সন্তুষ্ট না এবং জীবনটা মূল্যবান কাজে ব্যয় করে অতিবাহিত করতে চায় তাদের জন্য এই বইটা বেস্ট হবে। আপনি ৯টা-৫টা চাকুরীজীবী হোন, অথবা অন্ট্রপ্রেনার কিংবা আর্টিস্ট – আপনাদের সবার জন্যই ডিপ ওয়ার্কে নানা প্র্যাকটিক্যাল উপায় বর্ণিত হয়েছে যা থেকে আপনারা অবশ্যই উপকৃত হতে পারবেন ইনশাআল্লাহ। আপনার জীবন আরো অর্থপূর্ণ হবে। যেহেতু মনোযোগ দিয়ে কাজ করার ভেতর সফলতা লুকিয়ে আছে, তাই আমি এই বইটি সবাইকে পড়তে বলব যারা এই বিক্ষিপ্ত দুনিয়ায় সফল হতে চায়।

 

 

Leave a Comment