চিকিৎসায় মৃগীরোগ ভালো হয়

মৃগীরোগ মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রের একটি রোগ। এটি প্রতিরোধ ও চিকিৎসাযোগ্য। দ্রুত শনাক্ত হলে, চিকিৎসকের পরামর্শমতো চললে ৭০ ভাগ ক্ষেত্রেই রোগটি ওষুধে নিরাময় হয়। তবে এ রোগ নিয়ে ভূতের আসর, জিনে ধরেছে, অভিশাপ—এ ধরনের নানান কুসংস্কার সমাজে প্রচলিত আছে। তাই এ রোগ প্রতিরোধে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সোমবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মৃগীরোগ দিবস। গত শনিবার এ দিবস উপলক্ষে রাজধানীতে চ্যানেল আই ভবনে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকের আলোচকেরা এ কথা বলেন।গোলটেবিল বৈঠকটির আয়োজন করে সোসাইটি অব নিউরোলজিস্টস অব বাংলাদেশ। এতে সায়েন্টিফিক পার্টনার ছিল ইনসেপ্‌টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। এতে সম্প্রচার সহযোগী ছিল এবং বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আই।

গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনায় সোসাইটি অব নিউরোলজিস্টস অব বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ফিরোজ আহমেদ কোরাইশি বলেন, প্রথমেই মনে রাখতে হবে, রোগটি প্রতিরোধযোগ্য ও চিকিৎসাযোগ্য একটি অসুখ। বংশগত মৃগীরোগ প্রতিরোধ করা যায় না। তবে শিশুর জন্মকালীন জটিলতার কারণে মস্তিষ্কে আঘাতসহ নানা কারণে মৃগীরোগ অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব। রোগীকে সামাজিকভাবে আলাদা করে রাখা, অবহেলা করাকে অপরাধ হিসেবেই উল্লেখ করেন এ অধ্যাপক। মৃগীরোগী ও তার পরিবারের প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান এবং সোসাইটি অব নিউরোলজিস্টস অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবু নাসার রিজভী মৃগীরোগ নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে গণমাধ্যমকে আরও বেশি করে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি জানান, সোসাইটি অব নিউরোলজিস্টস অব বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও সচেতনতা তৈরিতে সভা, সেমিনারের আয়োজন, চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণে সহায়তা করাসহ বিভিন্ন কাজ করা হচ্ছে।


ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের নিউরোফিজিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ এনায়েত হোসেন মৃগীরোগের বিভিন্ন প্রকারভেদ উল্লেখ করে মৃগীরোগীকে কবিরাজের কাছে না নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা করানোর জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান।মৃগীরোগ নির্ণয় প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মো. রফিকুল ইসলাম জানান, রোগনির্ণয়ের জন্য রোগীর পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস জানা খুব জরুরি। খিঁচুনি হলে রোগী অনেক ক্ষেত্রে অজ্ঞান হয়ে যায়। কিছু বলতে পারে না। খিঁচুনির সময় যিনি পাশে ছিলেন, তাকে রোগীর খিঁচুনির সময়ের পুরো ঘটনা চিকিৎসকের কাছে বর্ণনা করতে হবে। একবার খিঁচুনি হয়েছে না বারবার হয়েছে, তা জানাতে হবে। এসব ইতিহাস জানার পাশাপাশি ইইজি, এমআরআইসহ বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে রোগটি শনাক্ত করেন চিকিৎসকেরা।

স্বজনদের করণীয়
মৃগীরোগের ক্ষেত্রে খিঁচুনি এক থেকে দুই মিনিট স্থায়ী হয় উল্লেখ করে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের নিউরোফিজিওলজি বিভাগের এ এফ এম আল মাসুম খান বলেন, খিঁচুনির সময় রোগীর তেমন কোনো করণীয় থাকে না। যিনি পাশে থাকেন, তাঁকে রোগীর চোখে চশমা বা অন্য কিছু যা দিয়ে ব্যথা পেতে পারে এমন কিছু থাকলে তা খুলে ফেলতে হবে। আঁটসাঁট পোশাক থাকলে তা ঢিলে করে দিতে হবে। ঝাঁকুনির সময় রোগীর মাথার নিচে বালিশ বা কুশন দিতে হবে, যাতে মস্তিষ্কে আঘাত না লাগে। রোগীকে কাত করে শোয়াতে হবে। রোগীর পাশে যিনি থাকবেন, তাঁকে আতঙ্কিত হলে চলবে না। রোগীকে শক্ত করে ধরে না রাখা, জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত পানি বা অন্য কোনো খাবার না খাওয়ানো, দাঁত কামড় দিয়ে থাকলে মুখ খোলার চেষ্টা করা যাবে না। কুসংস্কারের ফলে রোগীকে জুতা শোঁকানো হয়, এটা একেবারেই করা যাবে না। প্রথমবার খিঁচুনি এবং খিঁচুনি পাঁচ মিনিটের বেশি স্থায়ী হলে, আধা ঘণ্টার মধ্যে রোগীর জ্ঞান না ফিরলে, খিঁচুনির সঙ্গে অন্য কোনো জটিল অসুখ থাকলে বা খিঁচুনির সময় আঘাতপ্রাপ্ত হলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।


রোগনির্ণয়ের পরই দ্রুত চিকিৎসা শুরু করার কথা বলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক শেখ মাহবুব আলম। তিনি বলেন, চিকিৎসার পাশাপাশি রোগী ও রোগীর স্বজনকে রোগ সম্পর্কে, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসহ সার্বিক বিষয়ে কাউন্সেলিং করা জরুরি। রোগী ও রোগীর স্বজনকে বলে দিতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ বন্ধ করে দিলে বা নিয়মিত না খেলে ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে। একইভাবে ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকবে, তা আগে থেকেই বলে দিতে হবে। খাদ্যাভ্যাসে প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার বেশি রাখা, ধূমপান বা মদ না খাওয়া, রোগটি নিয়ন্ত্রণ হওয়ার আগে চালক, পাইলট এ ধরনের পেশায় যোগ না দেওয়াসহ নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে।
অধ্যাপক শেখ মাহবুব আলম বলেন, মা–বাবা যাতে কুসংস্কারকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেন, সেদিকে নজর দিতে হবে। কত দিন ওষুধ খেতে হবে, তার নির্দিষ্ট সময় নেই, তাই দরিদ্র অভিভাবক হলে চিকিৎসককে কম দামি ওষুধ দিতে হবে।

নারীদের জন্য বাড়তি সচেতনতা
মৃগীরোগ নারীদের মাসিক থেকে শুরু করে সন্তান নেওয়াসহ বিভিন্ন স্তরে প্রভাব ফেলতে পারে বলে উল্লেখ করেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক মালিহা হাকিম। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, মৃগীরোগ হলেও সন্তান ধারণ, স্বাভাবিক প্রসব সবই সম্ভব। শুধু সন্তান নেওয়ার কমপক্ষে ছয় মাস আগে থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে।অধ্যাপক মালিহা হাকিম বলেন, মৃগীরোগ থাকলে অনেক নারী বিয়ে করতে ভয় পান। তাঁরা ভাবেন, স্বামী ছেড়ে চলে যাবেন বা সন্তান জন্ম দিতে পারবেন না। এ ধারণাগুলো ভুল। শুধু বাচ্চা গর্ভে আসার আগে থেকে এবং সন্তান প্রসবের পর অর্থাৎ পুরো সময় চিকিৎসকের মনিটরিংয়ে থাকতে হবে। বাচ্চা বিকলাঙ্গ যাতে না হয়, সে জন্য প্রয়োজনে চিকিৎসকেরা ওষুধ পাল্টে দেন। চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকলে সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতেও কোনো বাধা নেই। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করলেও চিকিৎসককে তা জানাতে হবে।

শিশুদের ঝুঁকি বেশি
বড়দের তুলনায় শিশুদের (জন্মের সময় জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণ) মৃগীরোগ হওয়ার প্রবণতা বেশি বলে জানান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের শিশু নিউরোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক নারায়ণ সাহা। তিনি বলেন, জন্মের পর এক মাস বয়স থেকে শুরু করে যেকোনো বয়সে এ রোগ হতে পারে। তবে বিশেষ করে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের এ রোগ বেশি হয়।


অধ্যাপক নারায়ণ সাহা শিশুর মৃগীরোগ শনাক্ত করার জন্য অভিভাবকদের শিশুর খিঁচুনির সময় মুঠোফোনে তা ভিডিও করে চিকিৎসকের কাছে নেওয়ার পরামর্শ দেন। এতে চিকিৎসক ভিডিও দেখে রোগটি দ্রুত শনাক্ত করতে পারেন। এর বাইরে বিভিন্ন পরীক্ষা তো আছেই। মৃগীরোগের কিছু ওষুধ শিশুর বুদ্ধির বিকাশ কমিয়ে দিতে পারে—চিকিৎসকেরা তা খেয়াল রেখেই ওষুধ দেন। চিকিৎসায় মৃগীরোগ ভালো হয়—এ সচেতনতা গড়ে উঠলে চিকিৎসার গ্যাপ কমিয়ে আনা সহজ হবে বলে উল্লেখ করেন এই চিকিৎসক।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক কনোজ কুমার বর্মন বলেন, কিছু রোগীর ক্ষেত্রে ওষুধে কোনো কাজ হয় না। তাদের জন্য অস্ত্রোপচার, ডিভাইস লাগানোসহ বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি আছে। আর ৫ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে তাদের রোগটি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তাদের আসলে ভাগ্য খারাপ। তাদের অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে থাকে।

ইনসেপ্‌টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার আশরাফ উদ্দিন আহমেদ জানান, মৃগীরোগীদের যাতে কম মূল্যের ওষুধ দেওয়া যায়, সে বিষয়টি নিয়ে ইনসেপ্‌টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড কাজ করছে। গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ বাজারজাত করার পাশাপাশি সচেতনতা তৈরিতে বুকলেট তৈরিসহ বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা দেওয়ারও আশ্বাস দেন তিনি।গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন ইনসেপ্‌টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের জ্যেষ্ঠ ব্র্যান্ড এক্সিকিউটিভ তাবাসসুম হুদা। সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম স্বাগত বক্তব্য দেন। অতিথিদের ধন্যবাদ দেন সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।

Leave a Comment