কারবালার ইতিহাস ও শিক্ষা

বিশ্ব মুসলিমের নয়নমণি হজরত হোসাইন (রা.) আশুরা দিবসে কারবালা প্রান্তরে ফোরাত নদীর তীরে ইয়াজিদি বাহিনীর হাতে শাহাদাতবরণ করেন আল্লাহর হাবিব আখেরি নবীর প্রিয় দৌহিত্র হজরত আলী (রা.)–এর আদরের দুলাল, জান্নাতি রমণীদের সরদার নবীনন্দিনী হজরত ফাতিমার নন্দন, আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য, জান্নাতি যুবকদের সরদার । বিশ্ব মুসলিমের হৃদয়ে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে এ নির্মম ঘটনা ।

যেখানে বাষট্টি হিজরি সনের মহরম মাসের ১০ তারিখ শুক্রবার হজরত হোসাইন (রা.) অত্যন্ত করুণভাবে শাহাদাতবরণ করেছিলেন। জগতের জানা ইতিহাসে এটি একটি বিয়োগান্ত ঘটনা ‘কারবালা’ ফোরাত নদীর তীরে অবস্থিত একটি প্রান্তর । তবে কারবালা যেন আরবি ‘কারব’ ও ‘বালা’–এর সরলরূপে পরিণত । ‘তেমনি কারব’ মানে সংকট, ‘বালা’ মানে মুসিবত । তবে কারবালার এ হৃদয়বিদারক ঘটনা মহিমাময় মহরম মাসের ঐতিহাসিক মহান আশুরার দিনে সংঘটিত হওয়ায় এতে ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছে । তেমনি আশুরা পেয়েছে ইতিহাসে নতুন পরিচিতি এতে এ শাহাদাতের মাহাত্ম্য যেমন বহুগুণ বেড়েছে । আর তাই আজ আশুরা ও কারবালা সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে ।

একটি সুপ্রাচীন নদী ‘ফোরাত’ কুফার । তবে এ নদীর কূলে অবস্থিত কারবালার প্রান্তর। তখন তাদের পানির একমাত্র উৎস এই ফোরাত নদী, যা উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের বাহিনী ঘিরে রাখে, অবরুদ্ধ করে রাখে নিরস্ত্র অসহায় আহলে বাইতকে আর তাই কারবালা সংকট ও মুসিবতের প্রকৃষ্ট উদাহরণ আর হোসাইনি কাফেলা যখন কারবালায় অবস্থান করছে, । তবে এ নদী থেকে পানি সংগ্রহ করতে গেলে ফুলের মতো নিষ্পাপ দুগ্ধপোষ্য শিশু আলী আসগর এক ফোঁটা পানির জন্য সীমার বাহিনীর তিরের আঘাতে শহীদ হয় । আর সেদিন ফোরাতকূলে ‘পানি! পানি!’ বলে অবর্ণনীয় মাতম উঠেছিল।

ইরাকের একটি বিখ্যাত শহর ‘কুফা’ । তবে পরবতী হজরত আলী (রা.)-এর শাসনামলে খেলাফতের রাজধানী । মুসলিম শাসনের প্রাণকেন্দ্র ছিল মদিনা মুনাওয়ারা আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সময় প্রায় আড়াই বছর খেলাফত পরিচালনা করে ইন্তেকাল করেন নবীজি (সা.)-এর ওফাতের পর প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) । তবে এরপর দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর ফারুক (রা.) ১০ বছর খেলাফতের দায়িত্ব পালন করে শহীদ হন । তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান গনি (রা.) ১২ বছর খেলাফত পরিচালনা করে শাহাদাতবরণ করেন । তবে এ সময় পর্যন্ত ইসলামি খেলাফতের রাজধানী ছিল মদিনা ।

চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.) দুই বছরের শাসনামলে বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি হলে প্রশাসনিক সুবিধা বিবেচনায় তিনি খেলাফতের রাজধানী ইরাকের কুফায় স্থানান্তর করেন তারা । তবে এ সময় কুফা ছিল একটি প্রদেশ এবং কুফার গভর্নর ছিলেন উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ । কারবালার নির্মম ঘটনা সংঘটিত হয় তারই নেতৃত্বে । তবে এই কুফাই পরবর্তীকালে ইসলামের ইতিহাসে ‘কুফা’তে পরিণত হয়েছেন । তবে কুফাবাসী ইয়াজিদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য হজরত হোসাইন (রা.)-কে শত শত পত্রের মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানায় । আর তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি সেখানে আগমন করলে তারা তাঁকে একাকী বিপদের মুখে ফেলে রেখে নিজেরা নীরব ও নিষ্ক্রিয় থাকে ।

বর্তমানে সিরিয়ার রাজধানী ‘দামেস্ক’ । তবে চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.)-এর শাহাদাতের পর হজরত হাসান (রা.) তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন এবং ছয় মাস খেলাফতের দায়িত্ব পালন করে সিরিয়ার গভর্নর হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর কাছে খেলাফতের ভার অর্পণ করেন । আর হজরত মুয়াবিয়া (রা.) প্রশাসনিক সুবিধার্থে রাজধানী দামেস্কে স্থানান্তরিত করেন । তবে সে সূত্রে ইয়াজিদ ক্ষমতাসীন হলে তার রাজধানী দামেস্কেই রয়ে যায়। আর পরবর্তী সময়ে কালক্রমে ইসলামি খেলাফতের রাজধানী তুরস্ক ও মিসরে স্থানান্তরিত হয় । তবে মিসর থেকেই ১৯২৪ সালে ইসলামি খেলাফতের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ও যবনিকাপাত ঘটে ।

আর সত্য ও ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত কারবালার প্রান্তরে প্রতারিত নির্মম নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হোসাইনি কাফেলা চিরস্মরণীয় ও বরণীয়। তবে প্রতিটি মহররম ও প্রতিটি আশুরা আমাদের সত্য ও ন্যায়ের ওপর দৃঢ়পদ থাকার মাহাত্ম্য স্মরণ করিয়ে দেয় । আর জীবনের ব্রত, ত্যাগের শিক্ষা, আত্মমর্যাদাবোধ জাগ্রত করে; ভয়কে জয় করে, নিজের জীবন উৎসর্গ করে, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সহজ পথ ও সুন্দর সমাজ বিনির্মাণ করাই কারবালার শিক্ষা।

Leave a Comment