আসামি জিওন-মেহেদী আবরার হত্যা সাফাই সাক্ষীতে যা বললেন

আসামি মো. মেফতাহুল ইসলাম জিওন ও মেহেদী হাসান রাসেল নিজেদের নির্দোষ দাবি করে আদালতে সাফাই সাক্ষী দিয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা মামলায় । দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামানের আদালতে তারা সাফাই সাক্ষী দেন রোববার (২২ আগস্ট) ঢাকার।

আবরার হত্যা মামলার কোনো ঘটনাই আমার জানা ছিল না এবং কোনো আসামির সঙ্গে কোনো যােগসাজশ ছিল না সাফাই সাক্ষীতে আসামি মেফতাহুল ইসলাম জিওন বলেন এই কথা । আমি বুয়েটে শের-ই-বাংলা হলের ডাইনিংয়ের মেস ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্বে ছিলাম এ মামলার ঘটনার সময়ে । তবে ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর দুপুর আড়াইটার দিকে বাথরুমে যাওয়ার সময় হলের বারান্দায় কয়েকজন বুয়েটের ছাত্র, কয়েকজন পুলিশ ও কয়েকজন সিভিল ড্রেসের লোকজন দেখতে পান । তখন ছাত্রদের মধ্যে একজন আমাকে দেখিয়ে পুলিশকে ইঙ্গিত করলে সেই পুলিশ অফিসার আমার নাম জিজ্ঞাসা করেন ও জানতে চান তিনি ছাত্রলীগ করেন কি-না । তবে তখন আমি নিজেকে ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে পরিচয় দিই । আর এরপর পুলিশ আমাকে তাদের সঙ্গে নিয়ে যান।

জিয়ন আরও বলেন, এরপর মিন্টু রোডের ডিবি সেলে আমাকে বন্দি করে রাখা হয়। এরপর সেই রাতেই আমাকে ডিবি ডিসি জামিলের রুমে নেওয়া হয়। তিনি আমাকে আবরারের মৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। আমি আবরার নামে কাউকে চিনি না ও তার সঙ্গে কখনো কথা হয়নি জানালে ডিসি জামিল অনেক রেগে যান এবং লাঠি দিয়ে আমার পায়ে আঘাত করেন। তিনি আরও বলেন, ২০১৯ সালের ৮ অক্টোবর আমার পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। ওই দিন রাতে আমাকে এডিসি রাজিবের রুমে নেওয়া হয়। তিনি আমাকে আবরাবের ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। তখনও আমি তাকে ওই একই উত্তর দিলে আমাকে থাপ্পড়, ঘুষি মারতে থাকেন এবং একপর্যায়ে তার গলা চেপে ধরে ওয়ালের সঙ্গে ধাক্কা মারেন। এরপর আমাকে কাউন্টার টেরোরিজম সেলে একটি অন্ধকার রুমে একাকী রাখা হয়। পরের দিন ৯ অক্টোবর তাকে আবারও এডিসি রাজিবের রুমে নেওয়া হয়। তিনি হাত ও পা বেঁধে একটি লাঠি দিয়ে আমাকে পেটাতে থাকেন ও বলতে থাকেন, দোষ স্বীকার করবি কি-না বল। আমি তাকে জানাই, ‘স্যার আমি কোনো ঘটনা না জানলে কীভাবে স্বীকার করবো।’

জিয়ন জবানবন্দি জানান, মারধরের ফলে আমার হাতে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়। এ অবস্থায় আমাকে আবারও কাউন্টার টেরোরিজম বিল্ডিংয়ে রেখে আসা হয়। ওই দিন রাতে আমাকে এডিসি আরাফাতের রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাকে ঘটনা সম্পর্কে ফের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তখন আমি কিছু জানি না বলে জানাই এবং মারধরের কারণে হাতের প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে এজন্য কিছু ওষুধপত্র চাই। তখন এডিসি আরাফাত আমাকে বলেন, কিছু না জানলেও সমস্যা নেই। তার কথামতো কয়েকটা কাগজে স্বাক্ষর করলে তাকে আর কেউ টর্চার করবে না, ওষুধও পাবে এবং খুব দ্রুত কোর্ট থেকে জামিন পাবে। তখনও আমি ওই কাগজে স্বাক্ষর করতে রাজি হইনি। তখন আমাকে আবারও সিটি বিল্ডিংয়ে রেখে আসা হয়। ওই রাতে আমাকে ওষুধপত্র তাে দূরের কথা খাবার কিংবা পানিও পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। ক্ষুধা ও হাতের ব্যথায় আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনি বলে জবানবন্দিতে জানান তিনি।

তিনি আরও বলেন, পরদিন ১০ অক্টোবর সকাল বেলা আমার চোখ, হাত বেঁধে সেল থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। এক জায়গায় গিয়ে পা বেঁধে প্রচণ্ড মারধর করা হয়। একপর্যায়ে বুকের ওপর চাপ দিয়ে মাথায় একটি নল ঠেকিয়ে বলেন, ‘তুই যদি কথামতো কাজ না করিস তাহলে আজই তোর শেষ দিন। তোকে আজই ক্রসফায়ার দেওয়া হবে। আর যদি কথামতো কাজ করিস তাহলে তোকে কোনো টর্চার করা হবে না। ওষুধপত্রও পাবি ও খাবার পাবি।’ তখন আমি জীবন বাঁচানোর জন্য ও ওষুধ পাওয়ার জন্য তাদের কথামতো রাজি হই। এরপর আমার পায়ের বাঁধন খুলে অন্য এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। চোখের বাঁধন খোলার পরে আমার সামনে ওয়াহিদুজ্জামানকে দেখতে পাই। তিনি আমাকে কয়েকটি প্রিন্টেড পেপার দিয়ে সেখানে স্বাক্ষর করতে বলেন এবং তাকে আগামীকাল যেখানে নেওয়া হবে সেখানে গিয়েও একই কাজ করতে হবে বলে জানান।

পরের দিন ১১ অক্টোবর সকাল বেলা ওয়াহিদুজ্জামান আমাকে বলেন, ‘তোকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে নেওয়া হবে। সেখানে গিয়ে যেখানে যেখানে স্বাক্ষর করতে বলা হবে সেখানে সেখানে স্বাক্ষর করবি আর ম্যাজিস্ট্রেটকে যদি বলিস তোকে টর্চার করা হয়েছে তাহলে তোকে আবারও রিমান্ডে আনা হবে। আর এবার রিমান্ডে আনা হলে তোকে অবশ্যই ক্রসফায়ার দেওয়া হবে।’ আমাকে পুনরায় রিমান্ড আবেদনের আবেদনপত্রও দেখানো হয়। আদালতে ম্যাজিস্ট্রেট প্রিন্ট করা কাগজ দেন। তারপর সেগুলো নতুন করে স্বাক্ষর করি আমি। এই মামলার সঙ্গে আমি জড়িত না। আমি নির্দোষ।

মেহেদী হাসান রাসেল সাফাই সাক্ষীর জবানবন্দিতে বলেন, বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলাম। আমার ও সভাপতি জামিউস সানীর অধীনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদ অনুমোদিত বুয়েটের ৬টি ছাত্র হল, একটি ছাত্রী হল থেকে ১৫১ সদস্যের কমিটি অনুমোদন হয়। আমাদের দায়িত্ব ছিল সাংগঠনিক গতিশীলতার পাশাপাশি সংগঠন বর্হিভূত কোনো কর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর দুপুর আড়াইটায় শের-ই-বাংলা হল থেকে আইইবিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সেমিনারে যোগদানের উদ্দেশে রওনা করি। রাত ৮টায় সেমিনারের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে।

জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেন, সেখানে আরও আধাঘণ্টা নেতকর্মীদের সঙ্গে আলাপ শেষে উত্তরায় আমার বন্ধু মিরাজুল ইসলামের আইএমএ-এর হোটেলের উদ্দেশে রওনা হই। আমার বন্ধু মিরাজ পিতার মৃত্যুপরবর্তী কুলখানি শেষ করে সেদিনই বগুড়া হতে ঢাকায় আসে। আমি ও মিরাজ একই স্কুল ও কলেজে অধ্যায়ন করেছি। আমি তার পিতার মৃত্যু ও মৃত্যুপরবর্তী কুলখানিতে যোগদান করতে না পারার অপরাধবোধের জন্য সেদিনই তার সাক্ষাতের জন্য রওনা হই। রাত ১০টা নাগাদ আমি তার হোস্টেলে পৌঁছাই।

তিনি বলেন, এরই মধ্যে সভাপতি জামিউস সানি আমাকে জানায়, আগামীকাল প্রধানমন্ত্রী ঢাকেশ্বরী মন্দিরে আসবেন। এটা শুনে রাত ১২টা নাগাদ উত্তরা থেকে হলের দিকে রওনা হই। রাত ১টার পরে আমি হলে প্রবেশ করি। হলে প্রবেশ করে সভাপতির সঙ্গে আগামীকালের গ্রেগ্রামের ব্যাপারে কথা বলি। রাত ৩টার পরে কোনো এক ছাত্র আমাকে জানায়, ভাই নিচে কী যেন হয়েছে। আমার রুম তৃতীয় তলায় থাকায় নিচে নামার সময় দ্বিতীয়তলা ও নিচতলা সিঁড়ির ল্যান্ডিং স্থানে একটি নিথর দেহ ও ডাক্তারকে দেখি। নিচে অনেক ছাত্র ডিএসডব্লিউ স্যার ও প্রভোস্ট স্যারদের দেখি। আমি ২/৩ মিনিটের মতো নিচে অবস্থান করে আমি আমার রুমে চলে আসি।

তিনি আরও বলেন, সকাল ৭টার দিকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চকবাজার থানায় যেতে বলেন। সেখানে যাওয়া মাত্রই পুলিশ আমাকে আটকে রাখেন। সারাদিন কোনো জিজ্ঞাসাবাদ না করে তারা আমাকে আটকে রাখেন। পরের দিন সকাল বেলা আমাকে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে কোর্টে তুলে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। রিমান্ডে আমাকে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা না করে কারাগারে পাঠানো হয়। ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমার কোনো অবস্থান নেই। আমি আদ্যপান্ত কিছুই জানি না। পারিবারিক শত্রুতার কারণে তদন্তকারী কর্মকর্তা ওয়াহিদুজ্জামান আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ সার্বিক সহযোগিতা ও নির্দেশনার অভিযোগ করেছেন। আমি কাউকে সহযোগিতা বা নির্দেশনা দেয়নি। আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ।

ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার জেরে বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে ডেকে নেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। এরপর রাত ৩টার দিকে শেরেবাংলা হলের নিচতলা ও দোতলার সিঁড়ির করিডোর থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরদিন ৭ অক্টোবর দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে আবরার ফাহাদের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। নিহত আবরার বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে থাকতেন তিনি। ওই ঘটনায় নিহতের বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে চকবাজার থানায় ১৯ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ওয়াহিদুজ্জামান।

অভিযুক্ত ২৫ জনের মধ্যে এজাহারভুক্ত ১৯ জন ও তদন্তেপ্রাপ্ত আরও ছয়জন রয়েছেন। এজাহারভুক্ত ১৯ জনের মধ্যে ১৬ জন ও এজাহারবহির্ভূত ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারদের মধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন আটজন। গ্রেফতার ২২ জন হলেন- মেহেদী হাসান রাসেল, মো. অনিক সরকার, ইফতি মোশাররফ সকাল, মো. মেহেদী হাসান রাসেল, মো. মেফতাহুল ইসলাম জিওন, মুনতাসির আলম জেমি, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভির, মো. মুজাহিদুর রহমান, মুহতাসিম ফুয়াদ, মো. মনিরুজ্জামান মনির, মো. আকাশ হোসেন, হোসেন মোহাম্মদ তোহা, মাজেদুর রহমান, শামীম বিল্লাহ, মোয়াজ আবু হুরায়রা, এ এস এম নাজমুস সাদাত, ইসতিয়াক আহম্মেদ মুন্না, অমিত সাহা, মো. মিজানুর রহমান ওরফে মিজান, শামসুল আরেফিন রাফাত, মোর্শেদ অমত্য ইসলাম ও এস এম মাহমুদ সেতু।

মামলার তিনজন আসামি এখনও পলাতক রয়েছেন । তারা হলেন- মোর্শেদুজ্জামান জিসান, এহতেশামুল রাব্বি তানিম ও মোস্তবা রাফিদ। তাদের মধ্যে প্রথম দুজন এজাহারভুক্ত ও শেষের জন এজাহারবহির্ভূত আসামি । ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। মামলায় ৬০ জন সাক্ষীর মধ্যে ৪৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে ।

Leave a Comment