অতি জযবাঃ হারিয়ে যাওয়ার প্রথম উপসর্গ

অতি জযবাঃ হারিয়ে যাওয়ার প্রথম উপসর্গ

১.
আমাদের এক বড় ভাই কিছু দূর মাদরাসায় পড়ার পর চিন্তা করলেন কারিয়ানা পড়বেন। যেই ভাবা সেই কাজ, চলে গেলেন মমিন বাড়ি মাদরাসায়। ফিরে এলেন বহুদিন পর। ফিরে এসে কয়েকদিন ভালোই চলল। এরপর বাঁধল বিপত্তি। ওনি এলাকার কোনো মসজিদে নামাজ পড়তে যান না। কারণ জানতে চাইলে বললেন, এলাকার কোনো ইমামের পড়াই নাকি তেমন শুদ্ধ না। হরফের উচ্চারণ, মদ ও গুন্নাহর সঠিক ব্যবহার আর সিফাতে সহ নানা সমস্যা। ওনি তাদের পিছে নামাজ পড়ে মজা পান না। অথচ প্রায় সব ইমাম সাহেবই কওমি থেকে হিফজ ও দাওরা শেষ করা আলিম। এক মুরুব্বী জিজ্ঞাসা করল, মুমিন বাড়ি মাদরাসার হুজুররা যখন এদিক সেদিক যায়, তারা কি সেই এলাকার ইমামের পিছে নামাজ পড়ে নাকি একা একা পড়ে? ভাইয়ের কোনো জবাব নাই।
শেষ পর্যন্ত ভাইয়ের আর মমিন বাড়ির পড়াশোনা শেষ হল না। কিন্তু মসজিদে নামাজ পড়ার অভ্যাসটাও আর ফিরে এলো না। মানুষজন জামাতে নামাজ পড়তে যায়। ভাই টুপি জুব্বা নিয়ে ক্যারাম বোর্ডে ব্যস্ত থাকেন।

২.
আমাদের এক সাথী ভাই। তিন চিল্লা দিয়ে এসেছেন। জামাতে খুব আমল হয়েছে। ভালো মুজাকারা হয়েছে। মেহনত হয়েছে। ফিরে আসার কিছুদিন পর শুরু হল ভাইয়ের যন্ত্রণা। সাথীদের অলসতা, উসূল, আদব আর আখলাক সহ হেন কোন বিষয় নাই যেটা নিয়ে ওনি বিরক্ত হন না। ইমাম সাহেব তালিমে বসে না। মাদরাসাওয়ালারা দাওয়াতের মেহনত করে না। কঠিন এক অবস্থা! পুরনো সাথীরা বোঝায়, সেও তাদের বোঝায়। এভাবে বোঝাবুঝি চলতে একদিন ভাইটি হারিয়ে গেলো! গেলো তো গেলো, এমনভাবেই গেলো যে, ভাইকে দেখলে এখন আর বোঝার উপায় নেই, ওনি তিন চিল্লার সাথী।

৩.
দুই সপ্তাহ আগের কথা। এক মসজিদে তাবলীগের সাথীদের সাথে কিছু মুজাকারা ছিল। বাদ মাগরিব। বয়ানের পর অজু ইসতিনজা সেরে এশার জামাতের উদ্দেশ্যে বসে আছি। এক ভাই এসে সালাম মুসাফাহা করে একটা ‘ভাঁজপত্র’ দিল। শিরোণাম ‘তাবলীগের সাথীদের উদ্দেশ্যে কয়েকটি অনুরোধ’। উল্টেপাল্টে দেখি দাওয়াতুল হকের ভাইদের পক্ষ থেকে লেখা। জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কি আপনাদের মুরুব্বীদের কাউকে দেখিয়েছেন? বলল, না। সেভাবে দেখায়নি তবে লেখাগুলো একজন আলেম লিখেছেন।
বললাম, তা তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু আপনাদের মুরুব্বীর নির্দেশনা ছাড়া বা তাবলীগের মুরুব্বীদের না দেখিয়ে সাধরণ সাথীদের দিলে ফিতনা হতে পারে।
বলল, ফিতনা হবে কেনো? এখানে কি খারাপ কিছু আছে? কথাগুলো তো ভালো এবং ঠিক।
বললাম, তা বুঝলাম। কিন্তু তাবলীগের সাথীদের ইসলাহের ফিকির আপনাদের কাঁধে কে দিয়েছে? আপনারা দাওয়াতুল হকে নিজেদের ইসলাহের জন্য গিয়েছেন নাকি অন্যের? দাওয়াতুল হকের কোনো মুরুব্বী কি এভাবে অন্য কোনো মেহনতের জামাতকে উদ্দেশ্য করে সরাসরি কোনো নসিহত নামা লিখেছেন?
লোকটা মন খারাপ করে চলে গেলো। যেতে যেতে আমাকে নিশ্চয়ই গোঁয়ার অবুঝ নাদান ভাবতে ভাবতে চলে গেছে। অবশ্য তার এই ধারণা একেবারে অমূলক নয়।

৪.
আমার পরিচিত এক প্রফেসর। ২০০৩ সালের দিকে হঠাৎ চরমোনাই ঘুরে এসে আমাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুললেন। অমুক দল কেনো জিকিরে বসে না? তমুক জামাত কেনো জিকির করে না? অমুক তমুক কেনো কারও কাছে বায়আত হয় না? তাসাউফের সিলসিলা ছাড়া আমল করে লাভ কী? নানান কিছু। এখন সবাই ঠিক আছে। শুধু স্যার হারিয়ে গেছেন।

৫.
অনেক ভাইকেই দেখেছি দ্বীন শেখার জন্য এসো আরবি শিখি বা দ্বীনি বই পুস্তকাদি নিয়ে উস্তাদের শরণাপন্ন। কিছুদিন পড়াশোনা করার পর ওনারা বিশাল ঝামেলায় পড়ে যান। যেদিকেই তাকান শুধু ভুল আর ভুল দেখেন। আকিদায় ভুল, আমলে ভুল, মানহাজে ভুল, মাসলাকে ভুল। খালি ভুল আর ভুল। তখন আর স্থির থাকতে পারেন না। সবার ভুল শোধরানোর বিশাল দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে চক্কর দিতে থাকেন। এই বোঝা বয়ে নেয়া যতটা কঠিন, তারচেয়ে অনেক কঠিন তখন নামিয়ে রাখা। শেষ পর্যন্ত নিজের ইসলাহটা আর হয় না।

দীন মূলত অমূল্য এক রত্ন। তবে এটা প্রথমে বালি মিশ্রিত পানির ফোটা আঁকারে প্রবেশ করে। নানা জ্বালা যন্ত্রণা দিয়ে সুন্দর পরিণতিতে পৌঁছে। তার আগে পথ হারালে বিরাট বিপদ। তাই দীন জানা ও বোঝার সফরে উপযুক্ত মুসলিহের সান্নিধ্য, ধৈর্য্য ও স্থিরতা আবশ্যক। যে কোনো আপত্তি, প্রশ্ন ও সংশয় নিজের মুসলিহ উস্তাদের কাছে করা চাই। উস্তাদের অনুমতি ছাড়া কোথাও কারও ইসলাহের ফিকির বা তর্কে না যাওয়া চাই। বড়জোড় দাওয়াত দেয়া যায়। হারাম ও বিদআত হলে এ বিষয়ে মুহাক্কিক আলিমদের রায় জানিয়ে দেয়া যায়। কিতাবাদি হাদিয়া দেয়া যায়।

আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের শামিয়ানা তলে থাকার জন্য আদব ইহতিরামের পাশাপাশি ধৈর্য্য ও হজম ক্ষমতা থাকা চাই। এই শামিয়ানার ছায়ায় বসেই আমাদের সালাফগণ হালাল হারাম নিয়ে দ্বিমত করেছেন। কিন্তু একে অন্যকে ফাসেক বলেননি। আকিদা নিয়ে দ্বিমত করেছেন। কিন্তু একে অন্যকে কাফির বলেননি। আবার এই জামাআতের বাহিরের কাউকে ওনারা প্রশ্রয়ও দেননি। এতটুকু বোধ অর্জন করতেও পাড়ি দিতে হবে বহুদূর। তার আগ পর্যন্ত একটু সামলে চলা শিখতে হবে। থামতে জানতে হবে। উস্তাদের দিকে রুজু করা জানতে হবে।

তা না হলে অতি জযবা আপনাকে জনবিচ্ছিন্ন করে দিবে। গন্তব্য হারা করে দিবে। এই পথ পেয়ে হারালে ফিরে আসা বড় কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। আল্লাহ হেফাজত ফরমান।

আল্লাহু আ’লামু বিস-সাওয়াব।

লিখেছেনঃ মুহতারাম আহমাদ ইউসুফ শরীফ।

Leave a Comment