বিভিন্ন কেলেঙ্কারি ও অনিয়ম-জালিয়াতি আর নানা অব্যবস্থাপনায় দেওয়া ঋণ আদায় করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। লাগামহীন বাড়ছে খেলাপি ঋণ। ফলে মন্দ ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে গিয়ে বড় আকারে মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে সরকারি-বেসরকারি ১১টি ব্যাংক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রাহকের আমানতের অর্থ থেকে ব্যাংকগুলো ঋণ দেয়। সেই ঋণ খারাপ হয়ে পড়লে আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট হারে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়। আবার খারাপ ঋণের ওপর অতিরিক্ত মূলধন রাখার বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। কাঙ্ক্ষিত মুনাফা করতে না পারা ও লাগামহীন খেলাপি ঋণের কারণে দীর্ঘদিন ধরে বেশকিছু ব্যাংক মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না। ফলে মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে।
চলতি অর্থবছের দ্বিতীয় প্রান্তিকে জুন মাস শেষে প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে দেশের ১১টি ব্যাংক। এসব ব্যাংকের মধ্যে সরকারি ব্যাংক রয়েছে পাঁচটি, বিশেষায়িত দুটি এবং বেসরকারি খাতের রয়েছে চারটি।
চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত এই ১১ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ২৪ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা। তবে তিন মাসের ব্যবধানে জুনে ১১ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৯০৫ কোটি টাকা কমে দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকায়। অর্থাৎ গত প্রান্তিকের (মার্চ প্রান্তিক) চেয়ে জুনে ঘাটতি ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ কমেছে।
আন্তর্জাতিক ব্যাসেল-৩ নীতিমালার আলোকে ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়মিত মূলধন সংরক্ষণ করতে হয় ব্যাংকগুলোকে। একটি ব্যাংকের মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ বা ৪০০ কোটি টাকার মধ্যে যেটি বেশি, সেটির ন্যূনতম পরিমাণ হিসাবে মূলধন রাখতে হয়। যদি কোনো একটি ব্যাংক এ পরিমাণ অর্থ সংরক্ষণে ব্যর্থ হয় তবে তা মূলধন ঘাটতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের জুন মাস শেষে মূলধন সংরক্ষণ করতে পারেনি ১১ ব্যাংক। তবে আলোচিত সময়ে বেশিরভাগ ব্যাংকের মূলধন উদ্বৃত্ত থাকায় সার্বিক ব্যাংক খাতে মূলধন উদ্বৃত্ত রয়েছে ১৬ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এ সময়ে মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকায়।
সরকারি পাঁচটি ব্যাংকের প্রায় ৮ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি রয়েছে। এরমধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকের ১ হাজার ৯২৭ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের ৩৪৫ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের ৬৬৪ কোটি টাকা এবং সোনালী ব্যাংকের ৩ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা।
বেসরকারি চারটি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি তিন হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। এরমধ্যে এবি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৩২৯ কোটি টাকা, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ১ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা, আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ১ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা ও পদ্মা ব্যাংকের ৪৬১ কোটি টাকা।
বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি রয়েছে ১৩ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। এরমধ্যে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি রয়েছে ১১ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ১ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা।
চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণ হয়েছে ১১ লাখ ৩৯ হাজার ৭৭৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। বিতরণকৃত এসব ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৯৮ হাজার ১৬৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা। যা মোট ঋণ বিতরণের ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। নিয়ম অনুযায়ী খেলাপির বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে গিয়ে মূলধন ঘাটতি হয়েছে। সরকারি ব্যাংকগুলোতে এ হার বেশি। এর মূল কারণ এসব ব্যাংকে সুশাসনের অভাব রয়েছে। তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই।
এখন ঘাটতি কমাতে হলে ঋণ আদায়ে জোর দিতে হবে। দক্ষতা বাড়াতে হবে। সরকারি ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাব কমাতে হবে। একই সঙ্গে নতুন ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই করে দিতে হবে, যাতে নতুন করে আর খেলাপি ঋণ না বাড়ে। তাহলেই অবস্থা উন্নতি হবে- বলে মনে করেন সাবেক এ গভর্নর।