সাংবাদিকতার চরম পর্যায়ে বাংলাদেশ

সাংবাদিকতার চরম পর্যায়ে বাংলাদেশ

সিলেটের এক পত্রিকা শিরোনাম করেছে- “এমসি কলেজের মেধাবী ছাত্র অমুক বিসিএস পরীক্ষা দিচ্ছে।”
ওই শিরোনামে তার ছবিটাও যুক্ত করে দেয়া হয়েছে।
ভাবখানা এমন- বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে তিনি “হিরো” হয়ে গিয়েছেন। পত্রিকায় এই জন্য ছবি’সহ তার বিসিএস পরীক্ষা দেয়ার খবর ছাপাতে হচ্ছে।
আজকাল প্রায়’ই দেখি- অমুক বিসিএস ক্যাডার ফেসবুকে ছবি আপলোড করলে হাজার হাজার লাইক-কমেন্ট! তমুক বিসিএস ক্যাডার “হ্যালো”, “গুড মর্নিং” লিখে ফেসবুকে পোস্ট করলেও লাখ লাখ মানুষ ঝাপিয়ে পড়ে সেখানে তার প্রশংসা করতে।
বিসিএস ক্যাডার’দের আমি এতে কোন দোষ দেখতে পাচ্ছি না। দোষ হচ্ছে পত্রিকার সাংবাদিক গুলো যারা বিসিএস ক্যাডার কিংবা এই চাকরিটাকে রীতিমত বিশাল কিছু বানিয়ে ফেলেছেন।
গত শতাব্দী’তে আমরা যখন বড় হয়েছি, তখনও ব্যাপারটা এমন ছিল না। অন্তত আমি কিংবা আমার আশপাশের বন্ধ-বান্ধবরা কখনো এমন ধারণা নিয়ে বড় হইনি- বিসিএস ক্যাডার মানে “হিরো।”
অথচ আজকাল প্রায়’ই পত্রিকা গুলো খুললে বিসিএস ক্যাডারদের সাফল্য, তারা কিভাবে পড়ে, কিভাবে খায়, কি চিন্তা করে; কিভাবে চুলের ফ্যাশন করে; কোন জামা-কাপড় পড়ে সব’ই সেখানে পাওয়া যায়।
বিসিএস ক্যাডার হয়ে গিয়েছে এই দেশের মানুষজনের “হিরো!”
আরেক দল তো আরও এক ধাপ উপরে!
এরা পুলিশ অফিসার অনেক সৎ, এই নিয়ে স্টোরি বানায়। খবর ছাপে।
কোন ট্যাক্স কর্মকর্তা ঘুষ খায় না, কোন ম্যাজিস্ট্রেট রাস্তায় নেমে ফিল্ডে কাজ করে ইত্যাদি আরও কতো রকম স্টোরি!
এইসব সাংবাদিকের মাথায় এই সামান্য ঘিলু টুকু নেই- এই গুলো তো সরকারি কর্তাদের কাজ। তাদের এই কাজের জন্যই নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আমাদের ট্যাক্সের টাকায় তাদের বেতন দেয়া হয়।
এইসব কাজ করে তাদের “হিরো” হবার কথা নয়।
এইসব লিখে লিখে আপনারা কি করছেন জানেন? বিসিএস ক্যাডারদের রীতিমত মাথায় তুলে ফেলছেন। তাদেরকে “স্যার” না ডাকলে তারা মানুষজনকে চড় মেরে বসছে! কিংবা নিজেদের এলাকায় নিজদেরকে “সম্রাট” মনে করছে।
অথচ গতকাল’ই আমি এই দেশের সরকারি অফিসে গিয়েছি। সরকারি কর্তা চেয়ার থেকে উঠে বসে আমাকে স্বাগত জানিয়েছে। এরপর আমি যা যা জানতে চেয়েছি, প্রতিটা কথার উত্তর দিয়েছে। শুধু তা’ই না, উল্টো কষ্ট করে আমাকে যে তাদের অফিসে যেতে হলো, সেই জন্য আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে এবং আসার সময় আমার হাতে একটা চকলেট ধরিয়ে দিয়েছে।
আর আমরা কিনা সরকারি কর্তাদের রীতিমত “হিরো” বানিয়ে ফেলছি।
আমার ঠিক জানা নেই, জগতের আর কোন দেশে এই পরিস্থিতি আছে কিনা।
কোথায় আমাদের উৎসাহ দেয়া উচিত পরবর্তী প্রজন্ম যাতে জ্ঞান-বিজ্ঞানে আগ্রহী হয়ে ভালো কিছু করতে পারে। সেখানে আমরা উৎসাহ দিচ্ছি বিসিএস ক্যাডার হয়ে “হিরো” হও!
মাত্র ১২ লাখ জনসংখ্যার আমার এখানকার এই দেশের ৩টা বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর সেরা পাঁচশো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থান পাচ্ছে আর ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশটির কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম গন্ধও খুঁজে পাওয়া যায় না!
আমরা “বিসিএস মেধাবী” পাচ্ছি প্রতি বছর। যারা হিরো হয়ে যাচ্ছে। আর এখন তো বিসিএস পরীক্ষা দিয়েই পত্রিকার শিরোনাম হওয়া যাচ্ছে!
একটা বাস্তব গল্প বলি।
সপ্তাহ কয়েক আগের কথা। গলফ খেলার কিংবদন্তী টাইগার উডস গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে। আমি সিএনএন এ সরাসরি সে সংবাদ দেখে আমার এক পরিচিত জন, যিনি কিনা বিসিএস ক্যাডার; তাকে বললাম
-টাইগার উডস এক্সিডেন্ট করেছে।
আমি তাকে বলেছিলাম; কারন আমার খুব খারাপ লাগছিলো ওই সংবাদ শুনে। তো, তিনি আমাকে প্রশ্ন করেছেন
-টাইগার উডস কে?
উনার প্রশ্ন শুনে আমার চোখ কপালে উঠার জোগাড়! তিনি টাইগার উডস কে, সেটা জানেন না!
আমি তাকে বললাম
-বিসিএস সাধারণ জ্ঞান পড়ার সময় বোধকরি এই প্রশ্নটা ছিল না। তাই না?
ভদ্রলোক আর কিছু বলেন’নি।
এই হচ্ছে আমাদের সাধারণ জ্ঞান জানা বিরাট মেধাবী “বিসিএস” ক্যাডার সমাজ।
এরা কোন দেশের রাজধানী কোথায়, কোন দেশে মুদ্রার নাম কি। কোন গাছ পৃথিবীর সব চাইতে লম্বা ইত্যাদি মুখস্ত করে মেধাবী হয়ে যাচ্ছে! অথচ এইসবের বাইরে অতি সাধারণ কিছু জিজ্ঞেস করুন; দেখবেন হয়ত বলতে পারছে না।
আমার ঠিক জানা নেই, ঠিক কোন কারনে আমরা এভাবে মেধাবী নির্ধারণ করছি। এটাই হয়ে গিয়েছে আমাদের মেধা নির্ধারণ করার মাপকাঠি।
যেই দেশে আজকাল বিসিএস পরীক্ষা দিয়েই পত্রিকার শিরোনাম হওয়া আচ্ছে; সেই দেশের ভবিষ্যৎ ঠিক কোন পথে এগুচ্ছে সেটা বুঝার জন্য অবশ্য “মেধাবী” হবার প্রয়োজন নেই।

লিখেছেনঃ আমিনুল ইসলাম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *