পুরুষের অর্ধেক বেতনে কাজ করেন ১২ হাজার নারী শ্রমিক

কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলের নাজিরারটেক এলাকায় গড়ে উঠেছে দেশের সবচেয়ে বড় শুঁটকিমহাল। সেখানে ছোট–বড় ৯৫০টি মহাল রয়েছে। মহালগুলোতে শুঁটকি উৎপাদনে অন্তত ২০ হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। তাঁদের মধ্যে অন্তত ১২ হাজার নারী। সমান কাজ করেও নারী শ্রমিকদের বেতন দেওয়া হয় পুরুষের অর্ধেক। অর্থাৎ সারা দিন কাজ করে একজন পুরুষ যেখানে ৭০০ টাকা মজুরি পান, সেখানে নারী শ্রমিক পাচ্ছেন ৩৫০ টাকা। বেতনবৈষম্য নিয়ে নারীদের মধ্যে তেমন জোরালো কোনো প্রতিবাদ নেই। নারীদের ভাষ্য, পেটের দায়ে শুঁটকিমহালের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন তাঁরা। বেশি বেতনের দাবিতে হইচই করলেই তাঁদের চাকরি হারাতে হয়। আর চাকরি ছাড়া সংসার চালানো খুব কষ্টের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুজন নারী শ্রমিক বলেন, শুঁটকিমহালে কর্মরত কম বয়সী নারীরা প্রায় সময় যৌন হয়রানির শিকার হয়। সকালে বাড়ি থেকে মহালে আসা এবং সন্ধ্যায় মহাল থেকে বাড়ি ফেরার ক্ষেত্রে পুরুষের উত্ত্যক্তের শিকার হতে হয় তাদের। নিরাপত্তার অভাবে বাড়িতে বিয়ের উপযুক্ত মেয়েদের একাকী রেখে আসাও সম্ভব হয় না। মহাল থেকে প্রতিবছর ২৫০ কোটি টাকার শুঁটকি উৎপাদিত হলেও নারীর অবদানকে সেভাবে স্বীকার করা হয় না।
গত সোমবার বেলা ১১টায় নাজিরারটেক উপকূলের মহালগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, চারদিকে শুঁটকি উৎপাদনের ধুম। গভীর সাগর থেকে মাছ ধরে কিছু ট্রলার ঘাটে ভিড়ছে। ব্যবসায়ীরা সেই ট্রলারের মাছ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন মহালে। তারপর সেই মাছ কেটে, ধুয়ে বাঁশের মাচায় টাঙানো হচ্ছে। রোদে শুকানোর পরে কাঁচা মাছ হয়ে ওঠে শুঁটকি।

নাজিরারটেকের উত্তর দিকে ‘কায়সার এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি শুঁটকিমহাল। মহালের মধ্যে খোলা মাঠে ২০-৩০টি বাঁশের মাচায় নানা প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ শুকানো হচ্ছে। নারী শ্রমিকেরা মাছগুলো নাড়াচাড়া করছেন। জ্যোৎস্না আকতার (৩৫) নামের একজন নারী শ্রমিক বলেন, সকাল সাতটার দিকে তিনি বাড়ি থেকে শুঁটকিমহালে আসেন। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত প্রায় ১০ ঘণ্টা কাজ করে মজুরি পান ৩৫০ টাকা। মাঝে দুপুরের খাবারের জন্য ঘণ্টা দেড়েক সময় পাওয়া যায়। অথচ তাঁদের তুলনায় কম কাজ করেও পুরুষ শ্রমিকেরা মজুরি পান ৭০০ টাকা। এ নিয়ে প্রতিবাদ করলে চাকরি হারাতে হয় বলে জানান তিনি।

ওই মহালের মালিক কায়সার উদ্দিন বলেন, তাঁর মহালে এক দিনে দেড় হাজার কেজি শুঁটকি উৎপাদিত হয়। বিকেলে ট্রাক বোঝাই করে এসব শুঁটকি চট্টগ্রামে পাঠানো হয়। নারী শ্রমিকদের বেতনবৈষম্যের বিষয়ে তিনি বলেন, পুরুষের মতো ভারী কাজ নারীরা করতে পারেন না। তাই তাঁদের বেতনও কম।শাহ আমানত এন্টারপ্রাইজ’ নামে আরেকটি মহালে শুঁটকি উৎপাদন করছেন আরও ২৩ শ্রমিক। তাঁদের মধ্যে ১২ জন নারী। সেখানে আমেনা খাতুন নামের এক শ্রমিক বলেন, পুরুষের অর্ধেক বেতন হলেও তাঁকে কাজ করতে হয়। অন্যথায় সংসারে তাঁর চার ছেলেমেয়ে নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে।

আমেনার বাড়ি মহেশখালীর কুতুবজোম এলাকায়। আট বছর আগে বঙ্গোপসাগরে ট্রলারডুবিতে তাঁর স্বামী নিখোঁজ হন। এখন পর্যন্ত তাঁর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। বাধ্য হয়ে সংসারে হাল ধরতে তিনি কক্সবাজার শহরে চলে আসেন। তিন বছর ধরে শুঁটকিমহালে কাজ করছেন।আরেকটি মহালে কাজ করছেন রংপুরের সালমা ইয়াসমিন। পাঁচ বছর আগে স্বামী অন্য নারীর সঙ্গে আলাদা ঘর বেঁধেছেন। থাকেন চট্টগ্রামের হালিশহর। সংসারের বোঝা টানতে সালমা কাজ নেন শুঁটকিমহালে। সারা দিন কাজ করে ৩৫০ টাকা বেতন পান। তা দিয়েই চলছে তাঁর টানাপোড়েনের সংসার। কাজ না পেলে না খেয়ে থাকতে হয় বলে জানান তিনি।

কক্সবাজার পৌরসভার ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের নাজিরারটেক উপকূলের কুতুবদিয়াপাড়া, সমিতিপাড়া, ফদনারডেইল, মোস্তাইক্যাপাড়া, বাসিন্যাপাড়া, নুনিয়াছটা, সিসিডিবি, পানিরকূপ পাড়াসহ মোট ১৮টি গ্রাম নিয়ে দেশের বৃহৎ শুঁটকিমহালটি গড়ে উঠেছে। এসব গ্রামে বাস করেন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা অন্তত ৭০ হাজার মানুষ।পৌরসভার প্যানেল মেয়র ও সংরক্ষিত ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শাহীন আক্তার  বলেন, ৭০ হাজার শ্রমজীবী মানুষের ৯০ শতাংশই জলবায়ু উদ্বাস্তু। এর মধ্যে অন্তত ১২ হাজার নারী শুঁটকিমহালে কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। কিন্তু নারীদের মজুরি দেওয়া হয় পুরুষের বেতনের অর্ধেক।

শুঁটকিমহাল নিয়ন্ত্রণ করে ‘নাজিরারটেক মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি’। তাদের সদস্যসংখ্যা ১ হাজার ১১৭। সমিতির সভাপতি আতিক উল্লাহ বলেন, বর্তমানে ছোট–বড় ৯৫০টি শুঁটকিমহালে কাজ করছেন ২০ হাজারের বেশি শ্রমিক। এর মধ্যে নারী শ্রমিক প্রায় ১২ হাজার। পুরুষের দৈনিক মজুরি ৭০০-৮০০ টাকা হলেও নারীদের দেওয়া হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা। কারণ জানতে চাইলে আতিক উল্লাহ বলেন, ‘যুগ যুগ ধরে এ নিয়ম চলে আসছে। তা ছাড়া পুরুষের মতো নারীরা ভারী কাজ করতে পারেন না। শারীরিকভাবেও তাঁরা ফিট নন।’

কক্সবাজারে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করে ‘বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক’ নামে একটি বেসরকারি সংগঠন। সংগঠনের সভাপতি শামীম আকতার  বলেন, পুরুষের চেয়ে বেশি কাজ করে শুঁটকিমহালের কর্মজীবী নারীরা অর্ধেক বেতন পাচ্ছেন। এটা সমাজের জন্য খারাপ দৃষ্টান্ত। অধিকার আদায়ে সেখানে (মহালে) কোনো নারী সংগঠনও নেই।জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম খালেকুজ্জামান বলেন, গত মৌসুমে জেলায় ২০ হাজার ৬৩৭ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদিত হয়েছিল। এবার শুঁটকির উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬ হাজার মেট্রিক টন। যার বাজারমূল্য ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে নারীর অবদান উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।

Leave a Comment