আফগানিস্তানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিকা সহ ৪ নারীকে হত্যা

আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় মাজার-ই-শরীফ শহরের একটি বাড়ি থেকে চার জন নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিকা এবং নারী অধিকারর্মী রয়েছেন, যার নাম ফ্রোজান সাফি। গত আগস্টে তালেবানরা ক্ষমতা দখলের পর এই প্রথম আফগানিস্তানে কোনো নারী অধিকার কর্মীকে হত্যার ঘটনা ঘটল।

গুলিতে ওই নারীর শরীর পুরোপুরি ঝাঝরা করে দেওয়া হয়। ‘আমরা তাকে তার পোশাক দেখে চিনতে পেরেছি। বুলেট তার চেহারা নষ্ট করে দিয়েছে,’ বলেছেন সাফির বোন রিতা, যিনি একজন চিকিৎসক।

‘তার মাথায়, হৃদপিন্ড, বুকে, কিডনি এবং পায়ে অসংখ্য গুলির ক্ষত ছিল, যা গণনা করার মতো নয়, এতো বেশি। তার বাগদানের আংটি এবং ব্যাগ দুটোই নিয়ে গেছে,’ যোগ করেন রিতা।

ওই চার নারীকে হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে দুইজনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তালেবানের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র কারি সায়েদ খোস্তি।

তিনি বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ওই দুই ব্যক্তি ওই নারীদের সেই বাড়িতে ডেকে নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। এ ব্যাপারে তদন্ত শুরু হয়েছে। আটকদের আদালতে তোলা হয়েছে।

খোস্তি নিহতদের পরিচয় জানাননি। তবে মাজার-ই-শরীফের এক সূত্র ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে ফ্রোজান সাফি নামে একজন নারী অধিকারকর্মী এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিকা রয়েছেন।

মাজার-ই-শরীফের তিনটি সূত্র এএফপিকে জানিয়েছেন, তারা শুনেছেন যে ওই নারীরা একটি ফোন কল পেয়েছিলেন। কেউ হয়তো তাদেরকে উদ্ধার ফ্লাইটে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তাদেরকে আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করার কথা বলেছিল। এরপর একটি গাড়িতে করে তাদের তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু পরে তাদের মরদেহ পাওয়া যায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক আন্তর্জাতিক সংস্থার একজন নারী কর্মী এএফপিকে বলেন, ‘আমি ওই নারীদের একজনকে চিনতাম, ফ্রোজান সাফি। তিনি একজন নারী অধিকার কর্মীও ছিলেন, শহরে বেশ পরিচিত মুখ ছিলেন’।

ওই নারী কর্মী আরও বলেন যে, তিন সপ্তাহ আগে তিনি নিজেই একজনের কাছ থেকে এমন একটি ফোন কল পেয়েছিলেন। তাকে বিদেশে নিরাপদে চলে যাওয়ার প্রচেষ্টায় সহায়তা দেওয়ার ভান করেছিল সেই ব্যক্তি।

আন্তর্জাতিক সংস্থার ওই নারী কর্মী বলেন, ‘তিনি আমার সম্পর্কে সমস্ত তথ্য জানতেন, আমাকে আমার কাগজ-পত্র পাঠাতে বলেছিলেন, আমাকে দিয়ে একটি প্রশ্নপত্র পূরণ করাতে চেয়েছিলেন। তিনি আমাকে উদ্ধারের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তথ্য দেওয়ার দায়িত্বে থাকা আমার অফিসের একজন কর্মকর্তার ভান করেছিলেন’।

সন্দেহজনক হওয়ার পরে তিনি ওই কলকারীকে ব্লক করেন এবং এখন ভয়ের মধ্যে বসবাস করছেন। এই চার নারীর হত্যাকাণ্ডের কথা শুনে তিনি হতবাক হয়ে যান।

তিনি বলেন, ‘আমি আগে থেকেই ভয় পেয়েছিলাম। আমার মানসিক স্বাস্থ্য আজকাল ভালো নেই। আমি সবসময় ভয়ে থাকি যে কেউ হয়তো আমার দরজায় এসে আমাকে কোথাও নিয়ে গিয়ে গুলি করে মেরে ফেলবে’।

২০ বছর পর মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীকে হঠিয়ে চলতি বছরের আগস্টে দ্বিতীয় দফায় আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে তালেবান।

প্রথম দফার শাসনামলে তালেবান সমগ্র আফগানিস্তানে ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল। সে সময় নারীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল। এছাড়া তালেবান সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তখন কড়াকড়ি ভাবে বোরকা পরে মেয়েদের বাইরে বের হওয়ার নির্দেশনা জারি করা হয়। নারীরা কোনো পুরুষ আত্মীয় ছাড়া বাইরে যেতে পারতো না। কেউ এই নির্দেশ না মানলে জনসম্মুখে বেত্রাঘাতের মতো নির্মম শাস্তি পেতে হতো।

তবে গত ১৫ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতা দখলের পর রক্ষণশীল মনোভাব থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছে তালেবান। কিন্তু নারীদের কাজে কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার অনুমতি এখনো দেয়নি তালেবান। তালেবানরা কাবুল দখল নেওয়ার পর থেকেই নিজেদের অধিকারের দাবিতে নারীরা আফগানিস্তানের প্রধান প্রধান শহরগুলোতে বিক্ষোভ করছে। তালেবানের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মন্ত্রিসভায় কোনো নারীকে পদ না দেওয়ার প্রতিবাদে কাবুলেও বিক্ষোভ করেছে নারীরা। কাবুলসহ বিভিন্ন বড় শহরগুলোতে বিক্ষোভ হয়েছে মেয়েদের হাইস্কুলে ফিরতে দেওয়ার দাবিতেও।

ত্রাণকর্মী হিসেবে কাজ করতে পারবেনা নারীরা, তালেবানের নতুন ঘোষণা

নারীরা ত্রাণকর্মী হিসেবে কাজ করতে পারবে না বলে নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে তালেবান। শনিবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডাব্লিউ) এ খবর জানিয়েছে।

এ ব্যাপারে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নারী অধিকার বিষয়ক বিভাগের পরিচালক হিদার বার জানান, ত্রাণ বিতরণ করার কাজে নারীদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে তালেবান। এর ফলে অনেকেই খাবার ও ওষুধ পাচ্ছেন না। আফগানিস্তানে মানবিকতার খাতিরে দুস্থদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে অনেকে। তবে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নারীদের কাজ করতে দিতে হবে এমন কোনো শর্ত কেউ আরোপ করেনি। দুস্থদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দিতে নারী কর্মীদের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

এইচআরডাব্লিউ জানিয়েছে, আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে মাত্র তিনটি প্রদেশে নারী স্বেচ্ছাসেবকদের কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রেও বেশ কিছু শর্ত আরোপ করেছে তালেবান। যেমন কাজের সময় সংশ্লিষ্ট নারী কর্মীর সঙ্গে পরিবারের কোনো পুরুষকে থাকতে হবে। তবে বাস্তবে তেমনটা সম্ভব হয় না অনেক সময়।

Leave a Comment

betvisa