অভিমানী মেয়েটা

ঘড়ির কাঁটা ১২ টা ছুঁইছুঁই। বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বসলে কারোরই বোধ হয় সময়জ্ঞান থাকে না। আমাদেরও ছিল না। গল্পের আসর আরও কিছুক্ষণ চলতো। কিন্তু আরিয়ানের ফোনের ভ্রুম ভ্রুম শব্দ এবং তার বউয়ের হুংকার সবকিছুতেই ছেদ ঘটালো।

আরিয়ান তার বউয়ের ধমক খেয়ে কেঁদে ফেলবে কেঁদে ফেলবে অবস্থা। পাছে তাকে নিয়ে আমরা মজা করি সেই ভয়েই বোধ হয় আর কাঁদলো না।

“তুমি মাত্র একটা মিনিট ওয়েট করো প্লিজ, আমি এক্ষুণি আসছি। এখন রাখি কেমন? বাইক স্টার্ট দিব তো।” এতটুকু বলে আরিয়ান তার বউয়ের অনুমতি নিয়েই কল কেটে দিল।

ক্যাবলাকান্তের মতো একটা হাসি দিয়ে আমাদের উদ্দেশ্যে বললো, “আমি আর এক সেকেন্ডও দেরি করতে পারবো না রে। তোদের ভাবী সেই ক্ষেপে আছে। আজ আমার কপালে কী আছে আল্লাহ্ মালুম।”
বলেই সে বাইক স্টার্ট দিয়ে ভূতের মতো চলে গেল।

আরিয়ান বাদে, সবার ফোনই আড্ডায় বসার আগে সাইলেন্ট করা ছিল। সে চলে যাবার পর, আমাদেরও টনক নড়লো। সবাই সবার পকেট থেকে ফোন বের করে চোখ কপালে তুলতে লাগলো। সবার মুখ থেকে একটি কথাই বের হচ্ছে “সর্বনাশ!”।

শুধু আমার মুখ থেকেই এই কথা বের হয়নি। কারণ আমার বউ আমাকে অত কলও দেয়নি অত মেসেজও করেনি। আমার ফোনে মাত্র ৩বার কল এসেছে আর ১টা ছোট্ট মেসেজ এসেছে। মেসেজটিতে মাত্র চারটি শব্দ। “আর কত লেইট করবে?” এই ছিল মেসেজ।

বন্ধুরা যে যার মতো উঠে চলে গেল। আমিও উঠে পড়লাম। ওদের ফোনে এতবার ফোনকল ও মেসেজ করেছে তাদের বউ। আর আমার বউ মাত্র ১টা মেসেজ আর ৩টা কল দিল?

তার মানে আমাকে নিয়ে কি তার কোনো উদ্বেগ নেই? অস্থিরতা নেই? ভালোবাসে না আমাকে? সব আবেগ আর উচ্ছ্বাস কি ফিকে হয়ে গেছে মেহেজাবীনের?
এসব ভাবতে ভাবতেই বাসায় ফিরছিলাম। হঠাৎ মনে হলো, এই ক’দিন আগে আমিই তার সাথে খারাপ আচরণ করেছিলাম। কারণ একটাই “আমাকে নিয়ে তার অস্থিরতা”।

সবসময় এত অস্থিরতা ভাললাগে? এজন্য দিয়েছিলাম একটা ধমক। কিন্তু কাজটা মোটেও উচিত হয়নি আমার। এজন্যই বোধ হয় সে কষ্ট পেয়েও চুপ হয়ে গিয়েছে।

নাহ্ আজই গিয়ে বলবো আমাকে নিয়ে তুমি খুব অস্থির হবা। তা না হলে ভালবাসা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে যায়। আজই বুঝলাম এর সত্যতা।

বাসায় পৌঁছে আমার কাছে রাখা চাবিটা দিয়ে দরজা খুললাম। ডাইনিং রুমের লাইট জ্বালিয়ে দেখি সব এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। সন্ধ্যায় চা আর হালকা নাস্তা করে বেরিয়েছিলাম। সেই কাপ, গ্লাস, বাটি, প্লেট, চামুচ সব নোংরা হয়ে আছে।

ব্যাপারটা কী? কখনো তো এরকমটা হয় না। মেহেজাবীন একদমই নোংরামি পছন্দ করে না। ওর জন্যই বাসাটা এত পরিচ্ছন্ন। গুছানো জিনিসপত্র একটুও এদিক সেদিক হতে দেয় না সে। আজ হঠাৎ হলোটা কী?

একটু চিন্তিত হয়েই আমাদের শোবার ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। বাতি নেভানো অন্ধকারাচ্ছন্ন পুরো রুম। জানালায় লাগানো পর্দার ফাঁক দিয়ে রাস্তায় জ্বালানো বাতিগুলোর সামান্য আলো ঘরে প্রবেশ করেছে। তাতেও পুরোপুরি অন্ধকার ভাবটি কাটেনি। আমি মেহেজাবীনের উপস্থিতি বুঝতে পারছি কিন্তু তাকে দেখতে পারছি না।

আলো জ্বালিয়ে দিলাম। মেহেজাবীন গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে। সিলিং এ ফ্যান ঘুরছে কিন্তু মেহেজাবীন গায়ে কাঁথা মুড়িয়ে আছে। এই ভ্যাপসা গরমে কাঁথা গায়ে দেবার কথা তো কল্পনাতেও আসে না। ওর কী শরীর খারাপ করলো নাকি?

ও যেইদিকে মুখ করে শুয়ে আছে ঐদিকটায় ওর সামনে গিয়ে বসলাম। হালকা একটু গোঙ্গানির মতো করে আওয়াজ করছে সে। আমি চমকে উঠলাম। কপালে হাত রেখে দেখলাম জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। চোখের কোণে এখনো এক ফোটা জল। চোখের নিচের বালিশটা অনেকখানি ভিজে গেছে। বুঝলাম সে অনেক কেঁদেছে, অনেক কষ্ট পেয়েছে। তবুও আমাকে জানায়নি। মেয়েটা এত অভিমান! এত্ত অভিমানী সে!

আমি আর দেরি করলাম না। উঠে গিয়ে পানি এনে ওর মাথায় জলপটি দিতে লাগলাম। আমারও কষ্ট লাগছিল। ওর মাথায় হাত বুলিয়েও দিচ্ছিলাম।

জলপটি দেয়ার কিছুক্ষণ পরে মনে হলো রাতে তো রান্নাও করেনি সে। আমার সাথে তখন চা-নাস্তা খেয়েছে। আর বোধ হয় কিছু খায়নি।

সাথে সাথেই ফ্রিজ থেকে ফল বের করে জুস করলাম। এক গ্লাস জুস নিয়ে এসে ওকে আস্তে আস্তে ডাকতে লাগলাম। সে সাড়া দিচ্ছিল কিন্তু চোখ খুলছিল না। তার কষ্ট হবে ভেবে আমি আর তাকে ডাকলাম না। জুসের গ্লাসটা ওভাবেই পাশের টেবিলে ঢেকে রাখলাম। এরপর আবারও আগের পানি ফেলে দিয়ে নতুন করে পানি এনে জলপটি দিচ্ছিলাম।

বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। চোখ বন্ধ করেই অনুভব করলাম পরম ভালোবাসায় কেউ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি আমার মিষ্টি বউ। তার মুখে তৃপ্ততার হাসি। আমি কালকে দেরি করে আসার জন্য লজ্জিত হলাম।

তার হাত ধরে মাফ চাইলাম। বললাম, ” আর কোনোদিন এরকমটা হবে না তবে একটা শর্ত আছে।”

সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই আমি বললাম, “আমার জন্য আবারও আগের মতো অস্থির হবা? কথা দিচ্ছি, আমি আর কখনো বিরক্ত হবো না।”

তার চোখে জল টলমল করছে। মুখে হাসি চোখে জল। আহা! এই দৃশ্যটুকু দেখার জন্য হলেও মেহেজাবীনের সাথে আরো কয়েক যুগ বাঁচতে চাই, আমার রব। আপনি আমাদের মধ্যকার ভালোবাসা বাড়িয়ে দিন, পৌঁছে দিন জান্নাত অবধি। ইয়া মালিক, কবুল করুন আমাদের।

লেখা: মেহেজাবীন শারমিন প্রিয়া।

By নিজস্ব প্রতিবেদক

রংপুরের অল্প সময়ে গড়ে ওঠা পপুলার অনলাইন পর্টাল রংপুর ডেইলী যেখানে আমরা আমাদের জীবনের সাথে বাস্তবঘনিষ্ট আপডেট সংবাদ সর্বদা পাবলিশ করি। সর্বদা আপডেট পেতে আমাদের পর্টালটি নিয়মিত ভিজিট করুন।

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *