চট্টগ্রামে ১৯ বছরে মৃত্যু ঘটেছে ১০৬টি হাতির। এসব হাতির মধ্যে আটটিই সরাসরি হত্যার শিকার। গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় এগুলোকে। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, শুধু গুলি চালিয়ে নয়- দাঁত পাচারকারীদের একটি চক্র সুকৌশলে হাতি হত্যার পর সেগুলোকে ‘সাধারণ মৃত্যুর’ পর্যায়ভুক্ত করে আসছে। দুর্ঘটনায় এবং বিদ্যুতায়িত হয়ে এই প্রাণীর মৃত্যুর ঘটনাকে সংশয়ের চোখে দেখছেন তারা। বার্ধক্যে উপনীত হাতির মৃত্যুর ঘটনাও তাদের মতে অনেক ক্ষেত্রেই সন্দেহজনক।
সম্প্রতি চট্টগ্রামে হাতির দাঁত পাচার চক্রের দুই সদস্য পুলিশের জালে ধরা পড়ে। কিন্তু আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে তারা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই জামিনে মুক্তি পেয়ে যায়। এরপর চট্টগ্রাম অঞ্চলে হাতি হত্যার বিষয়টি আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে। বছরের পর বছর হাতি হত্যার ঘটনা ঘটলেও পাচার চক্রের সদস্য গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা এখানে এটিই প্রথম। তবে জিজ্ঞাসাবাদ করার আগেই জামিন পাওয়ায় হাতির দাঁত পাচার চক্র ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
হাতির দাঁতসহ গ্রেপ্তার এই পাচারকারীরা হলেন- কর্ণফুলী থানার বড় উঠান এলাকার মৌলানা মহিবুল্লা খান বাড়ির জমির আহম্মদের ছেলে মো. জানে আলম ও বাঁশখালী উপজেলার পুকুরিয়া ইউনিয়ন ৬ নম্বর ওয়ার্ডের নাকমুড়া হাজি আবদুল খালেক বাড়ির মৃত আবদুল খালেকের ছেলে মো. আমিন উল্লাহ। গত ২৪ মে কর্ণফুলী থানার মইজ্জারটেক চরপাথরঘাটা এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ
(বন্দর)। তাদের কাছ থেকে এক কেজি ৮০০ গ্রাম ওজনের হাতির ২৪ ইঞ্চি লম্বা দুটি দাঁত জব্দ করে পুলিশ। প্রতিটি দাঁতের ওপরের অংশ ১৩ ইঞ্চি সাদা এবং নিচের অংশের ১১ ইঞ্চি হলদে রঙের। পরদিন ২৫ মে কর্ণফুলী থানায় এ নিয়ে মামলা হয়। ২৬ মে তারা চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পান।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১৯ বছরে মৃত ১০৬টি হাতির মধ্যে ২৯টি মারা গেছে অসুস্থ হয়ে। এ ছাড়া দুর্ঘটনায় ৩২টি, বার্ধক্যজনিত জটিলতায় ২২টি, বিদ্যুতায়িত হয়ে ১৫টি এবং গুলিতে আটটি হাতির মৃত্যু ঘটেছে। সূত্র মতে, এগুলোর মধ্যে অন্তত ৮৪টি হাতির মৃত্যু ‘অস্বাভাবিক’। চট্টগ্রাম বন অঞ্চলের কক্সবাজার, বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও রাঙামাটি অঞ্চলে এসব হাতির মৃত্যু হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এসআই এসএম শফিউল আজম মুন্সী বলেন, কর্ণফুলী থানার মইজ্জারটেক চরপাথরঘাটার পূর্ব পাশে পাকা রাস্তার ওপর কয়েকজন লোক বন্যপ্রাণীর অংশবিশেষ বিক্রির জন্য অবস্থান করছে- এমন তথ্যের ভিত্তিতে দুটি বাজারের ব্যাগ তল্লাশি করে হাতির দুটি দাঁত উদ্ধার ও দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণী আইন-২০১২-এর ৩৬ (২) ধারায় কর্ণফুলী থানায় মামলা করা হয়েছে। পাচার চক্রে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনতে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বন কর্মকর্তা আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজ বলেন, বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ অনুযায়ী হাতি হত্যা, হাতির দাঁতসহ যে কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্রয়-বিক্রিয় নিষিদ্ধ। এটি ফৌজদারি অপরাধ। হাতি হত্যা ও দাঁত পাচারকারীদের শনাক্তে আমরাও দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করে আসছি।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্পেশাল পিপি মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, পৃথিবীতে হাতির দাঁত খুবই মূল্যবান। তাই হাতির দাঁত পাচারের ঘটনায় বন্যপ্রাণী আইনের সঙ্গে চোরাচালান আইনের ধারাও যুক্ত করলে আসামিরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে সুবিধা পেত না। দুই আসামি জামিন পাওয়ায় এখন তদন্ত কর্মকর্তার জন্য পুরো পাচার চক্রকে শনাক্ত করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। দুই আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারলে তাদের কাছ থেকে এ চক্র সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া সহজ হতো।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে বেশিরভাগ হাতিই হত্যার শিকার হয়েছে চুনতী, বাঁশখালী ও বান্দরবান অঞ্চলে। গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামিনে মুক্তি পাওয়া আমিন উল্ল্যাহর বাড়ি বাঁশখালীতে হওয়ায় সেখানে মূল পাচার চক্র রয়েছে বলে মনে করছে পুলিশ। কারণ, গত এক থেকে দেড় বছরে বাঁশখালীতে ১১টি হাতির মৃত্যু ঘটেছে। এগুলোর বেশ কয়েকটির পোস্টমর্টেম করতে গিয়ে দাঁতসহ বেশকিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাননি প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা।
বাঁশখালী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. সমরঞ্জন বড়ুয়া জানান, গত এক থেকে দেড় বছরে বাঁশখালী অঞ্চলে অনেক হাতির মৃত্যু হয়। সে সব হাতির পোস্টমর্টেম করতে গিয়ে দেখা যায়, একেকটা হাতি একেক কারণে মারা গেছে। তবে কোনো হাতির দাঁত পাওয়া যায়নি, আবার দাঁতের অংশবিশেষ পাওয়া গেলেও অন্য অংশ মেলেনি। বেশিরভাগ হাতিরই অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।