ভারত থেকে চুক্তি অনুযায়ী টিকা না পাওয়ার পর বিকল্প উৎসের সন্ধানে নামে সরকার। সেজন্য যৌথভাবে কাজ শুরু করে স্বাস্থ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। চীন ও রাশিয়াকে সামনে রেখে গত এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে কার্যক্রম শুরু হয়। তখন থেকেই আশ্বাস দিয়ে আসছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সুস্পষ্ট কোনো সমাধানের কথা তারা জানাতে পারেননি। কখনও তারা বলছেন, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে টিকা কেনার চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আবার কখনও বলছেন, শিগগিরই চুক্তি হতে যাচ্ছে। আবার মাঝেমধ্যে বলছেন, টিকা আমদানির পাশাপাশি উৎপাদনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্যবিদরা মনে করেন, টিকার বিষয়টি নিয়ে জনগণকে সঠিক তথ্য জানানো প্রয়োজন। টিকা নিয়ে বিশ্বব্যাপী সংকট চলছে। এর সঙ্গে রাজনীতি, কূটনীতি থেকে শুরু করে অর্থনীতি সবকিছু যুক্ত হয়ে পড়েছে।
দুই মন্ত্রীর আশ্বাস, চীনের ভিন্ন সুর :সর্বশেষ গত সোমবার রাজধানীর এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক চীনের কাছ থেকে দেড় কোটি ডোজ টিকা কেনার বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে জানান। শিগগির চীনের সঙ্গে এ-সংক্রান্ত চুক্তি হচ্ছে দাবি করে তিনি বলেন, চীনের আরেকটি কোম্পানি সিনোভ্যাকও বাংলাদেশে টিকা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশে তারা এই টিকা তৈরিতেও আগ্রহী। সিনোভ্যাকের টিকার জরুরি ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এবং দেশে এই টিকা উৎপাদনের জন্যও আলোচনা চলছে।
রাশিয়ার টিকার বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে টিকা কেনার চুক্তিটি এখনও খসড়া আকারে রয়েছে। সম্পূর্ণ হয়নি। তারা বাংলাদেশকে টিকা দিতে চায়।
আগের দিন রোববার রাশিয়ার বিদায়ী রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে করোনার টিকা দ্রুতই চলে আসবে। চীনের সঙ্গেও কোনো জটিলতা হয়নি। রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি চুক্তি হবে। তবে কখন হবে সেটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলতে পারবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় লাইন করে দিয়েছে, বাকিটা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাজ। টিকা ক্রয় ও যৌথ উৎপাদনে তারা সিদ্ধান্ত নেবে। আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। চীনের কাছ থেকে টিকা কেনার ক্ষেত্রে কোনো জটিলতা তৈরি হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কোনো জটিলতা তৈরি হয়নি। চীনকে বলেছি তাদের কাছ থেকে টিকা কিনতে চাই এবং তোমরা কোনো বাধা ছাড়াই জোগান দাও। কোনো বাধা ছাড়াই তারা টিকা সরবরাহের বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছে।
এর আগের দিন শনিবার ঢাকায় নিযুক্ত চীনের উপ-রাষ্ট্রদূত হুয়ালং ইয়ান নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে টিকা নিয়ে পরপর দুটি স্ট্যাটাস দেন। প্রথম স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, টিকা কেনার বিষয়ে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো চুক্তি হয়নি। গণমাধ্যমের খবর সঠিক হলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বার বার ভুয়া তথ্য দেওয়ার বিষয়টি বিস্ময়ের সৃষ্টি করে।
উপ-রাষ্ট্রদূত আরও লেখেন, প্রথমত, আজ পর্যন্ত টিকা কেনার বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সিনোফার্মার কোনো চুক্তিই হয়নি। দ্বিতীয়ত, টিকা কেনার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চীনের সরকারের সঙ্গে হচ্ছে না, এটা বাংলাদেশ ও সিনোফার্মের মধ্যে একটি বাণিজ্যিক আলোচনার বিষয়। অবশ্য তিনি আশা প্রকাশ করেন, বাংলাদেশি ‘ভাইবোনেরা’ আগের নির্ধারিত তারিখেই প্রয়োজনীয় টিকা পাবেন।
একই দিন অপর এক স্ট্যাটাসে উপ-রাষ্ট্রদূত লেখেন, চীন সরকারের পক্ষ থেকে উপহারের ৬ লাখ ডোজ টিকা আগামী ১৩ জুনের মধ্যে ঢাকায় আসবে। এর আগে চীনের উপহার হিসেবে দেওয়া ৫ লাখ ডোজ টিকা দেশে এসেছে।
ওইদিন চীনা উপ-রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সমকালকে বলেছিলেন, চীন সরকারের সঙ্গে টিকা কেনার ব্যাপারে কোনো চুক্তি হচ্ছে না। কেনাকাটার ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছে চীনের কোম্পানি সিনোফার্মের সঙ্গে, এটা ঠিক। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ হচ্ছে চীন সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের কোম্পানি যেন বাংলাদেশে টিকা বিক্রি করে সেই ব্যবস্থা করা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই কাজটা করে দিয়েছে। এখন কীভাবে টিকা কেনা হবে, কত টাকায় কেনা হবে তা ঠিক করা এবং চুক্তি করার দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। অতএব চুক্তি হয়েছে, কী হয়নি তা শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ই বলতে পারবে।
গতকাল মঙ্গলবার ইআরএফের এক অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেন, এই মুহূর্তে চীনের অভ্যন্তরে করোনার টিকার বিপুল চাহিদা রয়েছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সরবরাহও খুব সীমিত। এর মধ্যেও বন্ধুত্বের কারণে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে চীন। ইতোমধ্যে সিনোফার্মের ৫ লাখ টিকা উপহার দেওয়া হয়েছে। সিনোভ্যাকের আরও ৬ লাখ ডোজ উপহারের টিকা আসার অপেক্ষায় রয়েছে।
টিকা বিক্রি ও বাংলাদেশে উৎপাদনের প্রসঙ্গ টেনে রাষ্ট্রদূত বলেন, টিকা বিক্রির বিষয়টি নিয়ে আমরা এখন অপেক্ষা করছি। চীন-বাংলাদেশ যৌথভাবে উৎপাদনের আলোচনার অগ্রগতিও আশাব্যঞ্জক বলে জানান তিনি। তবে কবে নাগাদ বাংলাদেশ টিকা পাবে কিংবা উৎপাদন শুরু হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দেননি রাষ্ট্রদূত।
চীনা টিকা নিয়ে জটিলতার নেপথ্য কারণ :সম্প্রতি সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে চীন থেকে সিনোফার্মের দেড় কোটি ডোজ টিকা কেনার প্রস্তাব অনুমোদন পায়। এরপর সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শাহিদা আকতার সিনোফার্মের টিকার প্রতি ডোজ ১০ ডলার দামে কেনার চুক্তির কথা জানান। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ চীন থেকে দেড় কোটি ডোজ টিকা কিনবে। মোট দাম পড়বে ১৫ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় এক হাজার ২৬৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
চীনের সঙ্গে টিকা চুক্তির শর্ত ছিল, দাম প্রকাশ করা যাবে না। কিন্তু অতিরিক্ত সচিব টিকার দাম প্রকাশ করায় বিপাকে পড়ে চীন। একই টিকা শ্রীলঙ্কার কাছে বিক্রি করা হচ্ছে ১৫ ডলারে। বাংলাদেশে প্রতি ডোজ টিকা ১০ ডলারে বিক্রি নিয়ে আপত্তি জানায় শ্রীলঙ্কা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দাম প্রকাশ করায় চীন তাদের অস্বস্তির কথা বাংলাদেশকে ইতোমধ্যে জানিয়েছে। এরপরই টিকার দাম প্রকাশ করা ওই অতিরিক্ত সচিবকে গত ১ জুন ওএসডি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, মূলত টিকার দাম প্রকাশ করার পর চীন নাখোশ হয়েছে। কারণ, একই টিকা শ্রীলঙ্কার কাছে বিক্রি করা হচ্ছে ১৫ ডলারে। শ্রীলঙ্কা বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। এতে চীন অস্বস্তিতে পড়ে। মূলত এরপরই ওই কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়। ওই বিষয়টি না ঘটলে চলতি জুন মাস থেকেই সিনোফার্মের টিকা আসা শুরু হতো। কিন্তু সংকট যে জায়গায় পৌঁছেছে, তা উত্তরণে পথ খুঁজছে বাংলাদেশ ও চীন। এখন বাংলাদেশকেও ১৫ ডলারে টিকা কিনতে হতে পারে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
ফুরিয়ে আসছে টিকার মজুদ :করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক টিকার মজুদ ফুরিয়ে আসছে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদিত অক্সফোর্ডের টিকা কোভিশিল্ড গতকাল বুধবার পর্যন্ত এক কোটি ৫৪ হাজার ৪৩ ডোজ বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ডোজ গ্রহণ করেছেন ৫৮ লাখ ২০ হাজার ১৫ জন। প্রথম ডোজ গ্রহণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ৪২ লাখ ৩৪ হাজার ২৮ জন। ভারত থেকে কেনা ও উপহার মিলে এখন পর্যন্ত এসেছে এক কোটি ৩ লাখ ডোজ টিকা। এ অবস্থায় সরকারের কাছে টিকার মজুদ আছে মাত্র দুই লাখ ৪৫ হাজার ৯৫৭ ডোজ। ওই টিকা দিয়ে আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত চলতে পারে বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা।
ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে অক্সফোর্ডের টিকার তিন কোটি ডোজ কেনার চুক্তি করে বাংলাদেশ। কিন্তু টিকা এসেছে মাত্র ৭০ লাখ ডোজ। আর ভারত সরকার উপহার দিয়েছে ৩৩ লাখ ডোজ। চুক্তি অনুযায়ী টিকা না পাওয়ায় গত ২৬ এপ্রিল থেকে প্রথম ডোজের টিকাদান কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এরপর দ্বিতীয় ডোজের টিকাদান কার্যক্রম চলছে। গতকাল পর্যন্ত সারাদেশে ৪২ জেলা এবং রাজধানীর ৪৭ কেন্দ্রের মধ্যে ২৩টি কেন্দ্রে টিকাদান কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়েছে। টিকার মজুদ না থাকায় ওই কেন্দ্রগুলোতে টিকাদান কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
প্রথম ডোজ গ্রহণকারী ব্যক্তিদের দ্বিতীয় ডোজ দিতে টিকা প্রয়োজন এক কোটি ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৩০ ডোজ। তাহলে ঘাটতি রয়েছে ১৩ লাখ ৪০ হাজার ৩০ ডোজ। এই ঘাটতি মেটাতে সরকার ভারতের পাশাপাশি অক্সফোর্ডের টিকা মজুদ আছে- এমন দেশগুলোর সঙ্গে গত দুই মাস ধরে যোগাযোগ করে আসছে। কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করেছে, এশিয়া অঞ্চলের ১৬টি দেশের জন্য তারা ৭০ লাখ ডোজ অক্সফোর্ডের টিকা উপহার দেবে। তবে ওই উপহারের টিকা কবে নাগাদ পৌঁছাবে, তা জানা যায়নি।
এদিকে টিকার বৈশ্বিক জোট কোভ্যাক্স থেকে এক লাখ ৬ হাজার ২০ ডোজ ফাইজারের টিকা দেশে এসেছে। আর চীনের উপহারের ৫ লাখ ডোজ দিয়ে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়েছে। চীন আরও ৬ লাখ ডোজ টিকা দেবে। আগামী ১৩ জুন ওই টিকা আসার কথা রয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সমকালকে বলেন, আগামী ১৩ জুন চীন থেকে টিকা আসার কথা রয়েছে। আর ফাইজারের এক লাখ ডোজের কিছু বেশি টিকা হাতে রয়েছে। ১৩ জুনের পর এই দুটি টিকা দিয়ে আবারও টিকাদান কার্যক্রম শুরু করা হবে। জুনের মধ্যে চীনের সঙ্গে টিকা ক্রয়ের বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলেন :বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, টিকা নিয়ে মন্ত্রীরা বিভিন্ন ধরনের কথা বলছেন। কেউ বলছেন, টিকা কেনার চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে। আবার কেউ বলছেন, ড্রাফট পর্যায়ে রয়েছে। এতে করে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। সুতরাং সরকারের উচিত এ বিষয়ে সঠিক তথ্য জানানো।
বিএমএর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, শুরু থেকে টিকার জন্য একটি উৎসের ওপর নির্ভরশীল থাক উচিত হয়নি। বিকল্প উৎস হাতে রাখার প্রয়োজন ছিল। কারণ, একটি উৎস সমস্যা হলে অন্যটি কাজে লাগানো যেত। কিন্তু সেটি না করায় বাংলাদেশ সংকটে পড়েছে। এখন টিকা নিয়ে কী হচ্ছে, কবে নাগাদ চীন অথবা রাশিয়া থেকে টিকা আসবে কিংবা উৎপাদনের যে কথা হচ্ছে, সেগুলো সম্পর্কে জনসাধারণকে সুনির্দিষ্টভাবে জানানো প্রয়োজন। অন্যথায় জনমনে আরও শঙ্কা বাড়বে।