রুমাইছা বিনতু মিলহান আল-আনসারিয়্যা রা.
তার উপনাম উম্মু সুলাইম। এ নামেই তিনি প্রসিদ্ধ। অনেক গুণ ও বৈশিষ্ট্যের আধার ছিলেন তিনি। ইসলাম গ্রহণে অগ্রগামী সাহাবিদের অন্যতম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম জান্নাতে তাঁর উপস্থিতির শব্দ শুনেছেন। আনাস ইবনু মালিক রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন,
“স্বপ্নে আমি জান্নাতে প্রবেশ করি। হঠাৎ কারো নড়াচড়ার শব্দ শুনতে পাই। ফেরেশতাদের জিজ্ঞেস করলাম, ইনি কে? তারা বললেন, রুমাইছা বিনতে মিলহান, আনাস ইবনু মালিকের মা। (মুসলিম, হাদিসঃ ২৪৫৬, মুসনাদু আহমাদ, হাদিসঃ ১১৯৫৫;)
মালিক ইবনু নজরের সঙ্গে উম্মু সুলাইমের বিয়ে হয়েছিল। সেই ঘরেই আনাস রা. জন্মগ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণ করায় ক্ষোভে স্বামী মালিক ইবনু নজর দেশত্যাগ করে সিরিয়ায় চলে যান। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। স্বামী মারা যাবার পর উম্মু সুলাইম সিদ্ধান্ত নেন, তিনি আর বিয়ে করবেন না। ছেলেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকবেন। তবে ছেলে যদি চায়, তাহলে সিদ্ধান্ত বদলাতে পারেন। কিছুদিন পর তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন জায়িদ ইবনু সাহিল নামে মদীনার এক ধনকুবের। তাঁর আরেক নাম ছিল আবু তালহা। একে তো তিনি ছিলেন ধনী, তাঁর উপর সাহসী। কিন্তু উম্মু সুলাইম তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বসেন। উম্মু সুলাইম বলেন, “তোমার মতো মানুষ, যে কীনা এখনো একজন কাফির, তাকে আমি কীভাবে আমার স্বামী হিসেবে গ্রহণ করব?”
আবু তালহা ভাবলেন, হয়তো উম্মু সুলাইম অন্য কাউকে বিয়ে করবেন বলে তাঁর প্রস্তাবে রাজি হচ্ছেন না।
তিনি অভিমানের সুরে বললেন, “কী এমন আছে, যা আমাকে বিয়ে করতে তোমাকে বাধা দিচ্ছে? সেটা কি সোনা-রূপা?”
“সোনা-রূপা?” জায়িদের কথা শুনে উম্মু সুলাইম অপমানবোধ করলেন। তিরস্কার করে বললেন, “আল্লাহর কসম, হে আবু তালহা, আমি আল্লাহ আর তাঁর রাসুলের শপথ করে বলছি তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ করো তাহলেই কেবল আমি তোমাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করব। আমাকে সোনা-রুপা কিচ্ছু দেওয়া লাগবে না। তোমার ইসলাম গ্রহণকেই আমি আমার মোহরানা হিসেবে ধার্য করব।”
আবু তালহা বুঝতে পারলেন ধন-সম্পদের প্রতি তার কোনো লোভ নেই। তাকে বিয়ে করতে হলে আবু তালহাকে ইসলাম গ্রহণ করতে হবে। বিয়ে করার জন্য পিতৃধর্ম ছেড়ে দেবেন কিনা সেটা নিয়ে যখন তিনি চিন্তা করছেন তখন সুযোগ পেয়ে উম্মু সুলাইম তাকে বললেন, “হে আবু তালহা, তুমি কি জানো না, যে ইলাহর তুমি ইবাদত করো সেটি মাটির তৈরি?”
রুমাইসার রা. সাথে সুর মিলিয়ে আবু তালহা বললেন, “হ্যাঁ, তা ঠিক।”
উম্মু সুলাইম বলে চললেন, “একটা গাছের পূজা করতে তোমার লজ্জা করে না? যেখানে গাছটির এক অংশ আগুনে জ্বালিয়ে রুটি বানিয়ে খাও। হে আবু তালহা! তুমি ইসলাম গ্রহণ করে নাও। তাহলে আমি সন্তুষ্টচিত্তে তোমাকে আমার স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে নেব। আর মোহরানা হিসেবে আমি তোমার কাছে আর কিছুই চাইব না।”
উম্মু সুলাইম রা.-এর এবারের কথাগুলো আবু তালহাকে নাড়া দিল। তিনি উম্মু সুলাইমকে বলে গেলেন, প্রস্তাবটি বিবেচনা করে দেখবেন। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে আবু তালহা ঘোষণা করলেন – আশহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদান রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম।
ছেলের অনুমতি নিয়ে উম্মু সুলাইম আবু তালহাকে রা. বিয়ে করলেন। মদিনার মুসলমানরা এই বিয়েকে তাদের দেখা সবচেয়ে মূল্যবান বিয়ে বলে উল্লেখ করেন। আনাসের বয়স যখন ১০ বছর, তখন তাঁর মা উম্মু সুলাইম তাকে নিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের কাছে আগমন করে বললেন, “হে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম, আমার ছেলে আনাস, আজ থেকে সে আপনার খিদমত করবে।” তখন থেকেই আনাস নিয়মিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এর খিদমত করেছেন। নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম উম্মু সুলাইম ও কিছু আনসারি নারীকে যুদ্ধে নিয়ে যেতেন। যাতে তারা যুদ্ধাহতদের সেবা-শুশ্রুষার পাশাপাশি পানি পান করাতে পারেন। হুনাইনের যুদ্ধে উম্মু সুলাইম খঞ্জর হাতে রণাঙ্গনের দিকে এগিয়ে যান। আবু তালহা রা. বলে ওঠেন, “হে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম, এই যে উম্মু সুলাইম, তাঁর হাতে খঞ্জর।”
উম্মু সুলাইম বলেন, “কোনো মুশরিক আমার নিকটবর্তী হওয়ার চেষ্টা করলে আমি এটা দিয়ে তার নাড়িভুড়ি বের করে ফেলব।”
হাদিস, ইতিহাস ও জীবনীগ্রন্থগুলোতে তাঁর বীরত্ব, সাহসিকতা ও প্রজ্ঞার বহু ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তবে তিনি কষ্ট-দুঃখের সময় ধৈর্যশীলতা ও বুদ্ধিমত্তার যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, ইতিহাসের পাতায় তার নজির খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন। মুসলিম নারীদের জন্য হজরত উম্মু সুলাইম রা. এক অনুপ্রেরণাদায়ক চরিত্র।
রুফাইদা আল-আসলামিয়া
আধুনিক নার্সিং এর জনক ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল আমাদের কাছে সুপরিচিত। ১৮৫০ সালে ক্রিমিয়ায় ফ্লোরেন্সে আহত সৈন্যদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। মানবসেবার ইতিহাসে তিনি অমর। কিন্তু, অনেকেই জানে না যে ফ্লোরেন্সের প্রায় ১২০০ বছর আগে মদিনার আনসার নারীদের মধ্যে একজন মানব সেবায় আত্মনিয়োগ করে ইসলামের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।
তিনি আনসারি সাহাবিয়া। খাজরাজের শাখা গোত্র ‘আসলামের’ উজ্জ্বল প্রদীপ। এক মহীয়সী নারী। তিনি ছিলেন চিকিৎসা সেবায় পারদর্শী। আহতদের চিকিৎসা, বিনামূল্যে অসুস্থদের সেবা – এই ছিল তার জীবনের ব্যস্ততা। দুর্বল ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতেন তিনি। যুদ্ধের ময়দানে আহতদের সেবা, তৃষ্ণার্তকে পানি পান করানো তার বিশেষ কাজের অন্যতম। তরবারির ঝনঝন শব্দ আর ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি তাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি।
বনু খাজরাজ আসলাম গোত্রে ৬২০ খ্রিষ্টাব্দে রুফাইদার জন্ম হয়। তার পিতা সাদ আল আসলামি ছিলেন মদিনার এক প্রখ্যাত চিকিৎসক। ছোট থেকেই রুফাইদা তার বাবাকে সাহায্য করতেন নানা বিষয়ে। বলা যায়, নিজের বাবার হাতেই তার রোগ নিরাময় ও চিকিৎসাবিজ্ঞান শেখা। তার জীবনের বিশদ বিবরণ ইতিহাসে আসেনি, কিন্তু যতটুকু এসেছে তা দ্বারাই আমরা এই মহীয়সী নারীর উজ্জ্বল কীর্তিগাঁথা সম্পর্কে জানতে পারি।
তার সম্পর্কে ইবনু ইসহাক রাহ. বলেন, তিনি আহতদের সেবা করতেন। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় অসহায় মুসলমানদের সেবা করতেন। [তারিখুত তাবারি ২/৫৮৬, আল ইস্তিআব ৩৩৪০]
তার মানবসেবা ছিল কোনোরূপ বিনিময় ছাড়া। পার্থিব কোন স্বার্থ ছাড়া। পরম লক্ষ্য ছিল আপন রবের সন্তুষ্টি, কেবল তাঁরই রেযামন্দি। ইবনু সাদ রাহ. বলেন,
রুফাইদা রা. হিজরতের পরে বাইআত হয়েছেন। মসজিদে নববির পাশেই তার তাঁবু ছিল। সেখানে তিনি অসুস্থ ও আহতদের সেবা করতেন। সাদ ইবনু মুআজ রা.-এর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তার সেবা করেছেন। তিনি খায়বার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। মাহমুদ বিন লাবিদ রা. বলেন,
খন্দকের যুদ্ধে যখন সাদ বিন মুআজ রা. আহত হলেন, তখন রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা তাকে রুফাইদার তাঁবুতে নিয়ে যাও। এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম সকাল-সন্ধ্যা সাদ ইবনু মুয়াজ রা.-এর খবর নিতেন। [আল আদাবুল মুফরাদ ১১২৯]
খাইমাতু রুফাইদা (রুফাইদার তাঁবু) মানুষের কাছে এক প্রসিদ্ধ নাম ছিল, আহতদের সেবার এক আস্থাভাজন কেন্দ্র ছিল। তাই তো মসজিদের নিকটেই ছিল তার তাঁবু। রুফাইদা রা. দিন-রাত এক করে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন মানবসেবায়। যুদ্ধের কঠিন মূহুর্তেও তার সেবা বন্ধ থাকেনি। অস্ত্রের ঝনঝনানির মাঝেও তার কাজ থেমে থাকেনি। মানুষও ছুটে আসত তার তাঁবুতে। তাই তো অনেক ঐতিহাসিক খাইমাতু রুফাইদাকে মুসলিম ইতিহাসের প্রথম মুসতাশফা বা চিকিৎসালয় আখ্যা দিয়েছেন। যুদ্ধ ছাড়াও সাধারণ সময়েও মানুষের কাছে তার তাঁবু ছিল বাতিঘরের মতো। তা ছিল অসুস্থ মানুষের আস্থার ঠিকানা। মুখে মুখে তাই ছড়িয়ে গিয়েছিল খাইমাতু রুফাইদার নামে। মুসলিম নারী বিশেষ করে মুসলিম নারী চিকিৎসকদের জন্য এক অনুপ্রেরণার নাম রুফাইদা রা.। তার সম্মানে আগা খান বিশ্ববিদ্যালয় একটি নার্সিং কলেজ স্থাপন করেছেন। বাহরাইনের রয়্যাল কলেজ অফ সার্জনের ছাত্র-ছাত্রীদের রুফাইদা আল আসলামিইয়া পুরষ্কার দেওয়া হয়।