মদিনার বিখ্যাত গোত্র আউসের সন্তান সাদ ইবনু মুয়াজ রা.। মুসআব ইবনু উমাইর রা. ইসলাম প্রচারক হিসেবে মদিনায় আসেন। নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে মদিনার প্রতিটি লোকের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেন। একদিন সাদ ইবনু মুয়াজও তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েন। মুসআব রা. তার সামনে ইসলামের বাস্তবতা তুলে ধরেন। কুরআনের কয়েকটি আয়াত তিলাওয়াত করে শুনান। তখন সাদ ইবনু মুয়াজ কালিমা পড়ে মুসলিম হয়ে যান। তার গোত্রে এই সংবাদ মূহুর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে। সাদ রা. ঘরে যান। তিনি তার সম্প্রদায়ের মধ্যে অত্যন্ত মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। তার প্রভাবে সন্ধ্যা হতে না হতেই পুরো গোত্র মুসলিম হয়ে যায়। মদিনার আকাশ-বাতাস তখন তাকবির ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। ইসলামের প্রচার প্রসারের ক্ষেত্রে এটি সাদ ইবনু মুয়াজ রা.-এর বিশেষ অবদান।
মক্কার মুশরিকরা মদিনা আক্রমণের জন্য পরিপূর্ণভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এই সংবাদ জানতে পেরে বদরের দিকে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে তিনি কুরাইশ বাহিনীর সর্বশেষ গতিবিধি অবগত হন। নবিজি সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য মুহাজির ও আনসারদের সাথে পরামর্শ করেন। মুহাজিরদের মধ্যে আবু বকর, উমর ও মিকদাদ রা. প্রমুখ সাহাবি নিজ নিজ অভিমত ব্যক্ত করেন। তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আনসারদের লক্ষ্য করে বললেন, “লোকসকল, আমাকে পরামর্শ দিন।” সাদ ইবনু মুয়াজ রা. দাঁড়িয়ে বললেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমরা আপনার প্রতি ইমান এনেছি। আপনাকে সত্যবাদী বলে জেনেছি। আমরা স্বীকার করছি যে, আপনি যা কিছু নিয়ে এসেছেন সবই সত্য ও সঠিক। আমরা আপনার কথা শোনা ও আনুগত্য করার অঙ্গীকার করেছি। সুতরাং আপনার যা ইচ্ছা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন। আমরা আপনার সঙ্গেই আছি। সেই সত্তার কসম যিনি আপনাকে নবি বানিয়েছেন, আপনি যদি আমাদের সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন, আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ব। আমাদের একজন লোকও পিছনে থাকবে না। আমরা যুদ্ধকে ভয় করি না। রণাঙ্গনেও সত্যবাদী হিসেবে প্রমাণিত হব, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের পক্ষ থেকে আপনাকে এমন আচরণ প্রত্যক্ষ করাবেন, যা আপনার চোখ শীতল করে দিবে। আল্লাহর ওপর ভরসা করে আমাদের নিয়ে আপনি অগ্রসর হোন।”
তিনি আরো বললেন, “আমরা তাদের মতো হবো না, যারা মুসাকে বলেছিল – আপনি আর আপনার প্রতিপালক যান আর শত্রুর সাথে যুদ্ধ করুন, আর আমরা এখানে বসে থাকি। বরং আমরা বলব – আপনি আর আপনার প্রতিপালক যান, আর আমরাও আপনাদের অনুসরণ করব। হতে পারে আপনি এক উদ্দেশে বেরিয়েছেন কিন্তু আল্লাহ অন্য একটি করালেন। দেখুন, আল্লাহ আপনার দ্বারা কি করান।”
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম সাদ ইবনু মুয়াজের বক্তব্যে দারুণ খুশী হন। সেনাবিন্যাস করার সময় তিনি আউস গোত্রের ঝাণ্ডা সাদ রা.-এর হাতে সোপর্দ করেন। তবে অন্য এক বর্ণনা মতে, এই যুদ্ধে গোটা আনসার সম্প্রদায়ের পতাকা ছিল সাদ রা.—এর হাতে। খন্দকের যুদ্ধের সময় সাদ ইবনু মুয়াজ বর্ম পরিধান করে হাতে বর্শা নিয়ে রণাঙ্গনের উদ্দেশে রওনা দেন। যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছার পর তাকে লক্ষ্য করে কাফিরদের একজন তির ছুঁড়ে মারে। তিরটি তার হাতে লেগে মারাত্মক ক্ষতের সৃষ্টি করে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম সাদ ইবনু মুয়াজের হাতে তির বিদ্ধ হওয়া সম্পর্কে জানতে পেরে তাকে মসজিদে নববিতে স্থাপিত রুফায়দার চিকিৎসা শিবিরে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দেন।
নবিজি প্রতিদিন এসে তার খোঁজখবর নিতেন। তিনি একবার নিজ হাতে সাদ ইবনু মুয়াজের ক্ষতে সেঁক দেন। তাতে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যায়, তবে তার হাত ফুলে ওঠে। একদিন তার ক্ষত ফেটে প্রবলবেগে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকে। মসজিদে নববি অতিক্রম করে গিফার গোত্রের তাঁবু পর্যন্ত রক্তের স্রোত বয়ে যায়। এ দৃশ্য দেখে লোকজন হতভম্ব হয়ে পড়ে। জিজ্ঞেস করে – কী হয়েছে? উত্তর আসে – সাদ রা.-এর ক্ষত ফেটে গিয়েছে।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম জানতে পেরে অস্থির হয়ে পড়েন। কাপড় টানতে টানতে দৌড়ে মসজিদে নববিতে আসেন আর সাদ রা.-এর মাথা কোলে উঠান। সাদ রা. তখন আর পৃথিবীতে নেই। সাদ ইবনু মুয়াজকে দাফনের পর নবিজিকে খুব বিমর্ষ দেখা যায়। চোখ দিয়ে ক্রমাগতভাবে অশ্রু ঝরতে থাকে। সাহাবায়ে কিরাম সাদ রা.-এর লাশ নিয়ে কবরস্থানের উদ্দেশে রওয়ানা করেন। তার লাশ হালকা মনে হচ্ছিল। নবিজি তাদের এ কথা শুনে বললেন, “যার হাতে আমার জীবন তার নামের শপথ, ফিরিশতাগণ তার খাটিয়া বহন করছেন।” রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, “নিশ্চয়ই সাদ খুব নেককার মানুষ। তার জন্য আল্লাহর আরশ দুলে উঠেছে, আসমানের দরজাসমূহ খুলে গেছে। তার জানাজায় এমন ৭০ হাজার ফিরিশতা অংশগ্রহণ করেছেন, যারা এর আগে কখনই পৃথিবীতে আসেননি।”
সাদ রা.-এর মৃত্যু ইসলামি ইতিহাসের এক অসাধারণ ঘটনা। তিনি ইসলামের জন্য যে অবদান রাখেন, আর যে দীনি অনুপ্রেরণা তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল, তার জন্য তাকে আনসারদের “আবু বকর” মনে করা হতো। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাকে “সাইয়িদুল আনসার” উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি তার সম্প্রদায়ের সবচেয়ে মর্যাদাবান ও সম্মানিত ব্যক্তি। তার মৃত্যূর ঘটনাটি যে কত গুরত্বপূর্ণ তা অনুমিত হয় তার জানাজায় ফিরিশতাদের অংশগ্রহণ আর আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠার মাধ্যমে। নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে সাদ ইবনু মুয়াজ রা. ছিলেন উঁচু স্তরের ব্যক্তি। সাদ রা. বলতেন, “এমনিতে আমি একজন সাধারণ মানুষ। তবে তিন জিনিসে যে পর্যন্ত পৌঁছা উচিত, আমি সেখানে পৌঁছেছি –
১) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে যে বাণী শুনি, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে, এ বিশ্বাস আমার হয়ে যায়,
২) নামাজের মধ্যে অন্য কোন দিকে আমার মন যায় না,
৩) কোনো জানাজার সাথে থাকলে আমার মধ্যে মুনকার-নাকিরের প্রশ্নের চিন্তা ছাড়া অন্য কিছু থাকে না।”
ইমাম নাসাঈ রাহ. তার সুনানে বর্ণনা করেছেন যে,
أَخْبَرَنَا إِسْحَاقُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ، قَالَ حَدَّثَنَا عَمْرُو بْنُ مُحَمَّدٍ الْعَنْقَزِيُّ، قَالَ حَدَّثَنَا ابْنُ إِدْرِيسَ، عَنْ عُبَيْدِ اللَّهِ، عَنْ نَافِعٍ، عَنِ ابْنِ عُمَرَ، عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ” هَذَا الَّذِي تَحَرَّكَ لَهُ الْعَرْشُ وَفُتِحَتْ لَهُ أَبْوَابُ السَّمَاءِ وَشَهِدَهُ سَبْعُونَ أَلْفًا مِنَ الْمَلاَئِكَةِ لَقَدْ ضُمَّ ضَمَّةً ثُمَّ فُرِّجَ عَنْهُ ” .
ইসহাক ইবনে ইবরাহীম (রাহঃ) … ইবনে উমর (রাযিঃ) সূত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সেই ব্যক্তি যার জন্য আরশ কেঁপে উঠেছিল এবং যার জন্য আকাশের দ্বারসমুহ খূলে গিয়েছিল এবং যার জানাযার সত্তর হাজার ফেরেশতা উপস্থিত হয়েছিল তার কবরও সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর তা প্রশস্ত হয়ে গিয়েছিল। (হাদিস নং – ২০৫৯ সুনানে নাসায়ী
মুহাদ্দিসীন লিখেন, কবরের ভয়াবহতা একটি অনস্বীকার্য বিষয়। এবং কবর কারো সাথেই দয়াদ্র আচরণ করবে না বরং মাইয়্যেতের সাথে তার প্রথম আচরণের বহিঃপ্রকাশ হলো, তার সাথে সংকীর্ণতা পয়দা করবে কিন্ত যখন তার ঈমান আমল ভালো পাবে তখন এটার কারণে তার জন্য আরামদায়ক ও প্রশস্ত হয়ে যাবে।
এ বিষয়টিই আল্লাহর রাসুল সাহাবীদের বুঝিয়েছেন যে, সাদ রা. এতো ফযীলতের অধিকারী হওয়া সত্তেও কবর তার প্রতি দয়াদ্র হয়নি, কবর প্রথমে তার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করে তার জন্য সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল কিন্ত তার ঈমান আমল ও ফযীলতের কারণে তা প্রশস্ত ও আরামদায়ক হয়ে গিয়েছে।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এই মহান সাহাবির জীবনী থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন, আমিন।