আবদুল্লাহ ইবনু উম্মু মাকতুম। শারীরিকভাবে দৃষ্টিশক্তিহীন জন্মান্ধ। কিন্তু এক অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী। তিনি ছিলেন পবিত্র কুরআনের হাফিজ। তার সম্মানে মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ১৬টি আয়াত নাজিল করেছেন। ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম পর্যায়ের ব্যক্তিদের অন্যতম ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনু উম্মু মাকতুম রা.। তিনি খাইরুল কুরুনীর (শ্রেষ্ঠ তিন যুগ- সাহাবা যুগ, তাবেয়ী যুগ, তাবে তাবেয়ীন যুগ ) প্রথম সারির সদস্য। তিনি প্রথমদিকে ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। তিনি কুরআনের হাফেজ ছিলেন একই সাথে বেলাল (রাদিঃ) সাথে সমন্বয়ে মসজিদে নববীর মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করতেন। এমনকি মাঝে মাঝে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের এর অনুপস্থিতিতে ইমামের দায়িত্বও পালন করেছেন। কোরআনের ৮০ তম সূরা আবাসার প্রথম আয়াত তাঁর সাথে সংঘবদ্ধ একটি ঘটনায় নাজিল বলে বিবেচিত হয়।
ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তার নাম ছিলো হুসাইন। ইসলাম গ্রহণের পর মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তার নাম পাল্টে রাখলেন আবদুল্লাহ। তিনি ছিলেন খাদিজা (রাদিঃ) আপন মামাতো মতান্তরে ফুফাতো ভাই ছিলেন। সেই হিসেবে তিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামে শ্যালক হন।
আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে-মক্তুম(রাদিঃ) ইসলামের প্রথম গ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামে তাকে এবং মুসাব ইবনে উমাইর(রাদিঃ) কে হিজরত হওয়ার আগে বাসিন্দাদের কুরআন শিক্ষা দেওয়ার জন্য মদীনায় প্রেরণ করেছিলেন। তিনি এবং বিলাল ইবনে রাবাহ (রাদিঃ) মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামে দ্বারা মদীনায় মুয়েজিন হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামে যখন যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য মদীনা ত্যাগ করেছিলেন, তখন তাকে নামাজের ইমামতি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। কোন কোন বর্ণনায় তিনি মদিনায় হিজরত কারীদের মধ্যে দ্বিতীয়জন ছিলেন। উম্মে মাকতুম (রাদিঃ) ও মুসআব (রাদিঃ) একসঙ্গে মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরতেন আর কোরআনের দাওয়াত এবং তালিমের কাজ করতেন।
মক্কায় ইসলাম প্রচারের প্রথম দিককার ঘটনা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম উতবা, শাইবা, আবু জেহেলসহ কতিপয় প্রভাবশালী কুরাইশ নেতাদের সাথে বসলেন। তাদের সামনে ইসলামের দাওয়াত পেশ করে বোঝাতে থাকলেন। নবিজির আশা ছিল, তারা ইসলাম গ্রহণ করবে কিংবা অন্তত সাহাবিদের ওপর জুলুম-নির্যাতন বন্ধ করবে। এমতাবস্থায় আবদুল্লাহ ইবনু উম্মু মাকতুম রা. রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের খিদমতে এসে বললেন, “হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম, আল্লাহ আপনার ওপর যেসব আয়াত নাজিল করেছেন, তা আমাকে শিক্ষা দিন।”
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তার দিকে কর্ণপাত না করে কুরাইশ নেতাদের সাথে আলোচনা অব্যাহত রাখেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম চাচ্ছিলেন যদি এসব নেতা ইসলাম গ্রহণ করে তা হলে তা ইসলামের জন্য গৌরবজনক হবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম কুরাইশ নেতাদের সাথে আলোচনা শেষ করে বাড়ি ফিরতে মনস্থ করলেন। এ সময় হঠাৎ তিনি তন্দ্রাচ্ছন্ন হলেন, এবং তার ওপর নাজিল হল সুরা আবাসার ১৬টি আয়াত। আল্লাহ তাআলা আবদুল্লাহ ইবনু উম্মু মাকতুমকে উপেক্ষা করায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে তিরস্কার করে বলেন,
“সে হয়তো উপদেশ গ্রহণ করত। অথচ যে বেপরোয়া ভাব দেখায়, তুমি তার দিকে মনোযোগ দিচ্ছ।”
এরপর থেকে আবদুল্লাহ ইবনু উম্মু মাকতুম রা. যখনই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট আসতেন, তখনই তিনি তাকে সম্মান করতেন। কোনো বৈঠকে উপস্থিত হলে তাকে কাছে বসাতেন, খবরাখবর নিতেন। যখন ইমানদারদের ওপর কুরাইশদের নির্যাতন চরমে পৌঁছাল, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম সাহাবিদেরকে হিজরতের আদেশ দিলেন। সাহাবিদের মধ্যে মুসআব ইবনু উমাইর ও আবদুল্লাহ ইবনু উম্মু মাকতুম সর্বপ্রথম মদিনায় হিজরত করেন। তারা মদিনায় পৌঁছে জনগণের কাছে কুরআন পাঠ করে শোনাতেন ও আল্লাহর দীন সম্পর্কে শিক্ষাদান করতেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম নিজের অনুপস্থিতিতে দশ বারের অধিক আবদুল্লাহ ইবনু উম্মু মাকতুম রা.-কে মদিনায় তার খলিফা বা প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল মক্কা বিজয়ের জন্য যাত্রার সময়।
আবদুল্লাহ ইবনু উম্মু মাকতুম রা. ছিলেন অন্ধ। মসজিদে নববি থেকে তার বাড়িটিও ছিল একটু দূরে। সব সময়ের জন্য কোনো সাহায্যকারীও ছিল না তার। এত অসুবিধা সত্ত্বেও নিয়মিত মসজিদে নববিতে এসে নামাজ আদায় করতেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন,
একদিন আমি বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম, আমার বাড়ি ও মসজিদের মধ্যে খেজুর বাগান ও ঝোপ-জঙ্গল রয়েছে। সব সময় পথ দেখানো লোকও আমি রাখতে পারি না। এমতাবস্থায় আমি কি ঘরে নামাজ আদায় করতে পারি?
তিনি বললেন, “তুমি কি ইকামাত শুনতে পাও?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ।”
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তা হলে তুমি মসজিদে এসেই নামাজ আদায় করবে।”
আজান ও ইকামাতের আওয়াজ তার ঘর পর্যন্ত পৌঁছাত এ কারণে তিনি অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও ঘরে নামাজ আদায়ের অনুমতি পাননি।
চতুর্দশ হিজরি সনে দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. সিদ্ধান্ত নিলেন পারস্য বাহিনীর সাথে একটি চূড়ান্ত যুদ্ধের। তিনি বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নরদের সেনাবাহিনী পাঠানোর নির্দেশ দিলেন। মুসলিম জনগণ তার এ আহবানে ব্যাপকভাবে সাড়া দিল। চতুর্দিক থেকে মানুষ বন্যার স্রোতের ন্যায় মদিনার দিকে আসতে লাগল। অন্ধ আবদুল্লাহ ইবনু উম্মু মাকতুমও ঘরে বসে থাকতে পারলেন না। তিনি মুজাহিদদের কাতারে শামিল হয়ে চলে এলেন মদিনায়।
মুসলিম বাহিনী যখন কাদিসিয়ায় পৌঁছালো, হজরত আবদুল্লাহ ইবনু উম্মু মাকতুম বর্ম পরে যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হয়ে সামনে এলেন। এবং মুসলিম বাহিনীর আলাম বা পতাকা বহনের দায়িত্বটি তাকে দেওয়ার আহ্বান জানালেন। বললেনঃ হয় এ পতাকা সমুন্নত রাখব, নয় মৃত্যুবরণ করব।
কাদিসিয়া প্রান্তরে মুসলিম ও পারস্য বাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর বিজয়ের মাধ্যমে তৎকালীন বিশ্বের বৃহত্তম সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। অসংখ্য শহীদের প্রাণের বিনিময়ে এ মহাবিজয় অর্জিত হয়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনু উম্মু মাকতুমও ছিলেন সেই অগণিত শহিদদের একজন। যুদ্ধশেষে দেখা গেল রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় তিনি মুসলিমদের পতাকাটি জড়িয়ে ধরে মাটিতে পড়ে আছেন। মৃত্যুর মুখেও নিজ কর্তব্য পালনে অবিচল ছিলেন মহান সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনু উম্মু মাকতুম।