দ্বিতীয় হিজরির ১৭-ই রমজান। ঐতিহাসিক বদর প্রান্তরে একটি অসম যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। একদিকে তৎকালীন আরবের সবচেয়ে প্রতাপশালী সম্প্রদায় কুরাইশ। অন্য প্রান্তে অস্তিত্বের লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া ক্ষুদ্র মুসলিম সম্প্রদায়। আল্লাহর সাহায্যে এগিয়ে যাচ্ছে মুসলিমরা। লড়াই করতে করতে শত্রু শিবিরে ঢুকে পড়েছে পাতলা ও লম্বা গড়নের এক মুসলিম যুবক। শত্রুমনে ত্রাস সৃষ্টি করে এক এক করে মুশরিকদের কচুকাটা করে চলেছেন তিনি। হঠাৎ তার গতির পরিবর্তন ঘটল। আক্রমণাত্মক কৌশল ত্যাগ করে রক্ষণাত্মক হলেন তিনি। একটু পর পর সামনে এগোতে গেলেই কেউ একজন বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। মুসলিম যুবক তাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু লোকটি বারবার তার পথ আটকে দাঁড়াচ্ছে। সুযোগ পেয়ে কাফির লোকটি তাকে আক্রমণ করে বসল। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেন মুসলিম যুবক। করলেন পালটা আক্রমণ। শত্রুর দেহ থেকে মস্তক আলাদা করে দিলেন। চারদিক স্তব্ধ হয়ে গেল। কিন্তু কেন? যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর শিরশ্ছেদ করাটাই তো যুদ্ধের নীতি। তাহলে? কারণ জেনে স্তব্ধ হবেন আপনিও। মুসলিম যুবক শত্রুপক্ষের যে লোকটির শিরশ্ছেদ করলেন, সে আর কেউ নয়, তার জন্মদাতা পিতা। সেই মুসলিম যুবকটি হলেন মুসলিম উম্মাহর আমিন – আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ রা.। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “প্রত্যেক জাতিরই একজন আমিন বা বিশ্বস্ত ব্যক্তি আছে। আর মুসলিম জাতির আমিন হলো আবু উবাইদা।”
হজরত আবু উবায়দা রা. ইসলাম গ্রহণে অগ্রগামী ব্যক্তিদের মাঝে ছিলেন। আবু বকর রা. ইসলাম গ্রহণের পরদিনই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। আবু উবায়দা রা. বদর যুদ্ধে তার পিতাকে হত্যা করেননি, বরং তিনি তার পিতার ব্যক্তিত্বে লুকায়িত শিরককে হত্যা করেছেন।
আল্লাহ তাআলা এ ঘটনা প্রসঙ্গে কুরআনের আয়াত নাজিল করে বলেন –
لَا تَجِدُ قَوۡمًا یُّؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰهِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ یُوَآدُّوۡنَ مَنۡ حَآدَّ اللّٰهَ وَ رَسُوۡلَهٗ وَ لَوۡ کَانُوۡۤا اٰبَآءَهُمۡ اَوۡ اَبۡنَآءَهُمۡ اَوۡ اِخۡوَانَهُمۡ اَوۡ عَشِیۡرَتَهُمۡ ؕ اُولٰٓئِکَ کَتَبَ فِیۡ قُلُوۡبِهِمُ الۡاِیۡمَانَ وَ اَیَّدَهُمۡ بِرُوۡحٍ مِّنۡهُ ؕ وَ یُدۡخِلُهُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِهَا الۡاَنۡهٰرُ خٰلِدِیۡنَ فِیۡهَا ؕ رَضِیَ اللّٰهُ عَنۡهُمۡ وَ رَضُوۡا عَنۡهُ ؕ اُولٰٓئِکَ حِزۡبُ اللّٰهِ ؕ اَلَاۤ اِنَّ حِزۡبَ اللّٰهِ هُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ ﴿۲۲﴾
আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাসী এমন কোন সম্প্রদায় তুমি পাবে না যারা ভালবাসে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধাচারীদেরকে, হোক না এই বিরুদ্ধাচারীরা তাদের পিতা, পুত্র, ভাই অথবা তাদের জ্ঞাতি গোষ্ঠি। তাদের অন্তরে (আল্লাহ) ইমান লিখে দিয়েছেন এবং তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন তাঁর অদৃশ্য শক্তি দ্বারা; তিনি তাদেরকে দাখিল করবেন জান্নাতে যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তারা স্থায়ী হবে; আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট, তারাই আল্লাহর দল। জেনে রেখ, আল্লাহর দলই সফলকাম হবে। [সুরা মুজাদালাঃ ২২]
মুহাম্মাদ ইবনু আবু জাফর বর্ণনা করেন, একবার খৃষ্টানদের একটি দল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে বলল,
হে আবুল কাসিম। আপনার সাথীদের মধ্য হতে এমন একজনকে আমাদের সাথে পাঠান যার ব্যাপারে আপনি সন্তুষ্ট হবেন। আমরা কিছু ধন-সম্পদ নিয়ে মতবিরোধ করছি, সে আমাদের মাঝে ফায়সালা করে দিবে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমরা বিকালে আমার নিকট আস। আমি তোমাদের সাথে বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে পাঠাব।
পরে তিনি আবু উবায়দা রা.-কে ডেকে বললেন, তাদের সাথে যাও, তারা যে বিষয়ে মতবিরোধ করছে ন্যায়সঙ্গতভাবে তার ফায়সালা কর।
উহুদের দিনে যখন মুসলমানগণ পরাজিত হলেন আর মুশরিকরা চিৎকার করে ডাকতে লাগল, “মুহাম্মাদ কোথায় আছে দেখিয়ে দাও” আবু উবায়দা রা. তখন সেই দশজন সাহাবির একজন ছিলেন যারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম-কে ঘিরে মুশরিকদের বর্শাগুলো নিজ দেহে পেতে নিচ্ছিলেন। যুদ্ধ শেষ হলে দেখা গেল, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সামনের দাঁত ভেঙ্গে গেছে। তার কপালে বর্মের দুটি আংটা বিদ্ধ হয়েছে। আবু বকর রা. তা তুলে ফেলতে অগ্রসর হলেন।
তখন আবু উবায়দা তাকে বললেন, আল্লাহর কসম দিয়ে আমি আপনাকে বলছি, দয়া করে আমার জন্য সেটা ছেড়ে দিন।
আবু বকর রা. সরে দাঁড়ালেন। আবু উবায়দা ভেবে দেখলেন, যদি তিনি আংটা দুটো হাত দিয়ে উপড়ে ফেলেন তাহলে রাসুল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম কষ্ট পাবেন। তাই তিনি সামনের দাঁত দিয়ে একটি আংটা মজবুত করে কামড়ে ধরে তুলে ফেললেন। এতে তার সামনের দাঁত পড়ে গেল। অতঃপর সামনের অপর দাঁত দিয়ে দ্বিতীয় আংটাটি কামড়ে ধরে তুলে ফেললেন। ফলে তার সামনে অপর দাঁতটিও পড়ে গেল।
আবু বকর রা. তাই বলতেন, আবু উবায়দা সামনের দাঁতহীন ব্যক্তিদের মাঝে সবচেয়ে সুন্দর মানুষ। রাসুল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের ওফাতের পর আবু উবাইদা রা.-কে খিলাফত গ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হল। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাতে বায়াত গ্রহণ করলেন। পরবর্তীতে হজরত উমর রা. খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করলে তিনি তার অনুগত হয়ে থাকলেন। মাত্র একবার ছাড়া কখনই তার অবাধ্য হননি। ঘটনাটি ঘটে যখন আবু উবায়দা রা. মুসলিম সৈন্যদের সেনাপতি হয়ে শামে ছিলেন। এক রণক্ষেত্র বিজয় লাভ করার পর আরেক রণক্ষেত্র বিজয় করার জন্য মুসলিম বাহিনীকে নিয়ে ছুটে চলছিলেন। এসময় সহসা শামে এক ভয়ঙ্কর মহামারী দেখা দিল। মহামারীতে অগণিত মানুষ মৃত্যুবরণ করতে লাগল। হজরত উমর রা. – এ সংবাদ শুনেই চিঠিসহ একজন দূত আবু উবায়দার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি চিঠিতে লিখলেন, “তোমার নিকট আমার এমন একটি গুরত্বপূর্ণ প্রয়োজন দেখা দিয়েছে তুমি ছাড়া আর কারো দ্বারা তা পূর্ণ হবার নয়।”
উমর রা. চিঠি পাওয়া মাত্র তাকে রওনা করতে বললেন। আবু উবাইদা রা. চিঠি পাওয়ার পর বললেন, আমার নিকট আমিরুল মুমিনিনের প্রয়োজনের বিষয়টি আমি বুঝে ফেলেছি।
তারপর চিঠির উত্তরে লিখে পাঠালেন, “হে আমিরুল মুমিনিন। আমার নিকট আপনার প্রয়োজনটা আমি বুঝে ফেলেছি। আমি মুসলিমদের মুজাহিদ বাহিনীতে রয়েছি। আমি যে মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হব তা থেকে বাঁচার কোন আগ্রহ আমার নেই। আল্লাহ আমার ও তাদের মাঝে ফয়সালা করার পূর্বে আমি তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাই না। সুতরাং আমাকে শামে থাকার অনুমতি প্রদান করুন।”
হজরত উমর রা. কেঁদে ফেললেন। তার চোখ উপচে অশ্রু প্রবাহিত হল। তখন তার কান্নার প্রবণতা দেখে মজলিসে উপস্থিত ব্যক্তিরা বললেন, “হে আমিরুল মুমিনিন! আবু উবাইদা কি মৃত্যুবরণ করেছেন?”
হজরত উমর রা. বললেন, “না তিনি মৃত্যুবরণ করেননি, তবে তার মৃত্যু অদূরে। হজরত উমর রা. এর ধারণা মিথ্যে হয়নি। শীঘ্রই তিনি মহামারীতে আক্রান্ত হলেন এবং মৃত্যুবরণ করলেন। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত এই মহান সাহাবির জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ইমানের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।