হযরত উম্মে সুলাইম (রা.) ¦¦ ধৈর্য্য, সাহসীকতা ও আত্মত্যাগের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ¦¦ শাইখ যুবাইর আল হাসান (হাফিজাহুল্লাহ)
ইন্নাল হামদা লিল্লাহ ওয়াস্সলাতু ওয়াস্সালামু আলা মাল্লানাবীয়্যা বা’দা। আম্মা বা’দ।
বস্তুবাদী ধ্যান-ধারণার বিষাক্ত ছোবলের অসহায় শিকার হে বোন! আজ তোমাকে একটি উপাখ্যান শোনাবো; তোমাকে এমন এক গল্প শোনাবো যা প্রতিটি মুমিনের হৃদয় কে পরম আবেগে উদ্বেলিত করে। প্রতিটি অশান্ত হৃদয়ে দেয় শান্তনার দোল। আর মৃত্যু ভয়ে কম্পমান বোনদের জন্য যা সাহসের বাতিঘর।
হযরত উমাইসা বিনতে মিলহান রদ্বীয়াল্লহু আনহা। ইসলামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস যাকে ‘উম্মে সুলাইম’ নামে স্মরণ করে। তিনি ছিলেন বনু নাজ্জারের একজন প্রখ্যাত মহিলা আনসারি সাহাবী।
যার জীবনের প্রতিটি পাতায় পাতায় মুক্তোর মতো জ্বলজ্বল করছে দিকভ্রান্ত অন্ধকারে থাকা মানুষের জন্য শিক্ষার দ্যুতি ছড়ানো আলোর মশাল।
তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর স্নেহধন্য সাহাবী – খাদেমুর রাসূল – হযরত আনাস বিন মালিক রদ্বীয়াল্লহু আনহু এর সম্মানিত মাতা। ইসলামের ইতিহাসের প্রখ্যাত বীর আবু তালহা রদ্বীয়াল্লহু আনহু এর সহধর্মিনী। ঐতিহাসিক বীরে মাউনার ঘটনায় শাহাদাত প্রাপ্ত হযরত উম্মে হারাম বিনতে মিলহান রদ্বীয়াল্লহু আনহা এর বোন।
তিনি ছিলেন এমনি এক আত্মত্যাগী মহীয়সী নারী – ইসলামের স্বার্থে যিনি নিজের সাজানো সংসার, প্রিয় স্বামী, , দামী অলংকারাদি – কোন কিছুই ত্যাগ করতে সামান্যতম কুণ্ঠিত হননি।
রাসূলুল্লাহ ﷺ মদীনায় আসার পূর্বেই তিনি ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় লাভ করেন। ইসলাম গ্রহণ করার কারণেই তার প্রথম স্বামী মালিক বিন নজার – তাকে এবং তার সন্তানকে ত্যাগ করে সিরিয়ায় চলে যায়!
এমন এক কঠিন পরিস্থিতিতেও তিনি এক চুল পরিমাণ বিচলিত না হয়ে পর্বতের মত অটল- অবিচল থাকেন।
কিছুকাল পর তার দাওয়াতেই মদিনার শ্রেষ্ঠ তীরন্দাজ বীর আবু তালহা রদ্বীয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ইসলাম গ্রহণ করেন।
ইতিহাসের পাতায় আবু তালহা রদ্বীয়াল্লহু তা’আলা আনহুর ইসলাম কবুলের ঘটনাটি অত্যন্ত চমৎকার ভাবে বর্ণিত হয়েছে। আবু তালহা রদ্বীয়াল্লহু আনহু যখন উম্মে সুলাইম রদ্বীয়াল্লহু আনহাকে বিয়ের প্রস্তাব পেশ করেন তখন কোন রূপ ভনিতা না করে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, হে আবু তালহা! আপনি কি জানেন না, যে ইলাহের ইবাদত আপনি করে থাকেন তা মাটির তৈরি? আবু তালহা রদ্বীয়াল্লহু আনহু জবাবে বলেন তা অবশ্য ঠিক। উম্মে সুলাইম রদ্বীয়াল্লাহু আনহা বলেন, একটি গাছের ইবাদত করতে আপনার লজ্জা হয় না! আপনি ইসলাম গ্রহণ করলে আপনার সাথে বিয়েতে আমার কোনো আপত্তি থাকবেনা। সে ক্ষেত্রে আপনার ইসলাম ছাড়া অন্য কোন মোহরের দাবীও আমার থাকবেনা।
তাৎক্ষণিকভাবে আবু তালহা রদ্বীয়াল্লহু তা’আলা আনহু ভেবে দেখবেন বলে চলে গেলেও পরবর্তীতে এসে ইসলাম কবুল করেন এবং উম্মে সুলাইম রদ্বীয়াল্লহু আনহা এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
প্রিয় বোন! জ্ঞান-বুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও চরিত্রে নেতৃস্থানীয় প্রত্যুতপণ্যমতী এই নারী অসংখ্য গুণে গুণান্বিত ছিলেন। নিজের উপস্থিত বুদ্ধির মাধ্যমে সবচেয়ে খারাপ সময়গুলোও তিনি সামলে নিতেন অনায়াসে।
এ সম্পৃক্ত একটি ঘটনা ইতিহাসের পাতায় খুবই প্রসিদ্ধ। হযরত উম্মে সুলাইম রদ্বীয়াল্লহু আনহা এর ছোট্ট সাজানো-গোছানো সংসারে ছিলেন – তিনি এবং হযরত আবু তালহা রদ্বীয়াল্লহু আনহু এবং তাদের দুজনের কলিজার টুকরা একমাত্র আদরের সন্তান ‘আবু উমায়ের’।
ছোট ছোট পা ফেলে হেঁটে বেড়ানো ‘আবু উমায়ের’ ছিল তাদের দুজনেরই চোখের মনি। কিন্তু আল্লাহ্ রব্বুল আ’লামীন আবু উমায়েরের মাধ্যমে তাদের দুজনের থেকে নিলেন অত্যন্ত কঠিন এক পরীক্ষা।
একবার, অসুস্থ আবু উমায়েরকে রেখে পিতা – আবু তালহা কোনো একটি কাজে ঘরের বাইরে গেলেন। কিন্তু যতক্ষণে ফিরলেন ততক্ষনে মৃত্যু হয়েছে – আবু উমায়েরের।
ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠ প্রদর্শন করে উম্মে সুলাইম রদ্বীয়াল্লাহু আনহা নিজেকে সংবরণ করে নিলেন। বাড়িতে থাকা অন্যদেরকেও তিনি বলে দেন আবু তালহাকে কেউ আগবেরে যেনো সংবাদটি না বলে বসে।
অন্য দিনের মতো যথারীতি আবু তালহা রদ্বীয়াল্লহু আনহু বাড়িতে ফিরেই জানতে চাইলেন অসুস্থ ছেলের স্বাস্থ্যের হালত। অসম্ভব হিকমার সাথে তিনি বললেন, আবু উমাইর যে অবস্থায় ছিল বর্তমানে তার চেয়েও ভালো অবস্থায় আছে। স্ত্রীর কথায় আবু তালহা রদ্বীয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ভাবলেন হয়তো ছেলে আসলেই ভালো আছে!
হযরত উম্মে সুলাইম রদ্বীয়াল্লহু আনহা – স্বামী আবু তালহাকে বলেন, আচ্ছা! কেউ যদি আপনার নিকট কোন জিনিস আমানত রাখেন অতঃপর কোন এক সময় তা ফেরত নিতে আসেন আপনি কি তা ফেরত দিতে অস্বীকার করবেন? আবু তালহা রাঃ বললেন কক্ষনো না। তখন উম্মে সুলাইম রদ্বীয়াল্লহু আনহা বলেন তবে শুনুন, আমাদের কলিজার টুকরা নয়নের মনি আবু উমাইরকে আল্লাহ তাআলাই আমাদেরকে দিয়েছিলেন; অতঃপর তিনিই আবার তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন।
সুবহানআল্লাহ্!!
প্রিয় বোন! একটিবার চিন্তা করুন সন্তান হারানোর মত হৃদয় বিদারক একটি মুহূর্তে তিনি কতটুকু ধৈর্য্য ধারণ করেছিলেন! শুধুমাত্র ধৈর্য ধারণ করেই ক্ষান্ত হননি অসম্ভব বুদ্ধিমত্তার সাথে নিজের স্বামীকে বুঝিয়ে নেন। আমরা যদি কল্পনার জগতে একটিবার নিজেদেরকে এমন একটি অবস্থায় ভাবি, তাহলে সহজেই আমরা সন্তান হারানোর ব্যথার তীব্রতা অনুভব করতে পারব।
প্রিয় বোন! ইসলামের প্রতি নিবেদিত প্রাণ এই নারী রাসূল ﷺ কে ভালবাসতেন – নিজের জীবনের চাইতেও বেশী। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর প্রতি ভালোবাসার কারণেই হিজরতের পূর্বে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। মদীনায় আসার পর রাসূল ﷺ এর দরবারে উপস্থিত হয়ে রাসূল সল্লিল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পেশ করেন – তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, কলিজার টুকরা, চোখের মনি – দশ বছর বয়সী আদরের সন্তানকে।
বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ্! এই নিন আনাসকে, রেখে গেলাম আপনার নিকট, সে এখন থেকে আপনার খেদমত করবে।
এখানেই শেষ নয় নিজের বাড়িতে ভালো কিছু রান্না হলেই তিনি পাঠিয়ে দিতেন নবীজি ﷺ এর বাড়িতে।
পঞ্চম হিজরীতে রাসূল ﷺ এর সাথে উম্মুল মু’মিনীন হযরত যয়নাব বিনতে জাহাশ রদ্বীয়াল্লহু আনহার বিয়ে উপলক্ষে তিনি নিজ হাতে কারুকার্য করা একখানা পশমি পোশাক উপহার হিসেবে – আনাসকে দিয়ে পাঠিয়ে দেন রাসূলুল্লাহ্ ﷺ এর দরবারে।
তিনি অন্তর দিয়ে রাসূল ﷺ কে ভালোবাসতেন।রাসূলুল্লাহ্ ﷺ-ও কখনো তাঁকে বিস্মৃত হননি। এই সম্মানিতা মহিলাকে রাসুল ﷺ দিয়েছিলেন জান্নাতের সুসংবাদ।
সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে :
‘‘রাসূল ﷺ বলেন, মে’রাজের রাতে যখন আমি জান্নাতে প্রবেশ করলাম, তখন সেখানে আমি কারো চলার আওয়াজ শুনতে পেলাম, তখন আমি প্রশ্ন করলাম ‘কে এই ব্যক্তি?’ লোকেরা বলল, তিনি আনাস ইবনে মালিক এর সম্মানিত মাতা – ‘উমাইসা বিনতে মিলহান’।
প্রিয় বোন! তিনি শুধু একজন নারী-ই ছিলেন না বরং সাহসিকতার এক প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন যিনি হুনাইনের উত্তপ্ত রণাঙ্গনে ধারালো খঞ্জর হাতে বিশৃঙ্খল মুসলিম বাহিনীর পালিয়ে যাওয়ার পথ অবরোধ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ ﷺ এর কারন জিজ্ঞেস করলে, তিনি বলেন: ‘‘ইয়া রাসূলাল্লাহ্! কাফিরদের বিরুদ্ধে আপনার এই যুদ্ধে যারা আপনাকে ছেড়ে পালিয়ে যাবে তাদেরকে এই খঞ্জর দিয়ে আমি হত্যা করব কেননা তারা এরই যোগ্য।’’ জবাব রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, উম্মে সুলাইম! আল্লাহ কি তাদের জন্য যথেষ্ট নয়।
আল্লাহু আকবার!
আজকের নারীদের মাঝে তো এমন সাহসের কথা কল্পনা করাও মুশকিল।
প্রিয় বোন! এতকিছুর পরও এত ব্যস্ততার মাঝেও কোন ব্যস্ততাই তাকে ইলম বর্জনের ক্ষেত্রে কোন বাঁধা দিতে পারেনি। হযরত আনাস ইবনে মালেক, ইবনে আব্বাস, যায়েদ বিন সাবেত রদ্বীয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমদের মতো জলিলুদ কাদীর সাহাবীরা তাঁর নিকট থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। কোনো মাসআলার দরকার হলে তিনি সে ক্ষেত্রে সমাধান পেশ করতেন।
প্রিয় বোন! এরাই ছিলেন উম্মতের শ্রেষ্ঠ নারী। এদের হাত ধরেই – এই মহিমান্বিত দ্বীন ইসলাম আজ তোমাদের সময়ে পৌঁছেছে। অথচ তোমরাই পশ্চিমার সাদা চামড়ার মানুষ রূপি এই হায়নাদের কথিত আধুনিকতার অনুসরণ করতে গিয়ে বারবার নিজেদের মুসলিম পরিচয় হীনমন্যতায় আক্রান্ত হচ্ছো। কারণ তোমরা একটিমাত্র কথাই ভুলে গেছো হযরত আইশা খাদিজার এবং উম্মে সুলাইমরা তোমার পূর্বসূরি।
ভুলে গেছো, তোমরাই হাসান, হুসাইন, আব্দুল্লাহ, আব্দুর রহমানদের গর্ভধারিণী মায়েদের রেখে যাওয়া উত্তরসূরি।
তাঁরা ছিলেন সেই নারী যারা ইসলামের স্বার্থে নিজের জীবনকে কুরবান করতেও সামান্যতম দ্বিধাবোধ করতেন না। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকল বোনদেরকে, সকল মায়েদেরকে উম্মে সুলাইম রদ্বীয়াল্লাহু আনহা এর মত কবুল করে নিন। দ্বীনের সহীহ বুঝ দান করুন। হিদায়াতের আলোয় আলোকিত করুন।
আমীন ইয়া রব্বাল আলামীন।
©