কক্সবাজারের টেকনাফের মূল ভূখণ্ড শাহপরীর দ্বীপ থেকে ১৮ কিলোমিটার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মধ্যে প্রায় আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিন। এই দ্বীপের উত্তর-পশ্চিম কোনার সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে আছে দৃষ্টিনন্দন একটি মাছের ভাস্কর্য। ২০ ফুট লম্বা এবং ৬ ফুট প্রস্থের ভাস্কর্যটি ইট-পাথর দিয়ে তৈরি হয়নি। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ভ্রমণে গিয়ে পর্যটকেরা বালুচরে যেসব প্লাস্টিক বোতল, টিনের কৌটা, চিপসের প্যাকেট, পলিথিন ফেলে দেন—সেসব বর্জ্য কুড়িয়ে তৈরি হয়েছে মাছের ভাস্কর্যটি। ভাস্কর্যটি তৈরির উদ্দেশ্য হলো, সৈকত কিংবা বঙ্গোপসাগরের কোথাও যেন পর্যটকেরা প্লাস্টিকের বোতলসহ আবর্জনা না ফেলেন এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে আন্তরিক হন।
১৫ জানুয়ারি ভাস্কর্যটি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়। প্রতিদিন অন্তত এক হাজার পর্যটক মাছের ভাস্কর্যটি দেখছেন। মুঠোফোনে ছবি তুলছেন। কেউ কেউ ধারণ করছেন ভিডিও চিত্র। এরপর এসব ছবি-ভিডিও আপলোড করছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।মাছের ভাস্কর্যটি তৈরির উদ্যোক্তা শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও মেরিন বায়োলজিস্ট কাজী আহসান হাবীব। ২০১১ সাল থেকে তিনি সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য ও সংরক্ষণ নিয়ে গবেষণা করছেন।
কাজী আহসান হাবীব বলেন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের চারদিকের সমুদ্রের নিচে কোরালের (প্রবাল) বিস্তৃতি রয়েছে। তাঁর দল যখন স্কুবা করেন, তখন দেখতে পান যে সমুদ্রের নিচে কোরালের ওপর পড়ে আছে প্লাস্টিক বোতল, টিনের কৌটা, পলিথিন, ছেঁড়া জালসহ নানা কিছু। ছেঁড়া জাল যখন কোরালের ওপর পড়ে নিচে ব্লিচিং হয়, তখন কোরাল মারা যায়। স্থানীয় জেলেরা মাছ ধরার সময় জাল পাথরে আটকে গেলে ছিঁড়ে যায়। পরবর্তী সময়ে সেই জাল কোরালের ওপর গিয়ে পড়ে থাকে। অন্যদিকে প্লাস্টিক বোতল, টিনের কৌটা ছড়াচ্ছে ভ্রমণে আসা পর্যটকদের মাধ্যমে, যা সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যকে নষ্ট করছে। একজন গবেষক হিসেবে লোকজনকে সচেতন করার দায়িত্ববোধ থেকেই তিনি মাছের ভাস্কর্য তৈরির পরিকল্পনা করেন।
১০ জানুয়ারি ভাস্কর্য তৈরি শুরু হয়। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে সাত-আটজন শিক্ষার্থীর ভাস্কর্যটি তৈরি করতে সময় লাগে ৪ দিন। সৈকত থেকে প্লাস্টিক বোতল ও টিনের কৌটা কুড়িয়ে এনে তৈরি হয় মাছের ভাস্কর্যটি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী ভাস্কর্য তৈরিতে সহযোগিতা করেন। কাঠের ফ্রেমে প্লাস্টিক বোতল, টিনের কৌটা, চিপসের প্যাকেট দিয়ে মাছটি সাজানো হয়।
একজন গবেষক হিসেবে লোকজনকে সচেতন করার দায়িত্ববোধ থেকেই মাছের ভাস্কর্য তৈরির পরিকল্পনা করেছি।
কাজী আহসান হাবীব, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও মেরিন বায়োলজিস্ট মাছের ভাস্কর্যের নিচের পশ্চিম কোনায় জালে মোড়ানো একটি সামুদ্রিক কচ্ছপ। কচ্ছপটিও প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে তৈরি। পর্যটকদের সচেতন করার জন্য ভাস্কর্যের পাশে টানানো হয় ‘আপনি জানেন কি?’ শিরোনামে একটি বার্তা। তাতে লেখা আছে, ১০ লাখ সামুদ্রিক প্রাণী প্রতিবছর প্লাস্টিক দূষণে মারা পড়ে। মানুষ তাঁর জীবদ্দশায় গড়ে ১৮ কেজির বেশি প্লাস্টিক খাদ্যের মাধ্যমে গ্রহণ করে। প্রশান্ত মহাসাগরে ১৬ লাখ বর্গকিলোমিটারের প্লাস্টিক আবর্জনার একটি ভাসমান দ্বীপ গড়ে উঠেছে, যা বাংলাদেশের প্রায় ১১ গুণ বড়। ২০৫০ সালে বিশ্ব সমুদ্রে প্লাস্টিকের সংখ্যা হবে মাছের চেয়ে বেশি। ১ কোটি টন প্লাস্টিক প্রতিবছর বিশ্ব সমুদ্রে জমা হচ্ছে। পৃথিবীতে উৎপাদিত ১৯ কোটি টন প্লাস্টিক পণ্য মানুষ মাত্র একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেয়।
ভাস্কর্যের দক্ষিণ পাশে লেখা আছে, ‘প্লাস্টিক দূষণে বিপন্ন সাগর ও প্রবালময় এই সেন্ট মার্টিন। যত্রতত্রে ফেলবেন না প্লাস্টিক বোতল ও পলিথিন।’ জনসচেতনতায়—শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (শেকৃবি) ও কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন (কেজিএফ)।সম্প্রতি এই দ্বীপে গিয়ে দেখা যায়, মাছের ভাস্কর্যের পাশে দাঁড়িয়ে মুঠোফোনে ছবি তুলছেন ঢাকার মুগদাপাড়ার ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেন ও তাঁর স্ত্রী তানিয়া হোসেন। ছবি তোলার পর দুজন সৈকতের পানির দিকে হাঁটছিলেন। ২০-২৫ কদম যেতেই হাতে থাকা কোমল পানীয়ের খালি একটি বোতল বালুচরে ফেলে দিলেন। কারণ জানতে চাইলে আমজাদ হোসেন বলেন, সৈকতের কোথাও বর্জ্য ফেলার ডাস্টবিন নেই। খালি বোতল কতক্ষণ হাতে রাখা যায়! মাছের ভাস্কর্যের কথা স্মরণ করে দিলে তিনি অবশ্য দুঃখ প্রকাশ করেন।
ভাস্কর্যের দক্ষিণ পাশে লেখা আছে, ‘প্লাস্টিক দূষণে বিপন্ন সাগর ও প্রবালময় এই সেন্ট মার্টিন। যত্রতত্রে ফেলবেন না প্লাস্টিক বোতল ও পলিথিন।’ জনসচেতনতায়—শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (শেকৃবি) ও কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন (কেজিএফ)।সেন্ট মার্টিন ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মুজিবুর রহমান বলেন, সেন্ট মার্টিনের সৌন্দর্য বহু আগেই নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। তিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছেন ১৫ দিন আগে। এখন লোকজনকে সচেতন করে সেন্ট মার্টিনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। মাছের ভাস্কর্যটি দেখে বহু মানুষ প্লাস্টিক বর্জ্য সম্পর্কে ধারণা পাচ্ছেন এবং সচেতন হচ্ছেন। মাছের এই ভাস্কর্যটি বালুচরে অস্থায়ীভাবে তৈরি হয়েছে। জোয়ারের ধাক্কায় এটি ভেঙে পড়তে পারে। ভবিষ্যতে মাছের ভাস্কর্যটি স্থায়ীভাবে তৈরির চিন্তাভাবনা চলছে।