তিন দিন আগে গত ১ জুলাই দেশে করোনায় সর্বোচ্চ ১৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল। গতকাল রবিবার সে রেকর্ড ভেঙে ১৫৩ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এ যাবৎকালের মৃত্যুর নতুন সর্বোচ্চ রেকর্ড হলো। আগের রেকর্ডের তুলনায় গতকালের রেকর্ডে ১০ জন বেশি মারা গেছে। এমনকি গত আট দিন ধরে টানা দৈনিক শতাধিক মানুষ মারা যাচ্ছে।
একইভাবে গত এক সপ্তাহের মধ্যে পাঁচ দিনই দৈনিক আট হাজারের বেশি রোগী পাওয়া যাচ্ছে। গতকাল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮ হাজার ৬৬১ জন রোগী শনাক্তের রেকর্ড হয়েছে। শেষ সর্বোচ্চ রোগী ছিল ৩০ জুন ৮ হাজার ৮২২ জন। তার এক দিন পর ২ জুলাই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮ হাজার ৪৮৩ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিল। এর এক দিন পর গতকাল আগের দিনের রেকর্ড ভেঙে রোগীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেকর্ড হলো গতকাল।
মৃত্যু ও রোগীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আশঙ্কাজনকভাবে শনাক্তের হারও বাড়ছে। ১১ মাস আগে গত বছরের ৩ আগস্ট মাত্র এক দিনের জন্য দেশে সর্বোচ্চ শনাক্তের হার ছিল ৩২ শতাংশ। এরপর সে বছরে গড় শনাক্তের হার ২২-২৩ শতাংশের মধ্যেই ছিল। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে শনাক্তের হার গত বছরের হারকে ছাড়িয়ে বাড়তে থাকে। সর্বশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার বেড়ে ২৯ শতাংশ হয়েছে।
মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক অবস্থায় আছে খুলনা, রাজশাহী ও ঢাকা বিভাগ। এর আগে গত ১ জুলাই যেদিন সর্বোচ্চ ১৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল, সেদিন খুলনায় মারা গিয়েছিল ৪৬, ঢাকায় ৩৫ ও রাজশাহীতে ১৯ জন। তিন দিন পর গতকাল মৃত্যুর নতুন রেকর্ডের দিনও সবচেয়ে বেশি মারা গেছে খুলনায় ৫১, ঢাকায় ৪৬ ও রাজশাহীতে ১২ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ১০ দিনে তার আগের ১০ দিনের তুলনায় দেশে দৈনিক মৃত্যু ৭৪ শতাংশ ও মোট মৃত্যু ৭২ শতাংশ বেড়েছে। একইভাবে রোগী বেড়েছে ৬৮ শতাংশ।
এমন পরিস্থিতিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগজনক বলছেন। তাদের মতে, সারা বাংলাদেশ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। চলমান ‘লকডাউন’ কার্যকর না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। রোগী ও মৃত্যু দুটোই বাড়বে।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘বছরের ২৫তম সপ্তাহের তুলনায় গত ২৬তম সপ্তাহে রোগী বেড়েছে ৫১ শতাংশ। একই সময়ে মৃত্যু বেড়েছে ৪৬ শতাংশ। গত সাত দিনের করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতি প্রায় কাছাকাছি। সংক্রমণ পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হয়নি। এখন করোনা রোগীর চিকিৎসায় অক্সিজেনের উৎপাদন ও সরবরাহে কোনো সংকট নেই। তবে রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেলে সেটা চ্যালেঞ্জ হতে পারে।’
সামনে মৃত্যু আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সংক্রমণ বাড়ছে। এখন বাড়তির দিকে। সংক্রমণ বাড়ার প্রতিক্রিয়া তিন সপ্তাহ পর্যন্ত থাকবে। এ পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার একটা আশঙ্কা আছে।’
বর্তমানে মৃত্যুর যে সংখ্যা সেটা অবশ্যই উদ্বেগজনক উল্লেখ করে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এখন দৈনিক দেড়শর মতো মৃত্যু হচ্ছে। প্রথমে মৃত্যু দৈনিক গড়ে ৫০ ছিল, সেটা দ্বিতীয় ঢেউয়ে ১০০ পার হয়েছে। এখন তৃতীয় ঢেউয়ে দেড়শ পার হচ্ছে। দিন দিন মৃত্যু বাড়ছে। এখন প্রতি ১০০ রোগীতে মৃত্যু হার ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ, আগে ১ দশমিক ৪৫ ছিল। দ্বিতীয় ঢেউয়ে মৃত্যু ১ দশমিক ৫ শতাংশের ওপরে উঠেছিল। এখন তৃতীয় ঢেউয়ে তা আরও বেড়ে প্রায় ১ দশমিক ৬ শতাংশ ছুঁইছুঁই অবস্থা।’
এমন পরিস্থিতিতে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চলমান ‘কঠোর বিধিনিষেধ’ আরও এক সপ্তাহ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে করোনাসংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। এ বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারক মহলেও আলোচনা চলছে বলে কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ জানান। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই এই বিধিনিষেধ আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো হোক। বিজ্ঞানসম্মতভাবে সেটাই করা উচিত।’
করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু উদ্বেগজনকভাবে বাড়তে থাকায় গত ১ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে সাত দিনের ‘কঠোর বিধিনিষেধ’। ৭ জুলাই বুধবার মধ্যরাতে তা শেষ হওয়ার কথা।
১০ দিনে দৈনিক মৃত্যু ৭৪ শতাংশ বেড়েছে : গত ১০ দিনে তার আগের ১০ দিনের তুলনায় দেশে করোনায় মৃত্যু উদ্বেগজনকহারে বেড়েছে। গত ১০ দিনের আগের ১০ দিনে যেখানে দেশে দৈনিক মারা গেছে ৬৯ জন করে, সেখানে গত ১০ দিনে মারা গেছে ১২০ জন করে। অর্থাৎ এ সময় দৈনিক মৃত্যু বেড়েছে ৭৪ শতাংশ ও মোট মৃত্যু বেড়েছে ৭২ শতাংশ। গত ১০ দিনে মোট মারা গেছে ১ হাজার ১৯৭ জন ও তার আগের ১০ দিনে মোট মৃত্যু ছিল ৬৯৬ জন।
রোগী বেড়েছে ৬৮ শতাংশ : গত ১০ দিনে তার আগের ১০ দিনের তুলনায় রোগী বেড়েছে ৬৮ শতাংশ। গত ১০ দিনে যেখানে দৈনিক গড়ে ৭ হাজার ১১৮ জন করে রোগী শনাক্ত হয়েছে, সেখানে তার আগের ১০ দিনে দৈনিক রোগী শনাক্তের সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ২৯৬ জন করে।
২৪ ঘণ্টায় বেশি মৃত্যু খুলনা বিভাগে : গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনায় যে সর্বোচ্চ ১৫৩ জন মারা গেছে, তাদের মধ্যে বেশি মৃত্যু হয়েছে খুলনা বিভাগে, ৫১ জন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মারা গেছে ঢাকা বিভাগে ৪৬ এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ চট্টগ্রাম ও রংপুরে ১৫ জন করে। এছাড়া রাজশাহী বিভাগে মারা গেছে ১২, ময়মনসিংহ বিভাগে ৯, বরিশাল বিভাগে ৩ ও সিলেট বিভাগে ২ জন।
মোট মৃত্যু বেশি ঢাকায় : এ পর্যন্ত দেশে মোট মারা গেছে ১৫ হাজার ৬৫ জন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ঢাকা মহানগরসহ ঢাকা বিভাগে ৭ হাজার ৭২৮ জন, যা মোট মৃত্যুর ৫১ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মারা গেছে চট্টগ্রাম বিভাগে ২ হাজার ৮১৫ জন, যা মোট মৃত্যুর ১৯ শতাংশ ও তৃতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে খুলনা বিভাগে ১ হাজার ৪৩৬ জন, মোট মৃত্যুর ১০ শতাংশ। এছাড়া রাজশাহীতে মারা গেছে ১ হাজার ১১২, রংপুরে ৬৫৭, সিলেটে ৫৩৯, বরিশালে ৪৩৯ ও ময়মনসিংহে ৩৩৯ জন।
২৪ ঘণ্টায় ঢাকা জেলায় মৃত্যু বেশি : জেলাওয়ারি মৃত্যুর হিসাব করে দেখা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা জেলাতে সবচেয়ে বেশি ২২ জন মারা গেছে। এরপর বেশি মারা গেছে কুষ্টিয়া জেলায় ১২, খুলনায় ১০ এবং বাগেরহাট, ঝিনাইদহ, ঠাকুরগাঁও ও কক্সবাজার ৬ জন করে। বাকি জেলাগুলোতে ৬ জনের কম মারা গেছে।
মোট মৃত্যুর বেশি ঢাকা জেলায় : জেলার মৃত্যু হিসাব করে দেখা গেছে, এ পর্যন্ত ঢাকা জেলায় সবচেয়ে বেশি মানুষ করোনায় মারা গেছে। এ সংখ্যা ৫ হাজার ৫৬২ জন। এরই মধ্যে চট্টগ্রামে মারা গেছে ৮৩২, কুমিল্লায় ৭২৪, নারায়ণগঞ্জে ৪৬৩, বগুড়ায় ৩৬৮, সিলেটে ৩৬৩, নোয়াখালীতে ৩১৬, খুলনা ও গাজীপুরে ৩০৫ জন করে। তাছাড়া বাকি জেলাগুলোতে ৩০০ জনের কম মারা গেছে।
বয়স্ক মানুষ বেশি মারা যাচ্ছেন : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টাসহ এ পর্যন্ত সারা দেশে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ষাটোর্ধ্ব বয়সী মানুষের। এ শ্রেণির মানুষ গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছে ৭০ জন ও মোট ৮ হাজার ৪২৩ জন, যা মোট মৃত্যুর ৬৬ শতাংশ। এরপর সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ৫১-৬০ বছর বয়সী মানুষের। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছে ৪৫ জন ও মোট ৩ হাজার ৬৪৫ জন, যা মোট মৃত্যুর ২৪ শতাংশ। মধ্যবয়সী অর্থাৎ ৪১-৫০ বছর বয়সীদের মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় ২৪ জন ও মোট ১ হাজার ৭২৪ জন মারা গেছে। এ সংখ্যা মোট মৃত্যুর ১১ শতাংশ।
দুই সপ্তাহ পর সংক্রমণ ও তারপর মৃত্যু কমতে পারে : ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ তৃতীয় ঢেউয়ের “পিক পয়েন্টে” যাচ্ছে। সপ্তাহখানেক ধরে সংক্রমণ বাড়বে। দুই সপ্তাহ ধরে মৃত্যুর সংখ্যাটাও বাড়ার আশঙ্কা আছে। দুই সপ্তাহ পর সংক্রমণ কমবে। এরপর মৃত্যুও কমার সম্ভাবনা আছে।’
বিধিনিষেধ কার্যকর না হলে সংক্রমণ-মৃত্যু বাড়বে : সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নেওয়া জনস্বাস্থ্য বিধিনিষেধ কাজে আসবে জানিয়ে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এই যে যাতায়াত বন্ধ করা হয়েছে, সেটার প্রভাবেই দুই সপ্তাহ পর সংক্রমণ কমবে। তিন সপ্তাহ পর মৃত্যুটা কমবে। এটা কার্যকরী না হলে সংক্রমণ কমবে না। বাড়তেই থাকবে। গ্রামাঞ্চলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে যেমন চ্যালেঞ্জ আছে, তেমনি সুবিধাও আছে। সেখানে স্বাস্থ্য কাঠামোটা বিস্তৃত। সেখানে অনেক স্বাস্থ্যকর্মী আছে, এনজিওকর্মী আছে। সেখানে জনগণও একে অন্যকে চেনে। সংহতি বেশি। যেটা শহরে নেই।’
বাংলাদেশে এখন তৃতীয় ঢেউ চলছে এবং সেটা অন্যান্য ঢেউয়ের তুলনায় বেশি ঝুঁকিতে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সারা বাংলাদেশ ঝুঁকিতে। সংক্রমণ চূড়ার দিকেই এগোচ্ছে। এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই সংক্রমণ কমে যাওয়া উচিত, যদি আমরা দেশব্যাপী চলাচলের যে বিধিনিষেধ, সেটাকে যদি কার্যকরী করতে পারি। তবে আমি আশাবাদী কার্যকর হচ্ছে।’