দেশে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় এবার সারা দেশে কমপক্ষে ১৪ দিনের সম্পূর্ণ ‘শাটডাউনের’ সুপারিশ করেছে করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকারের গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। শাটডাউন চলাকালে দেশে জরুরি সেবা ছাড়া যানবাহন, অফিস-আদালতসহ সবকিছু বন্ধ রাখা প্রয়োজন। এ ব্যবস্থা কঠোরভাবে পালন করতে না পারলে যত প্রস্তুতিই থাকুক না কেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অপ্রতুল হয়ে পড়বে বলেও মত দেয় কমিটি।
গতকাল বৃহস্পতিবার কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লার স্বাক্ষর করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ সুপারিশ করা হয়। সুপারিশে বলা হয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া ও জনগণের জীবনের ক্ষতি প্রতিরোধ করার জন্য কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে সারা দেশে কমপক্ষে ১৪ দিন সম্পূর্ণ ‘শাটডাউন’ দেওয়ার সুপারিশ করছে।
কমিটি জানায়, করোনা প্রতিরোধে চলমান খন্ড খন্ডভাবে গৃহীত কর্মসূচির উপযোগিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে সারা দেশেই উচ্চসংক্রমণ, পঞ্চাশোর্ধ্ব জেলায় অতি উচ্চসংক্রমণ লক্ষ করা যায়। কমিটি মনে করছে, করোনা নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অভিজ্ঞতা কঠোর ব্যবস্থা ছাড়া এর
বিস্তৃতি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। শাটডাউনের ব্যাপারে কমিটির বিশেষজ্ঞরা ভারতের শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞের সঙ্গেও আলোচনা করেছেন বলে জানানো হয়। সুপারিশে বলা হয়, তাদের (ভারতের বিশেষজ্ঞ) মতামত অনুযায়ী, যেসব স্থানে (ভারতের) পূর্ণ ‘শাটডাউন’ প্রয়োগ করা হয়েছে, সেখানে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ হয়েছে। কভিড রোগের বিশেষ ধরন ডেল্টা প্রজাতির সামাজিক সংক্রমণ চিহ্নিত হয়েছে এবং দেশে ইতিমধ্যেই রোগের প্রকোপ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এ প্রজাতির জীবাণুর সংক্রমণ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।
কমিটির এ শাটডাউনের সুপারিশকে যৌক্তিক বলে মনে করেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। তিনি বলেছেন, ‘সরকারেরও এ ধরনের প্রস্তুতি আছে। যেকোনো সময় সরকার তা ঘোষণা দেবে। যেহেতু করোনার সংক্রমণ বাড়ছে, সেজন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয়ভাবেও কঠোর বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় সেটি চলছে। সেখানে তা কার্যকরও হচ্ছে। এখন ঢাকার চারপাশের সাত জেলাতেও কঠোর বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি সরকার কিছুদিন ধরেই গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। এখন জাতীয় পরামর্শক কমিটি যে সুপারিশ করেছে, সেটি যৌক্তিক। সরকারও কঠোর বিধিনিষেধের চিন্তাভাবনা করছে। যেকোনো সময় সরকার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম গতকাল রাতে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা পরামর্শক কমিটির শাটডাউনের সুপারিশ শতভাগ সমর্থন করি। ইতিমধ্যেই সুপারিশ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। আজ (গতকাল) সুপারিশ মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে দিয়েছি। এখনো এ ব্যাপারে কিছু জানানো হয়নি।’
এ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি মনে করি এখন শাটডাউন দরকার এবং সরকার এটা বাস্তবায়ন করবে বলে আমি আশা করছি। কারণ সংক্রমণ বন্ধ করা না গেলে পরিস্থিতি আর সামাল দিতে পারছি না। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো অবকাঠামো যদি থাকত, তাহলে এমন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হতো না। সক্ষমতারও একটা সীমাবদ্ধতা আছে। সব দেশেই একই অবস্থা। বরং চিকিৎসকদের উৎসাহ দিতে হবে।’
‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শাটডাউন করা ছাড়া আর কোনো পথ দেখছি না। লকডাউন দিয়েও তো সংক্রমণ থামানো যাচ্ছে না’ মত দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।
এর আগে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারিগরি পরামর্শক কমিটি বিভিন্ন সময় ‘লকডাউন’ বা জনস্বাস্থ্য বিধিনিষেধের সুপারিশ করেছিল। সে অনুযায়ী সরকার দফায় দফায় ‘লকডাউন’ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে সারা দেশে সীমান্তবর্তী এলাকা ও এসব এলাকার আশপাশের অন্তত ১৫ জেলা ও এলাকায় ‘লকডাউন’ চলছে, যা আগামী ১৫ জুলাই পর্যন্ত চলার কথা।
সর্বশেষ ঢাকার করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ঢাকার আশপাশের সাত জেলায় গত সোমবার থেকে সাত দিনের ‘লকডাউন’ চলছে। ৩০ জুন মধ্যরাত পর্যন্ত এ ‘লকডাউন’ চলবে। এমন পরিস্থিতিতে কারিগরি পরামর্শক কমিটি নতুন করে সারা দেশে এবার ‘লকডাউনের’ পরিবর্তে ‘শাটডাউনের’ সুপারিশ করল।
মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ে সীমান্ত এলাকাসহ বিভিন্ন জেলায় চলমান ‘লকডাউনের’ মধ্যেও গত দুই সপ্তাহ ধরে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। রোগী শনাক্ত, মৃত্যু ও শনাক্ত হার ঊর্ধ্বমুখী। দেশের বিশেষজ্ঞরা পরিস্থিতি নিয়ে সতর্ক করে আসছেন। সর্বশেষ গত বুধবারও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলন করে দেশে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অধিদপ্তর থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দেশের মানুষের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। নতুবা করোনা পরিস্থিতি আরও শোচনীয় হতে পারে বলেও সতর্ক করা হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগজনক প্রতিবেদন দিয়েছে। গত মঙ্গলবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সংস্থাটি জানায়, বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা করোনা সংক্রমণের অতি উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে। নতুন রোগী শনাক্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা উভয় বিবেচনায় দেশের করোনা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটছে বলেও সতর্ক করে দেয় সংস্থাটি।
এখনো উচ্চঝুঁকিতে ‘লকডাউন’ এলাকা : গত ১৫ দিন ধরে দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা ও এর আশপাশের ১৫ জেলায় ‘লকডাউন’ চললেও করোনা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। গত দুই সপ্তাহে এসব জেলার মধ্যে মাত্র পাঁচটিতে সংক্রমণ কিছুটা কমেছে। তবে এ পাঁচ জেলাসহ ‘লকডাউনের’ ১৫ জেলাতেই উচ্চহারে সংক্রমণ অব্যাহত রয়েছে।
গত দুই সপ্তাহে মাত্র পাঁচ জেলায় সংক্রমণ কিছুটা কমেছে। জেলাগুলো হলো সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, রাজশাহী, নাটোর ও খুলনা। বাকি ১০ জেলায় সংক্রমণ বাড়ছে। ‘লকডাউনের’ এসব জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ শনাক্ত হার চুয়াডাঙ্গায় শতভাগ ও যশোরে ৫৩ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন সংক্রমণ রাজশাহীতে ১৯ শতাংশ। অন্য জেলাগুলোর মধ্যে বাগেরহাটে ৩৮, নাটোর, খুলনা ও কুড়িগ্রামে ৩০, কুষ্টিয়ায় ৩১, মাগুরায় ১৬, বগুড়া ও নওগাঁয় ২৮, নোয়াখালীতে ২৯, দিনাজপুরে ৪৮ ও জামালপুরে ২২ শতাংশ হারে রোগী শনাক্ত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো এলাকায় শনাক্ত হার ১০ শতাংশের বেশি হলে সে এলাকা উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে বলে মনে করতে হবে। সে হিসাবে এই ১৫ জেলায় গড়ে ২০ শতাংশের ওপরে সংক্রমণ। সে হিসাবে যে পাঁচ জেলায় সংক্রমণ গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে কিছুটা কমলেও এসব এলাকাসহ সব এলাকা এখন সংক্রমণের উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে।
উচ্চঝুঁকিতে ঢাকার চারপাশের ৭ জেলাও : ঢাকাকে করোনামুক্ত রাখতে এর চারপাশের যে সাত জেলায় গত ২২ জুন সকাল থেকে ‘লকডাউন’ চলছে। এসব জেলায় গত দুই সপ্তাহ ধরেই সংক্রমণ বাড়ছে। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ মাদারীপুরে ৫৫ ও গোপালগঞ্জে ৫০ শতাংশ। অথচ দুই সপ্তাহ আগেও এ দুই জেলায় সংক্রমণ ছিল সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে যথাক্রমে ২১ ও ২৩ শতাংশ।
এছাড়া রাজবাড়ীতে ৩৫, গাজীপুরে ২৩, মানিকগঞ্জে ১৪ ও নারায়ণগঞ্জে ৯ শতাংশ হারে রোগী শনাক্ত হচ্ছে। অথচ দুই সপ্তাহ আগেও এ চার জেলায় সংক্রমণ কিছুটা কম ছিল, যথাক্রমে ১৮, ১৩, ৪ ও ৪ শতাংশ হারে রোগী শনাক্ত হচ্ছিল। সে হিসাবে এ সাত জেলা সংক্রমণের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
সংক্রমণের অতি উচ্চঝুঁকিতে দেশের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৪০টিই করোনাভাইরাস সংক্রমণের অতি উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে। এর বাইরে আরও ১৫টি জেলা আছে সংক্রমণের উচ্চঝুঁকিতে এবং মধ্যমঝুঁকিতে রয়েছে ছয়টি জেলা।
গত ১৪-২০ জুন এই এক সপ্তাহের নমুনা পরীক্ষা ও রোগী শনাক্তকরণের হার বিবেচনার আলোকে দেশে করোনার তিন মাত্রার ঝুঁকি (অতি উচ্চ, উচ্চ ও মধ্যম) চিহ্নিত করেছে সংস্থাটি। সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, খুলনা বিভাগের ১০টি জেলাই সংক্রমণের অতি উচ্চঝুঁকিতে আছে। রাজশাহী বিভাগের আট জেলার মধ্যে ছয়টি অতি উচ্চঝুঁকিতে এবং দুটি আছে উচ্চঝুঁকিতে।
ঢাকা বিভাগের সাতটি জেলা রয়েছে অতি উচ্চঝুঁকিতে। রাজধানী ঢাকাসহ দুটি জেলা আছে উচ্চঝুঁকিতে আর চারটি জেলা রয়েছে মধ্যমঝুঁকিতে। রংপুর বিভাগের পাঁচটি অতি উচ্চ এবং তিনটি জেলা উচ্চঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে চট্টগ্রামসহ ছয়টি জেলা অতি উচ্চ, তিনটি জেলা উচ্চ এবং একটি জেলা মধ্যমঝুঁকিপূর্ণ। বরিশাল বিভাগে তিনটি জেলা অতি উচ্চঝুঁকিতে এবং তিনটি জেলা মধ্যমঝুঁকিপূর্ণ।
গত ২৪ ঘণ্টায় সংক্রমণ আরও বেড়েছে : গত এক দিনে দেশে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা আবার গত আড়াই মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে। এ সময় সারা দেশে ৬ হাজার ৫৮ জনের করোনাভাইরাস সংক্রমণ চিহ্নিত হয়েছে। এই রোগে মারা গেছে ৮২ জন। দেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ৮ লাখ ৭২ হাজার ৯৩৫ জন। তাদের মধ্যে ১৩ হাজার ৮৬৮ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এ ভাইরাস। এর আগে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে ১২ এপ্রিল এক দিনে ৭ হাজার ২০১ জন নতুন রোগী শনাক্তের খবর এসেছিল।
গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হওয়া নতুন রোগীদের মধ্যে ১ হাজার ৫৭২ জনই ঢাকা জেলার। আর খুলনা বিভাগে সবচেয়ে বেশি ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে গত এক দিনে।
নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ২০ শতাংশের কাছাকাছি। বুধবারও এক দিনে কভিডের নমুনা পরীক্ষার অনুপাতে শনাক্তের হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এর ঠিক সাত দিন আগে যা ১৫ শতাশের কিছুটা বেশি ছিল।
গত বছর মার্চে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পর গত ১৫ মাসে পরীক্ষার বিপরীতে গড় শনাক্তের হার ছিল ১৩ দশমিক ৪১ শতাংশ। গত বুধবার পর্যন্ত গত ৯ দিন ধরেই দৈনিক শনাক্তের হার তার চেয়ে বেশি থাকছে।