তাকওয়া গুনাহের প্রতিবন্ধক

وَ لِمَنۡ خَافَ مَقَامَ رَبِّهٖ جَنَّتٰنِ ﴿ۚ۴۶﴾
আর যে তার রবের সামনে দাঁড়াতে ভয় করে, তার জন্য থাকবে দু’টি জান্নাত। [সুরা আর রাহমানঃ ৪৬]

যে ব্যক্তি আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর ভয় করে, ভয় করে এমন এক দিনের যেদিন তাকে আল্লাহর সামনে তার সকল কর্মের জবাবদিহিতা করতে হবে, প্রত্যেক আমলের স্বীকারোক্তি করতে হবে – এমন ব্যক্তির জন্য আল্লাহ দুটি জান্নাত রেখেছেন।
আরেকটি তাফসির হচ্ছে, হাদীসে আছে যে, ‘‘দু’টি জান্নাত রূপার হবে। যার প্লেট এবং তাতে বিদ্যমান সব কিছুই রূপার হবে। দু’টি জান্নাত সোনার হবে। তার প্লেট এবং তাতে বিদ্যমান সব কিছুই সোনার হবে।’’ (বুখারীঃ তাফসীর সূরা রাহমান) কোন কোন উক্তিতে এসেছে যে, সোনার বাগান বিশিষ্ট মু’মিন مُقَرَّبِيْنَ তথা নৈকট্যপ্রাপ্তদের জন্য হবে এবং রূপার বাগান হবে সাধারণ মু’মিন যথা, أَصْحَابُ الْيَمِيْنِ ডান দিকের অধিকারীদের জন্য।

তাকওয়া কি?

এক ব্যক্তি নির্জনে অবস্থান করছে। তাকে দেখার মতো সেখানে কেউ নেই। সেখানে কোনো গোনাহ করতে চাইলে বাহ্যিকভাবে কোনো প্রতিবন্ধকতাও নেই। সেই নির্জন জায়গায় অন্তরে গোনাহের চাহিদা সৃষ্টি হলো। কিন্তু সে চিন্তা করলো যে, কোনো মানুষ যদিও আমাকে দেখছে না, কিন্তু আমার আল্লাহ তো আমাকে দেখছেন। একদিন আমাকে তার সামনে দাঁড়াতে হবে। এ কথা চিন্তা করে সে ঐ গোনাহের কাজ ছেড়ে দিলো। এমন ব্যক্তির জন্যই এ আয়াতে দুই জান্নাতের ওয়াদা রয়েছে। আর এরই নাম তাকওয়া। আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর কথা চিন্তা করে নিজের প্রবৃত্তির শক্তিশালী ও সুদৃঢ় চাহিদাকে ত্যাগ করার নামই তাকওয়া। সে চিন্তা করে যে, দুনিয়ার মানুষ যদিও আমাকে দেখছে না, কিন্তু একজন আমাকে ঠিকই দেখছেন। সমস্ত তরীকত শরীয়তেরও সার-নির্যাস এটাই যে, অন্তরে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হবে যে, আমাকে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে।

আল্লাহ তাআলার শ্রেষ্ঠত্ব

এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা একথা বলেননি যে, যে ব্যক্তি জাহান্নামকে ভয় করলো বা আযাবকে ভয় করলো বা আগুনকে ভয় করলো বরং বলেছেন,
যে ব্যক্তি তার প্রভুর সামনে দাঁড়ানোকে ভয় করলো। যার অর্থ এই যে, তার অন্তরে আল্লাহ তাআলার শ্রেষ্ঠত্ব বিদ্যমান। সে চিন্তা করে, এ গোনাহের কারণে আল্লাহ তাআলা আযাব দেন বা না দেন, কিন্তু আমি আল্লাহর সামনে এই গোনাহ করে কিভাবে দাঁড়াবো? যার অন্তরে কারো প্রতি সমীহ থাকে তার মারার বা শাস্তি দেওয়ার ভয় না থাকলেও এই সমীহের কারণে তার অন্তরে ভয় সৃষ্টি হয় যে, তার সন্তুষ্টির পরিপন্থী কাজ করে তার সামনে গিয়ে আমি কিভাবে তাকে মুখ দেখাবো? এই ভয়ের নাম তাকওয়া।

আল্লাহকে সমীহ

অনেক মানুষকে আমরা অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখি৷ যেমন, বাবা-মা, দাদা-দাদী, শিক্ষক ইত্যাদি। শাস্তির ভয়ে নয়, বরং কেবল তাদের প্রতি সম্মান ও ও সমীহের কারণে আমরা এমন অনেক কাজ থেকে বিরত থাকি যাতে তারা আমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট না হন। একজন মানুষের জন্য যদি অন্তরে এমন শ্রদ্ধাবোধ থাকতে পারে, তাহলে বিশ্বজগতের এটা, যিনি সবকিছুর খালেক এবং মালেক তার ব্যাপারে অন্তরে এই শ্রদ্ধাবোধ অবশ্যই থাকা উচিত যে, মানুষ ভয় করবে আমি তার সামনে এমন কাজ এবং এমন গোনাহ করে কিভাবে দাঁড়াবো, তাকে কিভাবে মুখ দেখাবো? এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন,
وَ اَمَّا مَنۡ خَافَ مَقَامَ رَبِّهٖ وَ نَهَی النَّفۡسَ عَنِ الۡهَوٰی ﴿ۙ۴۰﴾

আর যে লোক তার প্রতিপালকের সামনে দাঁড়ানোকে ভয় করেছিল এবং নিজেকে কামনা বাসনা থেকে নিবৃত্ত রেখেছিল। [সুরা নাজিয়াতঃ ৪০]

রবের অবস্থানের দুটি অর্থ হতে পারে,
এক. রবের সামনে হাজির হয়ে হিসাবনিকাশের সম্মুখীন হতে হবে- এ বিশ্বাস করে প্রবৃত্তির অনুসরণ হতে যে নিজেকে হেফাযত করেছে তার জন্য রয়েছে জান্নাত।
দুই. রবের যে সুমহান মর্যাদা তাঁর এ উচ্চ মর্তবার কথা স্মরণ করে অন্যায় অশ্লিল কাজ এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে বিরত থেকেছে সে জান্নাতে যাবে। উভয় অর্থই এখানে সঠিক।
তার মনে এই ভয় কাজ করে যে, যদি আমি পাপ এবং আল্লাহর নাফরমানী করি তাহলে আমাকে আল্লাহ হতে কেউ বাঁচাতে পারবে না। এ জন্যই সে পাপাচার থেকে দূরে থেকেছে। এর দরুণ সে নিজেকে সেই সব পাপাচার এবং হারামকৃত জিনিসে লিপ্ত হওয়া থেকে বাঁচাত, যে দিকে তার মন আকৃষ্ট হত।
জাহান্নাম এবং আল্লাহর আযাবকে এই জন্য ভয় করতে হবে যে, তা আল্লাহ তাআলার অসন্তষ্টি এবং ক্রোধের প্রকাশস্থল। আসল ভয় তো হতে হবে আল্লাহর শ্রদ্ধার কারণে। এক আরব কবি বলেন,
لَا تَسْقِنِي مَاءَ الْحَيَاةِ بِذِلَّةٍ بَلْ تَسْقِينَ بِالْعِرْيَاسَ الْحَنظل
‘আমাকে লাঞ্ছিত করে আবেহায়াতও [সঞ্জীবনী পানি। অমৃতের স্বাদ।] পান করিও না।’ অর্থাৎ আমি অপমানিত হয়ে আবেহায়াত পান করতেও রাজি নই। আমাকে তিতা জিনিস পান করাও, কিন্তু সম্মানের সাথে পান করাও।
মোটকথা, যার অন্তরে আল্লাহর মারেফত রয়েছে, সে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চায় এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে বাঁচতে চায়। আর যেহেতু জাহান্নাম ও আযাব আল্লাহর অসন্তুষ্টির প্রকাশস্থল, এ জন্য জাহান্নাম ও আজাবকে ভয় পায়। অন্যথায় আসল ভয়ের জিনিস তো হলো আল্লাহর অসন্তুষ্টি।

তাকওয়ার প্রসিদ্ধ এক গল্প

তাকওয়া নিয়ে প্রসিদ্ধ একটি ঘটনা বর্ণিত আছে যে, হযরত ওমর ফারুক রা. তাঁর খেলাফতকালে মানুষের অবস্থা জানার জন্য রাতের বেলা ঘুরে বেড়াতেন। কােনোভাবে যদি জানতে পারতেন যে, অমুক ব্যক্তি উপবাসে আছে তাহলে তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করতেন, চেষ্টা করতেন তার প্রয়োজন পূরণের। যদি জানতে পারতেন যে কেউ বিপদগ্রস্ত তাহলে তার বিপদ দূর করতেন। কাউকে অন্যায় কাজ করতে দেখলে তাকে সংশোধন করতেন। আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকারের চর্চা করতেন।
একদিন তিনি রাতের বেলা মদীনার অলীগলিতে ঘুরছিলেন। মূলত তিনি তার মিশনে বেরিয়ে ছিলেন। মানুষের কষ্ট লাঘবের মিশন, তাদের বিপদ দূর করার মিশন, তাদের ক্ষুধা দূর করার মিশন। এমন সময় এক ঘর থেকে দুই মহিলার কথা বলার আওয়াজ আসে। কন্ঠ শুনে বোঝা গেলো, তাদের একজন বৃদ্ধা এবং অপরজন যুবতী।
বৃদ্ধাটি যুবতি মেয়েকে বলছে, তুমি যেই দুধ দোহন করেছ তার মধ্যে পানি মেশাও। তাহলে দুধের পরিমাণ বেড়ে যাবে। অনেকজনকে বিক্রি করতে পারবে। তোমার লাভ হবে বেশী।
যুবতী মেয়ে উত্তর দিলো, আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর ফারুক রা., নির্দেশ জারি করেছেন যে কেনো দুধ বিক্রেতা যেন দুধের মধ্যে পানি না মেশায়। তাই আমাদের পানি মেশানো উচিত না।
উত্তরে মেয়েটির মা বললো, আমিরুল মুমিনিন তো এখানে বসে নেই। তুমি দুধের মধ্যে পানি মেশালে কে দেখবে? দেখার মতো কেউ নেই তো। তিনি কি করে জানতে পারবেন যে তুমি পানি মিশিয়েছো?
উত্তরে মেয়েটি বললো, আমিরুল মুমিনিন না দেখুক, কিন্তু আমিরুল মুমিনীনের শাসক আল্লাহ তাআলা দেখছেন তো। আমি আল্লাহর সামনে এই কাজ করতে পারব না। তাই এ কাজ আমি করব না।
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আমিরুল মুমিনিন হজরত উমর ফারুক রা. কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিলেন। তিনি পরিবারটির ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করলেন। জেনে নিলেন বৃদ্ধা মহিলা ও যুবতী মেয়েটির ব্যাপারে। এরপর সেই তাকওয়াবান যুবতীটিকে তিনি তার ছেলে হজরত আবদুল্লাহ ইবনু উমর রা.-এর বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। এই বিয়ের ফলে ঐ মেয়ের বংশে তার নাতি হযরত উমর ইবনু আবদুল আযীয জন্ম গ্রহণ করেন। তাকে মুসলিম উম্মাহর পঞ্চম খলীফায়ে রাশেদা বলা হয়।
মেয়েটির অন্তরে এই বোধ ছিল যে, তাকে আমিরুল মুমিনিন না দেখলেও মহান আল্লাহ তাআলা দেখছেন। এই বোধই হল প্রকৃত তাকওয়া। আর তাকওয়াবানরাই সফলকাম।

Leave a Comment