১৩ আসামির ফাঁসির রায়

রাজধানীর অদূরে সাভারের আমিনবাজারে ১০ বছরের বেশি সময় আগে ডাকাত সন্দেহে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ১৩ জনকে মৃত্যুদন্ড ও ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছে আদালত। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ইসমত জাহান আলোচিত এ মামলার রায় দেন।

মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন আবদুল মালেক, সাঈদ মেম্বার, আবদুর রশিদ, ইসমাইল হোসেন রেফু, নিহার ওরফে জমশের আলী, মীর হোসেন, মজিবর রহমান, আনোয়ার হোসেন, রজুর আলী সোহাগ, আলম, রানা, আবদুল হামিদ ও আসলাম মিয়া। এছাড়া দন্ডবিধির অন্য দুটি ধারায় তাদের আরও সাত বছর করে কারাদন্ড, ৩০ হাজার টাকা অর্থদন্ড অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদন্ড দেয় আদালত।

রায়ে যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্তরা হলেন শাহীন আহমেদ, ফরিদ খান, রাজীব হোসেন, মো. ওয়াসিম, সাত্তার, সেলিম, মনির হোসেন, আলমগীর, মোবারক হোসেন, অখিল খন্দকার, বশির, রুবেল, নূর ইসলাম, শাহাদাত হোসেন রুবেল, টুটুল, মাসুদ, মোখলেছ, তোতন ও সাইফুল। তাদের প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা করে অর্থদন্ড অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। এছাড়া দন্ডবিধির অন্য দুটি ধারায় তাদের আরও সাত বছর করে কারাদন্ড, ১০ হাজার টাকা করে অর্থদন্ড অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে।

মামলার মোট ৬০ আসামির মধ্যে বিচার চলাকালে তিনজন মারা যাওয়ায় তাদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় বাকি ২৫ জনকে খালাস দিয়েছে আদালত।

মারা যাওয়া তিন আসামি হলেন, কবির হোসেন, রাশেদ ও পর্বত।

রায় দেওয়ার পর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি আনন্দ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, বিচারকালে তারা আদালতে যেসব সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন তাতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন।

যা বললেন ভুক্তভোগী ও দন্ডপ্রাপ্তদের স্বজনরা : রায় শুনতে সকাল থেকে আদালতে হাজির হন ভুক্তভোগী এবং আসামির পরিবারের সদস্যসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকে। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় নিহত টিপু সুলতানের মা কাজী নাজমা সুলতানা বলেন, ‘সব আসামির ফাঁসি আশা করেছিলাম, তাহলে বেশি খুশি হতাম। তবে এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। দ্রুত যেন আসামিদের ফাঁসি কার্যকর হয়।’ আরেক নিহত ছাত্র পলাশের বাবা মজিবুর রহমান বলেন, ‘ন্যায়বিচার পেয়েছি, তবে রায় যেন দ্রুত কার্যকর হয়।’

রায় ঘোষণা শেষে যখন আদালতের এজলাস থেকে আসামিদের বের করা হয় তখন তাদের সামনে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা। দন্ডপ্রাপ্ত একজনের স্বজন তাসকিন বলেন, ‘সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে ২০ জনই তার আত্মীয়স্বজন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের তো সব শেষ হয়ে গেল। বাড়ি গিয়ে কী বলব?’ রাকিব নামে একজন বলেন, ‘আমার দুই মামার সাজা হয়েছে। তারা তো ঘটনার সময় এলাকায় ছিল না, ঘটনার সঙ্গে তারা জড়িত না। তারপরও তাদের সাজা হলো।’

আসামিপক্ষের আইনজীবী শিউলী আক্তার খান ও শেখ সিরাজ উদ্দিন বলেন, তারা ন্যায়বিচার পাননি। উচ্চ আদালতে যাবেন। আশা করছেন, আসামিরা সেখানে খালাস পাবেন।

সেদিন যা ঘটেছিল : ২০১১ সালের ১৭ জুলাই পবিত্র শবেবরাতের রাতে আমিনবাজারের বরদেশি গ্রামের কেবলারচরে ডাকাত আখ্যা দিয়ে ছয় ছাত্রকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নিহতরা হলেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ম্যাপল লিফের ‘এ’ লেভেলের ছাত্র শামস রহিম শামাম (১৮), মিরপুর বাঙলা কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তৌহিদুর রহমান পলাশ (২০), একই কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ইব্রাহিম খলিল (২১) ও উচ্চ মাধ্যমিক বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র কামরুজ্জামান কান্ত (১৬), তেজগাঁও কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র টিপু সুলতান (১৯) ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সিতাব জাবির মুনিব (২০)। তারা ছিলেন পরস্পরের বন্ধু। তাদের সঙ্গে থাকা আরেক বন্ধু আল-আমিন গুরুতর আহত অবস্থায় প্রাণে বেঁচে যান। শবেবরাতের রাতে নামাজ পড়ে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে তারা বের হন বলে স্বজন ও বন্ধুরা জানান।

কেবলারচরে অবস্থানের সময় রাত ১টার দিকে স্থানীয় কিছু লোক তাদের ডাকাত আখ্যা দিয়ে পিটিয়ে ও কুপিয়ে জখম করে। পরে আহত আল-আমিনের কাছ থেকে ভয়াবহ সেই ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। তখন তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ১৭ জুলাই রাতে তারা সাত বন্ধু দারুস সালাম এলাকার একটি মসজিদে নামাজ পড়তে যান। নামাজ পড়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে তারা মসজিদ থেকে বের হন এবং রাত ১২টার দিকে হাঁটতে হাঁটতে আমিনবাজারের বরদেশি গ্রামে যান। রাত সোয়া ১টার দিকে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলে সেখানকার একটি কুঁড়েঘরে আশ্রয় নেন সাতজন। এরপরই আচমকা একদল লোক ডাকাত বলে তাদের ওপর হামলা চালায়।

ঘটনার পর সাভার থানায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করে পুলিশ। অন্যদিকে ডাকাতির অভিযোগ এনে বেচে যাওয়া আল-আমিন এবং নিহত ছয় ছাত্রের নামে একটি মামলা করেন স্থানীয় বালু ব্যবসায়ী মালেক। পরে আলোচিত ওই ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তে বেরিয়ে আসে নিহত ছাত্ররা ডাকাত ছিল না এবং হত্যা এড়াতে পুলিশ যথাযথ ভূমিকা পালন করেনি।

বিচার প্রক্রিয়া : বালু ব্যবসায়ী মালেকের অভিযোগের প্রমাণ না পাওয়ায় তার মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। মিথ্যা মামলার অভিযোগে মালেকের বিরুদ্ধে মামলা করারও নির্দেশ দেয় আদালত।

ছয় ছাত্রকে হত্যা মামলার তদন্তভার থানা পুলিশের হাত থেকে সিআইডি এবং পরে আদালতের নির্দেশে র‌্যাবের হাতে যায়। র‌্যাবের সহকারী পরিচালক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরীফ উদ্দিন ২০১৩ সালের ১৩ জানুয়ারি সেই মালেকসহ ৬০ জনকে আসামি করে ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে অভিযোগপত্র দেন। এ মামলায় ১৪ আসামি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। ২০১৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর একই আদালত ৬০ আসামি বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে। বিচারকালে রাষ্ট্রপক্ষে ৫৫ জন সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণের পর তাদের জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। গত ২২ নভেম্বর এই মামলায় রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায়ের জন্য ২ ডিসেম্বর (গতকাল) দিন ধার্য করে আদালত।

Leave a Comment