হিসাবের ধার ধারছে না, ভাড়া নিচ্ছে আরও বেশি

সকাল সাড়ে আটটা। রাজধানীর ফার্মগেটে বিকল্প পরিবহনের একটি বাসে উঠে বসলাম। গন্তব্য মিরপুর–১০। বসতেই পাশের এক যাত্রীকে বলতে শোনা গেল, ‘দুঃখের বিষয় হইল, তেলের দাম কমলে ভাড়া কমবে না।’

চালকের সহকারী (হেলপার) নূরে আলম এসে ভাড়া চাইলেন। বললাম, ‘মিরপুর ১০ নম্বর যাব। ভাড়া কত?’ তিনি বললেন, ‘২০ টাকা’। পাশেই জানালায় নতুন ভাড়ার একটি তালিকা সাঁটিয়ে দেওয়া আছে। সেখানে লেখা, ‘ফার্মগেট থেকে মিরপুর-১২-এর দূরত্ব ৯ কিলোমিটার। সরকার নির্ধারিত ২ টাকা ১৫ পয়সা হিসাবে ভাড়া ১৯ টাকা ৩৫ পয়সা।’ মিরপুর-১০ থেকে মিরপুর-১২ পর্যন্ত দূরত্ব ২ দশমিক ৮ কিলোমিটার। সেই হিসাবে ভাড়া হয় ১৫ টাকার কম। তাই ভাড়া ১৫ টাকা দিতে চাইলে চালকের সহকারী তা নিতে নারাজ। অনেক কথার পর ২০ টাকা নিয়েই ক্ষান্ত হন তিনি।

আমার ঠিক পাশের আসনে বসা ছিলেন আবদুস সালাম নামের পঞ্চাশোর্ধ্ব এক ব্যক্তি। আমার একটু আগেই তিনি ভাড়া দিয়েছেন। তখন তিনি চালকের সহকারীকে প্রশ্ন করলেন, ‘ফার্মগেট থেকে আমি যাব আগারগাঁওয়ের তালতলা। তাহলে আমার কাছ থেকে ২০ টাকা রাখলেন কেন? বাকি টাকা ফেরত দেন।’ হেলপার বললেন, ‘২০ টাকাই ভাড়া। টাকা ফেরত হবে না।’ ফার্মগেট থেকে তালতলা চার কিলোমিটার। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৯ টাকা ভাড়া হয়, সেখানে ২০ টাকা নেওয়া হলো।

এভাবে কারওয়ান বাজার ও ফার্মগেট থেকে মিরপুরগামী সব যাত্রীর কাছ থেকেই ২০ টাকা করে আদায় করছিলেন বিকল্প পরিবহনের এই সহকারী।

সরকার মহানগরে গণপরিবহন ভাড়া বাড়িয়ে কিলোমিটারে ২ টাকা ১৫ পয়সা করা হয়েছে। কিন্তু মালিকপক্ষ আরেকটি ভাড়া নির্ধারণ করে। সেটাকে তারা ‘ওভিল’ বলে থাকে। একটি সুনির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থান করা পরিবহন মালিকপক্ষের নিয়োগকৃত কর্মী বাস থামিয়ে যাত্রীর সংখ্যা লিখে রাখেন। সে অনুযায়ী তাঁরা ভাড়ার হিসাব করে থাকেন।

ভাড়া নিয়ে কয়েকজন যাত্রী উত্তেজিত হয়ে পড়লে চালকের সহকারী নূরে আলমকে বলতে শোনা যায়, ‘মামা, আঙ্গরে কইয়া লাভ নাই। আমরা একজনের চাকরি করি। আঙ্গরে পারবেন দুই কথা কইতে। আমাগো কিছুই করার নাই। ওরা এইখানে যা লেখছে, ওরা (মালিকপক্ষ) রাত্রে আমার কাছ থেকে তাই নিব।’

কাজীপাড়া আসতেই বাসের সামনের দিকে হঠাৎ এক যাত্রীর উচ্চবাচ্য। একপর্যায়ে তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলতে লাগলেন, ‘যদি আল্লাহর গজব পড়ত, সব মরে যাইত। একবারে সবাই ধ্বংস হয়ে যাইতাম।’

মো. রফিকুল ইসলাম নামের সেই যাত্রী বলেন, ‘কাজীপাড়া থেকে ১০ নম্বর প্রথম ১০ টাকা চাইছিল। আমি চিল্লাপাল্লা করলাম। তখন অন্য যাত্রীরাও কথা বলল। তারপরে নূরে আলম ২ টাকা ফেরত দিল।’ তাঁর প্রশ্ন, ‘যতই ভাড়া নির্ধারণ করুক, কাজীপাড়া থেকে মিরপুর-১০ নম্বর কখনো ১০ টাকা ভাড়া হয়?’ কাজীপাড়া থেকে মিরপুর ১০ নম্বরের দূরত্ব এক কিলোমিটারের একটু বেশি।

সামনে এগোতে এগোতে নূরে আলম বলেন, ‘৮ টাকা ভাড়া নিলে ২ টাকা ভাঙতির সমস্যা হয়। তাই ১০ টাকা চাই।’
সদরঘাটের উদ্দেশে যাত্রা

মিরপুর-১০ নম্বরে বিকল্প পরিবহন থেকে নেমেই বিহঙ্গ পরিবহনের আরেকটি বাসে উঠে বসি। এবার গন্তব্য সদরঘাট। আসন পাই পেছনের দিকে। সেখানে কয়েকজন ভাড়া নিয়েই কথাবার্তা বলছিলেন। তাঁরা মাথাপিছু কয় টাকা করে ভাড়া বাড়ল, সেই হিসাব কসছিলেন।

বিহঙ্গের এই বাস মিরপুরের যেকোনো জায়গা থেকে গুলিস্তান ৩৫ টাকা (আগে নিত ২৫ টাকা) এবং সদরঘাট পর্যন্ত ৪০ টাকা (আগে নিত ৩০ টাকা) ভাড়া নিচ্ছিল। জনপ্রতি ভাড়া বাড়তি নিচ্ছে ১০ টাকা করে।

সেই যাত্রীরা হিসাব করে দেখলেন, বিহঙ্গ বাসটিতে ৪৯টি আসন রয়েছে। প্রতি সিটে বাড়তি ১০ টাকা নিলে এক ট্রিপেই বাসটি ৪৯০ টাকা বাড়তি ভাড়া পাচ্ছে। অথচ মিরপুর-১২ থেকে সদরঘাট পর্যন্ত দুই–তিন লিটার তেল লেগেছে। অর্থাৎ তেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়লে তাদের এক ট্রিপে বাড়তি খরচ হচ্ছে সর্বোচ্চ ৪৫ টাকা, কিন্তু যাত্রীদের কাছ থেকে পাচ্ছে ৪৯০ টাকা।

যাত্রীদের একজন বলছিলেন, ‘যার ৪০০ টাকা আয়, সে ৪-৫ জনের সংসার চালাবে কী করে?’ তাঁদের একজন মো. বাবুল মিয়া বলেন, ‘আমরা কেমনে চলমু। আমাদের মতো মানুষের তো মরণ।’

আরেক যাত্রী বলেন, ‘মানুষ কথা বলে না, এটা তাদের শাস্তি।’ তখন আরেকজন বলেন, ‘কে আন্দোলন করব? দিনে ভিডিও করে রাখব, রাতে উঠাই লইয়া যাইব।’

বিহঙ্গ পরিবহনের এই বাসে নতুন ভাড়ার মূল্যতালিকা টানানো ছিল না। চালকের সহকারী মো. খবির যাঁর কাছেই ভাড়া চাইছিলেন, তাঁর সঙ্গেই কথা–কাটাকাটি হচ্ছিল। বাসে তিনজন শিক্ষার্থী ছিল।

কারওয়ান বাজারের দুজন ছাত্রের কাছ থেকে ১০ টাকা ভাড়া নিলেও সদরঘাটের উদ্দেশে রওনা দেওয়া ছাত্রীর কাছ থেকে ৪০ টাকা নেন চালকের সহকারী। তখন আশপাশের যাত্রীরা খেপে গেলে ছাত্রীকে ২০ টাকা ফিরিয়ে দেন খবির।

এই বাসে নতুন নির্ধারিত ভাড়ার মূল্যতালিকা টানানো হয়নি। বিকেলে টানানো হবে বলে জানান চালকের সহকারী।

শাহবাগ পার হওয়ার পর কবি নজরুল কলেজের এক শিক্ষকের সঙ্গে বেশ জোরেশোরে বেধে যায় বাসের খবিরের সঙ্গে। ওই শিক্ষক ফার্মগেট থেকে উঠেছেন, যাবেন সদরঘাট। খবিরকে তিনি ২০ টাকা দেন। কিন্তু ২৫ টাকা চান। শিক্ষকের যুক্তি, ‘আগে ১৫ টাকা ভাড়া ছিল, ২৬ শতাংশ ভাড়া বেড়েছে। তাহলে ভাড়া সর্বোচ্চ ১৯-২০ টাকা হয়। আপনি কেন ২৫ টাকা চান?’ তবে বাসের চালকের সহকারী খবির এর সদুত্তর দিতে পারেন না। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ তর্কাতর্কির পর তিনি সেই ২০ টাকা ফেরত দেন শিক্ষককে। এর কিছুক্ষণ পর এসে আবার টাকা চান খবির। শিক্ষক ২০ টাকাই সাধেন। তখন চালকের সহকারী বলেন, ‘২৫ টাকাই দিতে হবে। এক টাকাও কম হবে না।’ এই বলে চলে যান।

হিসাব করলে দেখা যায়, ফার্মগেট থেকে সদরঘাট ৮ কিলোমিটার। কিলোমিটারে ২.১৫ পয়সা হিসাবে এখানে ভাড়া ১৭ টাকা হওয়ার কথা।
পল্টন মোড়ে এলে যাত্রীদের ওঠার আগেই খবির বলে নিচ্ছিলেন, সদরঘাটে গেলে ১০ টাকা করে দিতে হবে।

তখন পাশের আসনে বসা আইনজীবী কাজী সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, পল্টন থেকে সদরঘাট আগে ৫ টাকা ভাড়া ছিল। এখন ১০ টাকা করে নিলে ভাড়া তো শতভাগ বাড়ল।

কাজী সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, তেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়লেও গাড়ির অন্য খরচ তো বাড়েনি। চালকের সহকারী একজনই আছে, চালকও একজনই আছে। সেই হিসাবে ভাড়া তো দ্বিগুণ হতে পারে না। বাসমালিকেরা গতকাল যা লাভ করতেন, আজ থেকে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি লাভ করবেন।

ফেরার পথে

যানজটের কারণে বিহঙ্গ পরিবহনের বাসে গুলিস্তান পর্যন্ত যাওয়ার পর নেমে গেলাম। এবার কারওয়ান বাজার ফিরব। এবার পল্টন থেকে উঠলাম শিকড় পরিবহনের একটি বাসে। পল্টন থেকে কারওয়ান বাজারের দূরত্ব ৩ দশমিক ৮ কিলোমিটার। সেই হিসাবে ভাড়া হয় ৮ টাকা। কিন্তু চালকের সহকারী ১৫ টাকার নিচে ভাড়া নেবেই না।

ইতিমধ্যে বাসের আসন পূর্ণ হয়ে যাত্রীরা দাঁড়িয়ে আছেন। বাড়তি ভাড়া চাওয়ায় বাসের মধ্যে একধরনের হইচই শুরু হয়ে যায়। এক যাত্রী বলেন, তেলের দাম বাড়লেও গ্যাসের বাসও বাড়তি ভাড়া নিচ্ছে। আরেক যাত্রী বলেন, গ্যাসের বাস কীভাবে চিনবেন? একজন স্টিকার লাগিয়ে দেওয়ার কথা বলেন। আরেকজন বলেন, ওরা স্টিকার রাখবে না। আরেক যাত্রীর ভাষ্য, ‘২৫ টাকার ভাড়া কে ৩৫ টাকা দিব? ভাড়া নিয়া মারামারি অইব।’

চালকের সহকারীর ওপর খেপে গিয়ে এক যাত্রী বলেন, ‘তরা সরকারের লগে তেলের দাম কমানোর লেইগা মিটিং কর। তা না কইরা ভাড়া ভাড়ানের লেইগা মিটিং করস ক্যা?’

আরেক যাত্রী বলেন, ‘এনে কারও দোষ নাই, সরকারের দোষ। এগুলো করতাছে সরকার। এক দেশের এক সরকার, বুঝেন না। যদি পাঁচ বছর পরপর চেঞ্জ হইত, তাইলে এগুলা থাকত না।’

Leave a Comment