হাদিসে নববিতে উত্তম চরিত্রের পাঠ

হাদিসে নববিতে উত্তম চরিত্রের পাঠ, আজকের দুনিয়া আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। মানুষ ছুটে চলেছে বস্তুবাদের পেছনে। এমন জামানায় উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষ খুঁজে পাওয়া খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতোই। কিভাবে ভালোবাসা, দৃঢ়তা ও নৈতিকতার সাথে দুনিয়ায় বসবাস করা যায় তার পথে সর্বদা খুঁজে চলেছি আমরা। 

হাদিসে নববিতে উত্তম চরিত্রের পাঠ

হাদিসে নববিতে উত্তম চরিত্রের পাঠ, হাদিসে নববি হচ্ছে প্রজ্ঞা ও অনুপ্রেরণার বিপুল এক ভাণ্ডার। এটি পরিপূর্ণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের কথামালা, কাজ ও সম্মতি দ্বারা।    

কিভাবে অসাধারণ চরিত্রের অধিকারী হওয়া যায় তা নিয়ে অসংখ্য পরামর্শ আছে হাদিসে নববিতে। এসব হাদিসে দয়া, বিনয়, ধৈর্য, সবর ও অন্যান্য নানা গুণের কথা উঠে এসেছে যেগুলো মায়াবি বন্ধন তৈরীতে ও ন্যায়পরায়ণ সমাজগঠনে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। 

উত্তম চরিত্রের উপর হাদিস

আমরা এই লেখায় নির্বাচিত কিছু হাদিস তুলে ধরেছি যেগুলো সুন্দর চরিত্র অর্জনের পথকে আমাদের জন্য আলোকিত করে দেবে। পবিত্র হাদিস পাঠের দ্বারা আমরা সেগুলোর ভেতর নিহিত প্রজ্ঞার খোঁজ করব। হাদিসে নববিতে উত্তম চরিত্রের পাঠ, প্রতিটি হাদিস হবে আমাদের জন্য পথপ্রদর্শক। আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে ও সিদ্ধান্তগ্রহণে হাদিসে নববি অনুসরণের গুরত্ব স্মরণ করিয়ে দিবে হাদিসগুলো। আসুন, শুরু করা যাক হাদিসের পানে যাত্রা।  

প্রথম হাদিস

আয়িশা রা. হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

إِنَّ مِنْ أَكْمَلِ الْمُؤْمِنِينَ إِيمَانًا أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا وَأَلْطَفُهُمْ بِأَهْلِهِ

যার চরিত্র ভালো এবং যে নিজ পরিবার-পরিজনের সাথে দয়ার্দ্র ব্যবহার করে সে-ই ইমানের দিক হতে পরিপূর্ণ মুমিন।  [সুনানু তিরমিজিঃ ২৬১২]

দ্বিতীয় হাদিস

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

كُنْ وَرِعًا تَكُنْ أَعْبَدَ النَّاسِ وَكُنْ قَنِعًا تَكُنْ أَشْكَرَ النَّاسِ وَأَحِبَّ لِلنَّاسِ مَا تُحِبُّ لِنَفْسِكَ تَكُنْ مُؤْمِنًا وَأَحْسِنْ جِوَارَ مَنْ جَاوَرَكَ تَكُنْ مُسْلِمًا وَأَقِلَّ الضَّحِكَ فَإِنَّ كَثْرَةَ الضَّحِكِ تُمِيتُ الْقَلْبَ

হে আবু হুরায়রা! তুমি আল্লাহভীরু হয়ে যাও, তাহলে লোকেদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ইবাদতকারী হতে পারবে। তুমি অল্পে তুষ্ট থাকো, তাহলে লোকেদের মধ্যে সর্বোত্তম কৃতজ্ঞ হতে পারবে। তুমি নিজের জন্য যা পছন্দ করো, অন্যদের জন্যও তাই পছন্দ করবে, তাহলে পূর্ণ মুমিন হতে পারবে। তোমার প্রতিবেশীর প্রতি সদাচারী ও দয়াপরবশ হও, তাহলে মুসলিম হতে পারবে। তোমার হাসি কমাও, কেননা অধিক হাসি অন্তরাত্মাকে ধ্বংস করে। [সুনানু ইবনু মাজাহঃ ৪২১৭]

তৃতীয় হাদিস

আবদুল্লাহ ইবনু আমর রা. হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

الرَّاحِمُونَ يَرْحَمُهُمُ الرَّحْمَنُ ارْحَمُوا مَنْ فِي الأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ الرَّحِمُ شُجْنَةٌ مِنَ الرَّحْمَنِ فَمَنْ وَصَلَهَا وَصَلَهُ اللَّهُ وَمَنْ قَطَعَهَا قَطَعَهُ اللَّهُ ‏

আল্লাহ তাআলা দয়ালুদের উপর দয়া ও অনুগ্রহ করেন, যারা জমিনে বসবাসকারীদের প্রতি দয়া করবেন। দয়া রাহমান হতে উদগত। যে লোক দয়ার সম্পর্ক বজায় রাখে আল্লাহ তাআলাও তার সাথে নিজ সম্পর্ক বজায় রাখেন। যে লোক দয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করে, আল্লাহ তাআলাও তার সাথে দয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করেন। [সুনানু তিরমিজিঃ ১৯২৪]

চতুর্থ হাদিস

আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে প্রস্তাব করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! কাফির মুশরিকদের ওপর অভিসম্পাত করুন। উত্তরে তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 

إِنِّي لَمْ أُبْعَثْ لَعَّانًا وَإِنَّمَا بُعِثْتُ رَحْمَةً

আমাকে অভিসম্পাতকারী হিসেবে পাঠানো হয়নি, বরং আমাকে রহমতস্বরূপ পাঠানো হয়েছে। [সহিহ মুসলিমঃ ২৫৯৯]

পঞ্চম হাদিস

জুবাইর ইবনুল আওয়াম রা. হতে বর্ণিত আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

دَبَّ إِلَيْكُمْ دَاءُ الْأُمَمِ قَبْلَكُمْ الْحَسَدُ وَالْبَغْضَاءُ وَالْبَغْضَاءُ هِيَ الْحَالِقَةُ حَالِقَةُ الدِّينِ لَا حَالِقَةُ الشَّعَرِ وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَا تُؤْمِنُوا حَتَّى تَحَابُّوا أَفَلَا أُنَبِّئُكُمْ بِشَيْءٍ إِذَا فَعَلْتُمُوهُ تَحَابَبْتُمْ أَفْشُوا السَّلَامَ بَيْنَكُمْ

তোমাদের আগেকার উম্মাতদের রোগ তোমাদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে। তা হলো পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ ও ঘৃণা। আর এই রোগ মুণ্ডন করে দেয়। আমি বলছি না যে, চুল মুণ্ডন করে দেয়, বরং এটা দ্বীনকে মুণ্ডন (বিনাশ) করে দেয়। সেই মহান সত্তার শপথ, যার হাতে আমার জীবন! তোমরা ঈমানদার না হওয়া পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করবে না। তোমরা যদি পরস্পরকে না ভালবাস তাহলে ঈমানদার হতে পারবে না। আমি কি তোমাদেরকে বলবো না যে, পারস্পরিক ভালবাসা কোন কাজের মাধ্যমে মজবুত হয়? তোমরা পরস্পর সালামের বিস্তার ঘটাও। [সুনানু তিরমিজি : ২৫১০]

ষষ্ঠ হাদিস

ফাদালাহ ইবনু উবায়েদ রা. বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِالْمُؤْمِنِ مَنْ أَمِنَهُ النَّاسُ عَلَى أَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ وَالْمُفُسِهِمْ وَالْمَنَفُسِهِمْ وَالْمُسَهِمْ وَالْمُسْلِمْ وَالْمُسْلِمْ وَالْمُسْلِمْ وَالْمُسْلِمْ وَالْمُسْلِمْ وَالْمُسْلِمْ وَالْمُسْلِمْ وَالْمُسْلِمْ وَالْمُسْلِمْ وَالْمُسْلِمْ وَالْمُسْلِمْ وَالْمُسْلِمُ وَالْمُجَاهِدُ مَنْ جَاهَدَ نَفْسَهُ فِي طَاعَةِ اللَّهِ وَالْمُهَاجِرُ مَنْ هَجَرَ الْخَطَايَا وَالذَّنُوبَ

আমি কি তোমাকে জানাইনি? মুমিন সেই ব্যক্তি যার কাছে মানুষের জান-মাল নিরাপদ। মুসলমান সেই ব্যক্তি যার জিহ্বা ও হাত থেকে মানুষ নিরাপদ থাকে। আল্লাহর পথে জিহাদকারী সেই ব্যক্তি যে আল্লাহর আনুগত্য করে নিজের বিরুদ্ধে জিহাদ করে। হিজরতকারী সেই ব্যক্তি যে পাপ ও মন্দ কাজ থেকে দূরে থাকে। [মুসনাদু আহমাদ : ২৩৯৫৮]

সপ্তম হাদিস

আবদুল্লাহ ইবনু আমর রা. হতে বর্ণিত। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ النَّاسُ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ وَالْمُؤْمِنُ مَنْ أَمِنَهُ النَّاسُ عَلَى دِمَائِهِمْ وَأَمْوَالِهِمْ

সে-ই মুসলিম, যার জিহবা ও হাত হতে সকল মুসলিম নিরাপদ এবং সে-ই প্রকৃত মুহাজির, আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তা যে ত্যাগ করে। [সহিহ বুখারি : ১০]

অষ্টম হাদিস

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

لَيْسَ الشَّدِيدُ بِالصُّرَعَةِ إِنَّمَا الشَّدِيدُ الَّذِي يَمْلِكُ نَفْسَهُ عِنْدَ الْغَضَبِ

তারা শক্তিশালী নয় যারা কুস্তিগির। বরং প্রকৃত শক্তিশালী তারাই যারা রাগান্বিত অবস্থায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। [সহিহ বুখারি : ৬১১৪]

অন্য বর্ণনায় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

لَيْسَ الشَّدِيدُ مَنْ غَلَبَ النَّاسَ وَلَكِنَّ الشَّدِيدَ مَنْ غَلَبَ نَفْسَه

শক্তিশালী তারা নয় যারা মানুষকে পরাজিত করে। বরং শক্তিশালী তারাই যারা তাদের অহংকে পরাজিত করে। [মুশকিলুল আসার : ১৪২৬]

নবম হাদিস

আবদুল্লাহ ইবনু উমার রা. হতে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 

أَلاَ كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ فَالإِمَامُ الَّذِي عَلَى النَّاسِ رَاعٍ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ وَالرَّجُلُ رَاعٍ عَلَى أَهْلِ بَيْتِهِ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى أَهْلِ بَيْتِ زَوْجِهَا وَوَلَدِهِ وَهِيَ مَسْئُولَةٌ عَنْهُمْ وَعَبْدُ الرَّجُلِ رَاعٍ عَلَى مَالِ سَيِّدِهِ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْهُ أَلاَ فَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ

জেনে রেখো! তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল; আর তোমরা প্রত্যেকেই নিজ অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব ইমাম, যিনি জনগণের দায়িত্বশীল, তিনি তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। পুরুষ গৃহকর্তা তার পরিবারের দায়িত্বশীল; সে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী তার স্বামীর পরিবার, সন্তান-সন্ততির উপর দায়িত্বশীল, সে এসব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। কোন ব্যক্তির দাস স্বীয় মালিকের সম্পদের দায়িত্বশীল; সে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব জেনে রাখ, প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্বাধীন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। [সহিহ বুখারি : ৭১৩৮]

দশম হাদিস

ইবনু উমর রা. বর্ণনা করেন যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

أَحَبُّ النَّاسِ إِلَى اللَّهِ أَنْفَعُهُمْ لِلنَّاسِ وَأَحَبُّ الأَعْمَالِ إِلَى اللَّهِ سُرُورٌ تُدْخِلُهُ عَلَى مُسْلِمٍ أَوْ تَكْشِفُ عَنْهُ كُرْبَةً أَوْ تَقْضِي عَنْهُ دِينًا أَوْ تَطْرُدُ عَنْهُ جُوعًا وَلَأَنْ أَمْشِيَ مَعَ أَخِيهِ فِي حَاجَةٍ أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ أَنْ أَعْتَكِفَ فِي هَذَا الْمَسْجِدِ يَعْنِي مَسْجِدَ الْمَدِينَةِ شَهْرًا وَمَنْ كَفَّ غَضَبَهُ سَتَرَ اللَّهُ عَوْرَتَهُ وَمَنْ كَظَمَ غَيْظَهُ وَلَوْ شَاءَ أَنْ يُمْضِيَهُ أَمْضَاهُ مَلأَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ قَلْبَهُ أَمْنًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَمَنْ مَشَى مَعَ أَخِيهِ فِي حَاجَةٍ حَتَّى أَثْبَتَهَا لَهُ أَثْبَتَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ قَدَمَهُ عَلَى الصِّرَاطِ يَوْمَ تَزِلُّ فِيهِ الأَقْدَامُ

আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় মানুষ তারা যারা মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি উপকারী। আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাজ হলো একজন মুসলমানকে খুশি করা, অথবা তার কোনো কষ্ট দূর করা, অথবা তার ঋণ মাফ করা বা তার ক্ষুধা নিবারণ করা। আমার ভাইয়ের কোনো প্রয়োজনে তার সাথে চলাফেরা করা আমার কাছে মদীনার এই মসজিদে এক মাস নির্জনে থাকার চেয়েও প্রিয়। যে ব্যক্তি তার রাগকে গ্রাস করে, আল্লাহ তার দোষ গোপন করেন। যে ব্যক্তি তার ক্রোধ দমন করে, যদিও সে ইচ্ছা করলে তার ক্রোধ পূরণ করতে পারে, তবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার অন্তরকে নিরাপদ করবেন। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজনে ভাইটির প্রয়োজন পূরণ হওয়া পর্যন্ত চলাফেরা করবে, আল্লাহতাআলা পুলসিরাতের ওপর দিয়ে পার হওয়ার সময় তার পা মজবুত করে দেবেন, যেদিন পা নড়বড়ে হবে। [আল মুজামুল আওসাত : ৬০২৬]

Leave a Comment