সায়িদ ইবনু আমের রা. দুনিয়া বিরাগী এক বীর সাহাবি যিনি দুনিয়ার বিনিময়ে আখিরাত খরিদ করে নিয়েছেন। সবাই তার উপদেশ মেনে চলতেন। তিনি খায়বার বিজয়ের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন। হজরত উমর ফারুক রা.-এর খিলাফতের সময়ের কথা। একদিন তিনি সায়িদ ইবনু আমের রা.-কে বললেন,
“আমি তোমাকে হিমসের গভর্নর নিযুক্ত করতে চাই।”
সায়িদ রা. বললেন, হে উমর, তুমি আমাকে পরীক্ষায় ফেলো না।
উমর রা. বললেন, এটা কেমন কথা? তোমরা আমার ওপর সকল দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা দূরে সরে যাবে? অতঃপর তাকে হিমসের গভর্নর নিযুক্ত করা হলো। হজরত উমর রা. হজরত সায়িদ ইবনু আমের রা.-কে জিজ্ঞেস করলেন,
“আপনার ভাতা নির্ধারণ করে দিব কি?”
তিনি বললেন, “আমিরুল মুমিনিন, আমি তা দিয়ে কি করব? বাইতুল মাল থেকে আমি যে ভাতা পেয়ে থাকি, তাই-তো আমার প্রয়োজনের চেয়ে বেশী হয়ে যায়।”
অতঃপর সায়িদ রা. হিমস চলে গেলেন। হিমস থেকে একটি প্রতিনিধি দল মদিনায় আসল ওমর রা.-এর সাথে দেখা করার জন্য। ওমর রা. তাদেরকে হিমসের গরিব লোকদের একটি তালিকা করে দিতে বললেন যাতে করে তাদের সাহায্য করা যায়। তারা একটি তালিকা করে দিল। হজরত উমর ফারুক রা. তাতে চোখ বুলাচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি সায়িদের নামটি দেখতে পেলেন। তিনি অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, কে এই সায়িদ ইবনু আমর? প্রতিনিধি দল উত্তর দিল, তিনি আমাদের গভর্নর।
হজরত উমর রা. জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের আমিরও কি গরিব?
তারা জানাল, এমনও হয়, দিনের পর দিন তার চুলায় আগুন জ্বলে না।
এ কথা শুনে হজরত উমর ফারুক রা. কান্না ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি তালিকাটি হাতে নিয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন।
ওমর রা. প্রতিনিধি দলটিকে ১ হাজার দিরহাম এর একটি থলে দিয়ে বললেন, এটা তোমার আমির সায়িদ ইবনু আমেরকে দিবে যেন তিনি তার প্রয়োজনে খরচ করতে পারেন।
হিমসের প্রতিনিধি দলটি সায়িদের বাড়িতে থলেটি নিয়ে উপস্থিত হল এবং বলল, “আমিরুল মুমিনিন আপনার কাছে এই থলিটি পাঠিয়েছেন, যেন আপনি আপনার প্রয়োজনে খরচ করতে পারেন।”
সায়িদ ইবনু আমের থলিটি দেখে অবাক কন্ঠে চিৎকার করে বলে উঠলেন, “ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।” এ কথা শুনে সায়িদের স্ত্রী ছুটে আসলেন। তিনি জানতে চাইলেন, কি হয়েছে? আমিরুল মুমিনিন কি ইনতিকাল করেছেন?
সায়িদ বললেন, না।
সায়িদের স্ত্রী জানতে চাইলেন, “তাহলে কি মুসলিম বাহিনী কোথাও পরাজিত হয়েছে?”
সায়িদ বললেন, “না।”
স্ত্রী জানতে চাইলেন, “কি হয়েছে? আপনি ইন্নালিল্লাহ কেন পড়লেন?”
সায়িদ রা. বললেন, “আখিরাত ধ্বংসকারী দুনিয়া আমার ঘরে প্রবেশ করেছে।”
অতঃপর তিনি তার স্ত্রীকে মুদ্রাগুলো দেখিয়ে গরীবদের মাঝে বন্টন করার ইচ্ছা পোষণ করলেন। তার স্ত্রী সন্তুষ্টচিত্তে এই প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। সায়িদ রা. ততক্ষণ পর্যন্ত অন্য কাজে নিজেকে নিয়োজিত করলেন না যতক্ষণ না মুদ্রাগুলো দান করে সম্পূর্ণরূপে শেষ হয়ে যায়।
একবার ওমর ফারুক রা. জনসাধারণের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য শামে গিয়েছিলেন। যখন তিনি হিমসে প্রবেশ করলেন তখন সেখানকার অধিবাসীরা তাদের গভর্নরের প্রতি কয়েকটি অভিযোগ আনল। অভিযোগগুলো একটির চেয়ে অন্যটি গুরুতর ছিল। তিনি হিমসের গভর্নর সায়িদ ইবনু আমেরকে অভিযোগকারীদের সাথে একত্রিত করলেন। তাদেরকে একটি একটি একটি করে অভিযোগ উত্থাপন করতে বললেন। অভিযোগকারীদের প্রথম অভিযোগ ছিল এই যে, আমাদের গভর্নর সকালে দেরি করে ঘর থেকে বের হন।
আমিরুল মুমিনিন উমর রা. তখন বললেন, “হে সায়িদ, এই ব্যাপারে তোমার বক্তব্য কি?”
তখন তিনি বললেন, “হে আমিরুল মুমিনিন, আমার ঘরে কোনো চাকর নেই তাই সকালে আমি আমার স্ত্রীকে কাজে সহায়তা করি। নিজেই রুটি তৈরি করে খাওয়া সম্পন্ন করে রাষ্ট্রীয় কাজের জন্য বের হই।”
তখন উমর রা. বললেন, “তোমাদের দ্বিতীয় অভিযোগটি কি?”
তারা বলল, “তিনি রাতের বেলা আমাদের ডাকে সাড়া দেন না।“
উমর রা. সায়িদকে বললেন, “এর কি উত্তর আছে তোমার কাছে?”
তিনি বললেন, “এই বিষয়টি আমি কারো কাছে প্রকাশ করতে চাইছিলাম না। আমি আমার দিন ও রাতকে দুই ভাগে ভাগ করে নিয়েছি। দিনের ভাগ রাষ্ট্রীয় কাজের জন্য, আর রাতের ভাগ আমার মহান রবের ইবাদতের জন্য রেখেছিলাম।”
উমর রা. লোকদের আবারও জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের তৃতীয় অভিযোগটি কি?”
তারা বলল, “তিনি প্রতি মাসে একবার ঘর থেকে বের হন না।”
সায়িদ রা. এর জবাবে বললেন, “হে আমিরুল মুমিনিন, আমার গায়ের এই জামাটি ছাড়া আমার আর কোন কাপড় নেই। প্রতি মাসে একদিন আমি তা ধুয়ে শুকাতে দিয়ে ঘরে অপেক্ষা করি। দিন শেষে কাপড় শুকালে তা পরে ঘর থেকে বের হই।”
এবার উমর রা. বললেন, “তোমাদের কি আর কোন অভিযোগ আছে?”
তারা বলল, আমাদের আমির মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যান। যার ফলে তিনি মজলিসে উপস্থিত হতে পারেন না।”
উমর রা. বলেন, “হে সায়িদ, এর কারণ কি?”
তিনি বললেন, “আমি যখন মুশরিক ছিলাম তখন খুবাইব রা.-কে কাফিরদের কর্তৃক শূলে চড়িয়ে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছি। আল্লাহর কসম, আমার যখন এই দৃশ্যটি মনে পড়ে আমি নিজেকে সামলে রাখতে পারি না। আমার ভয় হয়, আমি ওই স্থানে উপস্থিত থেকেও আমার ভাইয়ের জন্য কিছু করতে পারিনি, এ জন্য হয়তো আল্লাহ তাআলা আমাকে ক্ষমা করবেন না। এটা ভেবে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই।”
এবার উমর রা. আবেগজড়িত কন্ঠে বলে উঠলেন, “আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ তাআলা সায়িদ এর ব্যপারে আমার ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করেননি।”
উমর রা. মদিনায় এসে সায়িদ রা.-এর কাছে এক হাজার দিরহামের একটি থলি আবারও পাঠালেন। থলিটি দেখে সায়িদ রা.-এর স্ত্রী ভাবলেন, এবার হয়তো তাদের অভাব দূর হবে। কিন্তু সায়িদ রা. বললেন ভিন্ন কথা।
তিনি বললেন, “এগুলো দিয়ে আমরা আরো ভালো কিছু করতে পারি।”
উনার স্ত্রী জানতে চাইলেন, “কী সেটা?”
তখন তিনি বললেন, “আমরা এগুলো আল্লাহ তাআলাকে করজে হাসানা দিব। যেন বিপদের দিনে অর্থাৎ কিয়ামতের দিনে কাজে আসে।”
তার স্ত্রী বললেন, “খুবই উত্তম প্রস্তাব।”
এই বলে তারা সবগুলো দিরহাম ছোট ছোট ভাগ করে এলাকার এতিম, বিধবা ও গরিবদের মাঝে বন্টন করে দিলেন। এই ছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের আদর্শ।
সায়িদ ইবনু আমের আল জুমাহি রা.। তার নিজের প্রয়োজনের উপর অন্যদেরকে প্রাধান্য দিতেন। গভর্নর হয়েও সাধারণ জীবনযাপন করেছেন পরকালে জবাবদিহির ভয়ে। সবার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়ে নিজেরা যাপন করেছেন দরিদ্র জীবন। এ এক সোনালী ইতিহাসের গল্প। যেন রূপকথা। তবে তা রূপকথা নয়। আল্লাহভীরুদের বাস্তব জীবনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকেও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
ইবনে সাদের মতে, হিমসের গভর্নর থাকা অবস্থায় ২০ হিজরি /৬৪২ খ্রি তিনি ইনতিকাল করেন। তবে আবু উবাইদার মতে তার মৃত্যু ২১ হিজরি ।