রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের অন্যতম প্রিয় সাহাবি মুসআব ইবনু উমাইর রা.। তিনি মুসআব আল খায়ের নামেও পরিচিত, ছিলেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এর একজন সাহাবা। কুরাইশ বংশের শাখা বনু আব্দুল দর গোত্রের লোক ছিলেন তিনি। ৬১৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ইসলামের প্রথম দূত ছিলেন। তিনি উহুদের প্রান্তরে ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দে শহীদ হন।
মুসআব বিন উমাইরের জন্মের প্রকৃত সাল জানা যায়নি। অনুমান করা হয় তিনি ৫৯৪ থেকে ৫৯৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬১৪ সালে তরুন বয়সেই ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি কুরাইশ বংশের বনু আব্দুর দার শাখায় জন্মগ্রহণ করেন। মুসআবের পিতা উমাইর ইবনে হাশিম এবং মাতা খুন্নাস বিনতে মালিক। তারা পিতামাতা বিত্তশালী ছিলেন। তরুন বয়সেই তিনি কুরাইশ বংশের বড়দের জমায়েতে অংশগ্রহণের জন্যে অনুমতিপ্রাপ্ত ছিলেন।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তার প্রসঙ্গ উঠলে বলতেন, “মক্কায় মুসআবের চেয়ে সুদর্শন এবং উৎকৃষ্ট পোষাকধারী কেউ ছিল না। বাবা মায়ের পরম আদরে ঐশ্বর্যের মধ্যে লালিত হওয়া সুদর্শন এক যুবক মুসআব। আরবের প্রখ্যাত কুরাইশ বংশে জন্ম। তার মা অনেক সম্পদশালী ছিলেন। তখনকার সময়ে মক্কায় যত রকমের চমৎকার পোশাক ছিল সবই তিনি ব্যবহার করতেন। ব্যবহার করতেন সে সময়কার সবচেয়ে স্টাইলিশ ইয়েমেনি জুতা। মক্কার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট এবং দামি আতর ব্যবহার করতেন তিনি। মুসআব কোনো রাস্তা দিয়ে গেলেই সেই রাস্তা ঘ্রাণে আমোদিত হয়ে যেত। মুসআবের তীক্ষ্ণ মেধা, জাঁকজমকপূর্ণ জীবন, ব্যক্তিত্ব সবকিছুই মক্কাবাসীর মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিল।
মক্কায় ইসলাম প্রচারের প্রথম দিকের ঘটনা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ও তার সাহাবিরা আরকামের বাড়িতে সমবেত হন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম সেখানে সাথীদের সাথে মিলিত হতেন, তাদেরকে কুরআন শিক্ষা দিতেন, নামাজ আদায় করতেন। একদিন মুসআব রা. হাজির হলেন সেই বাড়িতে। তিনি সেখানে বসতে না বসতেই কুরআনের আয়াত নাজিল হল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এর মুখ থেকে সে আয়াত পঠিত হয়ে সকলের হৃদয়ে প্রবেশ করতে লাগল। কুরআনের তীব্র আকর্ষণ মুসআবের মনকে ভীষণভাবে নাড়া দিল। আর সেই বরকতময় সন্ধ্যায় তিনিও আশ্রয় নিলেন ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে। এ ছিল ইসলামের জন্য এক ঐতিহাসিক মূহুর্ত।
তখন থেকে মুসআবের প্রখর মেধা, চমৎকার ব্যবহার এবং একাগ্রতা নিবেদিত হল ইসলামের জন্য। ইসলাম গ্রহণের কিছুদিন পরই মুসআব রা.-এর মা খুন্নাস বিনতে মালিক তা জেনে ফেলেন। তিনি কিছুতেই বিষয়টি মেনে নিতে পারছিলেন না। এ জন্য আদরের সন্তানকে বকাঝকা, মারপিট কিছুই বাদ রাখলেন না। কিন্তু মহান আদর্শে মোহিত মুসআবকে ইসলাম থেকে ফেরানো যায় নি। শেষ পর্যন্ত মা তাকে ঘরে বন্দী করে রাখলেন এবং ইসলাম ত্যাগের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকলেন। একদিন তিনি মায়ের চোখের আড়াল হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। বিপুল ঐশ্বর্য আর বিলাসী জীবন পেছনে ফেলে মুসআব রা. তার জীবন সঁপে দিলেন ইসলামের জন্য। কুরাইশদের সেই আদুরে ও বিলাসী যুবক মুসআব এখন মোটা শতচ্ছিন্নযুক্ত কাপড় পরেন। একদিন খাবার জুটে তো অন্যদিন জুটে না।
একদিন মুসলিমদের একটি দল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের পাশে বসে আছেন। এমন সময় তারা মুসআবকে পাশ দিয়ে যেতে দেখলেন। তাকে দেখেই বৈঠকে উপস্থিত সকলের চোখে পানি চলে আসল। কারণ মুসআবের গায়ে তালি দেওয়া একটি জামা, যাতে দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। তাদের সকলের মনে তখন পূর্বের মুসআবের ছবি ভেসে উঠল। এ দৃশ্য দেখে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেন, “মক্কায় মুসআবের মতো বাবা মায়ের আদরের কোনো যুবক ছিল না। আল্লাহ ও তার রাসুলের ভালোবাসায় সে সবকিছু ত্যাগ করেছে।”
মুসআব রা. ছিলেন ইসলামের ইতিহাসের প্রথম দূত। মদিনায় মুসলিমদের দীনের শিক্ষা ও ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার জন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাকে মদিনায় পাঠান। মুসআবের প্রখর বুদ্ধিমত্তা, উদারতা ও সুন্দর বক্তৃতার প্রভাবে মদিনায় দ্রুতগতিতে ইসলামের প্রসার ঘটতে থাকে। তার দাওয়াতে মদিনার বিখ্যাত ও প্রভাবশালী গোত্রের নেতা উসাইদ ইবনু হুদাইর, সাদ ইবনু মুয়াজ ও সাদ ইবনু উবাদা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
মদিনার সাধারণ মানুষেরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলেন, তাদের গোত্রের নেতারা ইসলামের ছায়াতলে। তাই তারাও দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করতে লাগলেন।
উহুদ যুদ্ধের ময়দান। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইসলামের পতাকা মুসআবের হাতে তুলে দিলেন। এক হাতে পতাকা উঁচু করে ধরে অন্য হাতে তরবারি চালাতে লাগলেন তিনি। হঠাৎ এক কাফির তার দিকে এগিয়ে এসে তরবারির এক আঘাতে তার ডান কাঁধ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। মুসআব বাম হাতে পতাকা তুলে ধরেন। তরবারির আঘাতে তার বাম হাতটিও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এবার তিনি দুই বাহু দিয়ে পতকা ধরেন। অতঃপর বর্শার আঘাতে মাটিতে ঢলে পড়েন তিনি। শাহাদাৎ বরণ করেন মুসআব ইবনু উমায়ের রা.। যুদ্ধের শেষে তার লাশটি পাওয়া যায়। রক্ত ও ধুলোবালিতে একাকার মক্কার সম্ভ্রান্ত যুবক মুসআব। তাকে কাফন দেওয়ার জন্য পাওয়া গেল কেবল এক টুকরো চাদর। তা দিয়ে মাথা ঢাকলে পা ঢাকে না। আর পা ঢাকলে মাথা ঢাকে না।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেন, চাদর দিয়ে তার মাথার দিকে ঢেকে দাও আর পায়ের দিকে ঘাস দিয়ে ঢেকে দাও।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম মুসআবের লাশের দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, “আমি তোমাকে মক্কায় দেখেছি। সেখানে তোমার চেয়ে কোমল চাদর আর সুন্দর জুলফি আর কারো ছিল না। আর আজ তুমি এখানে এই চাদরে ধূলিমলিন অবস্থায় পড়ে আছ। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তিলাওয়াত করতে লাগলেন,
مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ رِجَالٌ صَدَقُوۡا مَا عَاهَدُوا اللّٰهَ عَلَیۡهِ ۚ فَمِنۡهُمۡ مَّنۡ قَضٰی نَحۡبَهٗ وَ مِنۡهُمۡ مَّنۡ یَّنۡتَظِرُ ۫ۖ وَ مَا بَدَّلُوۡا تَبۡدِیۡلًا ﴿ۙ۲۳﴾
মুমিনদের মধ্যে কিছু লোক রয়েছে যারা আল্লাহর সাথে কৃত তাদের প্রতিশ্রুতি সত্যে বাস্তবায়ন করেছে। তাদের কেউ কেউ [যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করে] তার দায়িত্ব পূর্ণ করেছে, আবার কেউ কেউ [শাহাদাত বরণের] প্রতীক্ষায় রয়েছে। তারা (প্রতিশ্রুতিতে) কোন পরিবর্তনই করেনি। [সুরা আহজাবঃ ২৩]
যুদ্ধে ৬৫ জন মুসলমান মারা যায়। খাব্বাব ইবনু আল আরাত বলেছেন:
We migrated in the company of Allah’s Apostle, seeking Allah’s Pleasure. So our reward became due and sure with Allah. Some of us have been dead without enjoying anything of their rewards (here), and one of them was Mus’ab bin ‘Umar who was martyred on the day of the battle of Uhud, and did not leave anything except a Namira (i.e. a sheet in which he was shrouded). If we covered his head with it, his feet became naked, and if we covered his feet with it, his head became naked. So the Prophet said to us, “Cover his head with it and put some Idhkhir (i.e. a kind of grass) over his feet or throw Idhkhir over his feet.” But some amongst us have got the fruits of their labor ripened, and they are collecting them.
মুসআবের দেহের পাশে মুহাম্মদ স দাঁড়িয়ে পাঠ করলেন: মুমিনদের মধ্যে কিছু লোক রয়েছে যারা আল্লাহর সাথে কৃত তাদের প্রতিশ্রুতি সত্যে বাস্তবায়ন করেছে। তাদের কেউ কেউ [যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করে] তার দায়িত্ব পূর্ণ করেছে, আবার কেউ কেউ [শাহাদাত বরণের] প্রতীক্ষায় রয়েছে। তারা (প্রতিশ্রুতিতে) কোন পরিবর্তনই করেনি। [সুরা আহজাবঃ ২৩]
যখন মুসআবের স্ত্রী হাম্মানাহ বিনতু জাহশ তার ভাই এবং মামার মৃত্যু সংবাদ শুনলেন তখন বললেন, “আমরা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছি এবং তারই কাছে ফিরে যাবো”। কিন্তু স্বামী মুসআবের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন।
ইসলামের জন্য বিলাসী জীবন ত্যাগ করা মুসআব ইবনু উমাইর রা. যুবকদের জন্য এক বিরাট অনুপ্রেরণা।