ইমরানের স্ত্রী তার গর্ভে এক সন্তানের প্রত্যাশায় ছিলেন।
যখন ইমরান-পত্নী নিবেদন করল, হে আমার রাব্ব! নিশ্চয়ই আমার গর্ভে যা রয়েছে তা আমি মুক্ত করে আপনার উদ্দেশে উৎসর্গ করলাম, সুতরাং আপনি আমা হতে তা গ্রহণ করুন, নিশ্চয়ই আপনি শ্রবণকারী, মহাজ্ঞানী। অতঃপর সে যখন তা প্রসব করল, বলল, ‘হে আমার রব, নিশ্চয় আমি তা প্রসব করেছি কন্যারূপে’। আর আল্লাহই ভাল জানেন সে যা প্রসব করেছে তা সম্পর্কে। ‘আর পুত্র সন্তান কন্যা সন্তানের মত নয় এবং নিশ্চয় আমি তার নাম রেখেছি মারইয়াম। আর নিশ্চয় আমি তাকে ও তার সন্তানদেরকে বিতাড়িত শয়তান থেকে আপনার আশ্রয় দিচ্ছি’। [সূরা আল-ইমরান ৩:৩৫-৩৬]
তিনি একজন পুত্রসন্তান চেয়েছিলেন যে মসজিদে থাকবে এবং সর্বক্ষণ আল্লাহর ইবাদতে রত থাকবে। কারণ তিনি নিজেও আল্লাহর দাস এবং ইবাদতগুজার নারী ছিলেন। কিন্তু তিনি কন্যাসন্তান প্রসবের পর চিন্তিত হলেন কারণ তার মনে হল সে হয়ত আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারবে না যতটা পারবে পুত্র সন্তান। কিন্তু আল্লাহ জানেন ইমরানের স্ত্রী কাকে জন্ম দিয়েছেন। তিনি জন্ম দিয়েছেন ইসলামের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নারীকে, মরিয়ম (আ.)।
আর স্মরণ কর, যখন ফেরেশতারা বলল, ‘হে মারইয়াম, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাকে মনোনীত করেছেন ও পবিত্র করেছেন এবং নির্বাচিত করেছেন তোমাকে বিশ্বজগতের নারীদের উপর’। [সূরা আল ইমরান ৩:৪২]
মরিয়ম (আ.) এর পিতামাতারা কন্যার জন্মতে হতাশ হলেন না। তারা বললেন, ‘আমরা যেহেতু নিয়ত করেছি তাই সেটাকেই আমরা অনুসরণ করব। কিভাবে আমাদের উদ্দেশ্য পূরণ হবে তা আমরা জানি না। আমরা সেটা আল্লাহর উপরেই ন্যস্ত করছি। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের কন্যাকে রক্ষা করুন।’ আল্লাহ তাদের দোয়া কবুল করে নিলেন, শুধু কবুলই করেননি বরং তাদের দোয়াকেও পছন্দ করেছেন।
দোয়া কবুল হবার ফলাফল হিসেবে আল্লাহ তার দাসীকে সর্বোত্তম উপায়ে বড় করেন। তিনি বড় হন একজন তাকওয়াবান নারী হিসেবে, আল্লাহর একান্ত অনুগত দাসী হিসেবে ঠিক যেমনটা তার পিতামাতা চেয়েছিলেন।
মারইয়াম (আ.) এর মধ্যে উত্তম চরিত্রের সকল গুণাবলি ছিল। তিনি সকলের মর্যাদার পাত্র ছিলেন। তার ভেতর থেকে বুদ্ধিমত্তা ও উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ছাপ প্রজ্জ্বলিত হত।
তার অভিভাবক ছিলেন যাকারিয়া (আ.) যিনি আল্লাহরই এক নবী। এভাবেই আল্লাহ তার পিতামাতার দুয়া কবুল করছিলেন। প্রথমে তাকে উত্তমরূপে বড় করলেন, এরপরে তার অভিভাবক হিসেবে তার নবী যাকারিয়া (আ.) কে নির্বাচন করলেন যেন মারইয়াম (আ.) স্বয়ং আল্লাহর নবীর কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারেন। একজন নবীর চেয়ে উত্তম শিক্ষক আর কে হতে পারে?
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যাকারিয়া (আ.) এর ব্যাপারে বলেন, তিনি কাঠমিস্ত্রি ছিলেন যিনি নিজের রোজকার উপার্জন থেকেই আহার করতেন। তিনি মসজিদের ভেতর একটি মিহরাব নির্মাণ করেন যা অনেকটা ঘরের মত একটি স্থাপনা যেন মারইয়াম (আ.) সেখানে একান্ত নির্জনে গোপনীয়তার সাথে থাকতে পারেন, একজন পুরুষের মতই যেন আল্লাহর ইবাদত করতে পারেন। যাকারিয়া (আ.) অভিভাবক হিসেবে প্রতিদিন তার কাছে যেয়ে তার খোঁজখবর নিতেন।
আর মারইয়াম (আ.) ও ইবাদতে নিমগ্ন রাখতে পছন্দ করতেন। ইবাদত যেন ছিল তার হৃৎস্পন্দন। মসজিদে না থাকতে পারলে তার ইবাদত থেমে যেত না, বরং তিনি পূর্বে চলে যেতেন এবং আল্লাহর স্মরণে নিমজ্জিত হতেন। সেখানে সূর্যোদয় অবলোকন করতেন এবং আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দিতেন। তার খাবার, তার পানীয়, তার অন্তর সবকিছুই ছিল কেবলই আল্লাহর স্মরণ, আল্লাহর জিকির যদিও তখনও তার বয়স তেমন হয়নি।
যাকারিয়া (আ.) যখনই তার কাছে আসতেন তখনই দেখতেন তিনি আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন। একবার তিনি মিহরাবে এসে দেখলেন মারইয়াম (আ.) এমন একটি ফল খাচ্ছেন যা সেই ঋতুতে পাওয়া যেত না অথবা ফলটি সেই স্থানে উৎপাদিত হত না। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘তুমি এই ফলটি কিভাবে পেলে?’ মারইয়াম (আ.) জবাব দিলেন, ‘আল্লাহই আমাকে দিয়েছেন। আপনি কেন অবাক হচ্ছেন? আল্লাহ যেকোন কিছু যাকে ইচ্ছা দিতে পারেন। আল্লাহর তো কোন সীমাবদ্ধতা এবং বাধ্যবাধকতা নেই।’ যদিও যাকারিয়া (আ.) একজন নবী ছিলেন তারপরেও দেখুন মারইয়াম (আ.) এর আল্লাহর প্রতি তাকওয়া ও নৈকট্য কতটা বেশি ছিল। স্বয়ং আল্লাহর নবী তার কাছ থেকে একটি উত্তম বিষয় সম্পর্কে অবগত হলেন।
যাকারিয়া (আ.) অত্যন্ত বৃদ্ধ ছিলেন। তার স্ত্রীও অত্যন্ত বৃদ্ধা ছিলেন কিন্তু
এরপরেও তাদের কোন সন্তান ছিল না। তিনি প্রচন্ডভাবে সন্তানের আকাঙ্ক্ষা করতেন কিন্তু তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বয়সের কারণে তার পক্ষে সন্তান নেয়া সম্ভব হবে না। তিনি বুঝতে পারলেন মারইয়াম (আ.) কি বুঝাতে চেয়েছেন। আল্লাহর কোনই সীমাবদ্ধতা নেই। আল্লাহ চাইলেই তাকে সন্তান দিতে পারেন যেকোন অবস্থায়। তাই তিনি সেখানেই আল্লাহর কাছে দুয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে উত্তম সন্তান দান করুন।’
মহানুভব আল্লাহর পক্ষ থেকে তার প্রতি সুখবর এল তিনি মিহরাবের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই। তার দুয়া তৎক্ষণাৎ আল্লাহ গ্রহণ করলেন এবং জানালেন যে তার শীঘ্রই পুত্র সন্তান হতে যাচ্ছে। তার নাম হবে ইয়াহইয়া (আ.) এবং সে তার মতই আল্লাহর নবী হবে।
আল্লাহ তার প্রিয় বান্দী মারইয়াম (আ.) কে ভালোবাসতেন, ফেরেশতারা তার সাথে কথা বলতেন। তারা তাকে বলেনঃ ‘আল্লাহ আপনাকে সকল নারীর উপরে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।’
মারইয়াম (আ.) নিজেকে হিফাজত করেছিলেন সকল পাপকর্ম থেকে। যেসময় তার মসজিদ থেকে বের হবার কথা তিনি বের হয়ে যান এরপর তিনি পূর্বে যান। সেখানে তিনি আল্লাহর ইবাদতে রত থাকেন। সেখানেই একজন অতীব সুন্দর মানুষের আবির্ভাব ঘটে। তিনি সেই লোকটির দিকে তাকালেও চিনতে পারলেন না। কিন্তু তিনি বুঝলেন যে তার সামনে একজন সুন্দর মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন আর তিনি এই নির্জন প্রান্তরে একদম একাকী। তিনি তাকে দেখলেন এবং তাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বললেনঃ ‘আমি আর-রহমানের কাছে তোমার কাছ থেকে আশ্রয় চাইছি যদি তোমার ভেতর কোন তাকওয়া বা আল্লাহভীতি থেকে থাকে।’ [সূরা মারইয়াম ১৯:১৮] তার এই কথা বলার পরেই জিবরাইল (আ.) তার প্রকৃত রূপে ফিরে যান। তিনি তাকে ঈসা (আ.) এর সুসংবাদ দিলেন। [সূরা মারইয়াম ১৯:১৯] তাকে ফুঁ দেবার মাধ্যমেই তিনি গর্ভধারণ করে ফেলেন। তার গর্ভে ঈসা (আ.) এসে পড়ে। এখানেই ব্যাপারটির সমাপ্তি। মারইয়াম (আ.) এটাকে বদলাতেও পারবেন না, দু’আও করতে পারবেন না এর বিপক্ষে।
তিনি আশ্চর্য হয়ে বললেনঃ ‘কিন্তু কিভাবে? কিভাবে আমার পেটে সন্তান আসতে পারে যখন কোন পুরুষ আমাকে স্পর্শ করেনি এবং ব্যভিচারিণীও কখনও ছিলাম না?’ [সূরা মারইয়াম ১৯:২০] জিবরাইল (আ.) বলেন, ‘আপনার প্রতিপালকের ইচ্ছায়। আপনার রব বলেছেনঃ এটা আল্লাহর জন্য সহজ। এবং আমি তাকে মানুষের জন্য একট্টি নিদর্শন ও আমার পক্ষ থেকে অনুগ্রহ স্বরূপ করতে চাই।’ [সূরা মারইয়াম ১৯:২১]
আল্লাহ বলেন, ’যখন তিনি প্রচন্ড প্রসববেদনায় কাতর হলেন তখন তিনি একটি খেজুর গাছের নিকটে গেলেন।’ তিনি কাতর হয়ে বলেন, ‘যদি আমি মারা যেতাম! যদি আমাকে ভুলে যাওয়া হত!’ জিবরাইল (আ.) বললেন, ‘আপনি কাতর হবেন না! মহান আল্লাহ একটি নদী চালনা করেছেন। আপনি এগিয়ে যান এবং খেজুর গাছটি ঝাড়া দিন। সেখান থেকে তাজা পরিপক্ক খেজুর ঝরে পড়বে।’ [সূরা মারইয়াম ১৯:২২-২৫]
ঈসা (আ.) কে জন্মদানের পর তিনি ক্লান্ত এবং দুর্বল হয়ে যান। জিবরাইল (আ.) বলেন, ‘আপনি ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন যে যদি আপনার অস্তিত্বই না থাকত। কিন্তু আল্লাহ আপনাকে সকল নারী ও পুরুষের কাছে সম্মানিত করবেন।’ মারইয়াম (আ.) শুধু নারী নন বরং নারী-পুরুষ উভয়েরই আদর্শ। সকলের মধ্যে হতে তার বিশেষ মর্যাদা রয়েছে।
তিনি যখন তার লোকদের কাছে ফিরে গেলেন তারা বললঃ ‘হে মরিয়ম! তুমি একটি অঘটন ঘটিয়ে বসেছ। হে হারুণ ভাগিনী! তোমার পিতা অসৎ ব্যক্তি ছিলেন না আর মাতাও ছিলেন না ব্যভিচারিনী।’ [সূরা মারইয়াম ১৯:২৭-২৮] সেখানে তোমার ক্ষেত্রে এমনটা ঘটল কিভাবে?
তিনি তার কোলের শিশুর দিকে ইঙ্গিত করলে তারা বলল,
তার কোল থেকেই ঈসা (আ.) বলে উঠলঃ “আমি আল্লাহর বান্দা। আল্লাহ আমার উপর তার কিতাব নাযিল করেছেন এবং আমাকে রাসূল বানিয়েছেন।’ এখানে ঈসা (আ.) তার মায়ের পক্ষ হতে জবাব দিচ্ছিলেন।
মারইয়াম (আ.) এর মত পূণ্যবতী নারীদের নিয়ে অশেষ কথা বলা যায়। কিন্তু এখানেই থামতে হচ্ছে। আবার হাজির হওয়া যাবে আরেক মহীয়সীর গল্প নিয়ে, ইনশা আল্লাহ।