বিকেলে বাবা সকালে মা সময় কাটাবেন শিশুর সঙ্গে

বাংলাদেশি মার্কিন নাগরিক শরীফ ইমরানের সঙ্গে জাপান থেকে আসা তাঁর দুই শিশুসন্তান আপাতত ঢাকা মহানগর পুলিশের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে থাকবে। সেখানে আরও ভালো পরিবেশে ১০ ও ১১ বছর বয়সী ওই দুই শিশুকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত রাখতে আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ সোমবার এ আদেশ দেন। আদালত বলেছেন, তাদের মা নাকানো এরিকো (জাপানি নাগরিক) সকাল আটটা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত শিশুদের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন । বিকেল তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত শিশুদের বাবা (বাংলাদেশি মার্কিন নাগরিক) শরীফ ইমরান দেখা করতে পারবেন।

ওই দুই শিশুকন্যাকে ফিরে পেতে হাইকোর্টে শিশুদের হাজির করার নির্দেশনা চেয়ে ঢাকায় এসে ১৯ আগস্ট রিট আবেদন করেন জাপানি নাগরিক নাকানো এরিকো, যিনি পেশায় চিকিৎসক। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে সেদিন হাইকোর্টের একই বেঞ্চ দুই শিশুকে ৩১ আগস্ট আদালতে হাজির করতে তাদের বাবা শরীফ ইমরান ও ফুফুকে নির্দেশ দেন। শিশুদের আদালতে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে গুলশান ও আদাবর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বলা হয়েছিল । শিশুদের নিয়ে তাদের বাবা যাতে দেশত্যাগ করতে না পারেন, সে জন্য ৩০ দিনের নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হয়েছিল । তবে এর মধ্যে গতকাল রোববার রাতে বাবার কাছ থেকে ওই দুই শিশুকে নিয়ে আসে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি )। এ অবস্থায় আজ সোমবার বিকেলে শিশুদের ফিরে পেতে আদালতে আবেদন করেন তাদের বাবা । শুনানি নিয়ে বিকেলে আদেশ দেওয়া হয় । আদালতে শিশুদের বাবার আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ এবং মায়ের পক্ষে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার।

শুনানিতে যা হলো :

ওই দুই শিশু বাংলাদেশি নাগরিক বলে আদালতকে জানান আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ। তিনি বলেন, ‘শিশুদের বাবা বাংলাদেশি ও মা জাপানি। দেশে আসার পর পারিবারিক আদালতে মামলা করে বাবা অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ পান। আদালতের আদেশে শিশুরা বাবার কাছে ছিল। তবে এরপর সিআইডি নিয়ে গেছে, বলেছে, ৩১ আগস্ট তাদের আদালতে হাজির করা হবে না বলে আশঙ্কা রয়েছে। সেখানে শিশুরা চিৎকার করেছে, যেতে চায় না বলেছে। ট্রমার মধ্যে আছে তারা। বাচ্চাদের বক্তব্য শুনতে হবে। আশঙ্কা আছে মা নিয়ে যেতে পারে, তাই মায়ের পাসপোর্ট আদালতে জমা রাখার নির্দেশনা চাচ্ছি। শিশুদের কোর্টে নিয়ে আসেন। ওরা না খেয়ে আছে। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে একধরনের আটক রাখা হয়েছে।’

শুনানিতে মায়ের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ‘বাবা ও মা একজন আরেকজনের মুখ দেখতে চান না। এ সমস্যা এক দিনে হয়নি। মাকে না জানিয়ে জোর করে বাবার শিশুদের নিয়ে আসা থেকেই এর সূত্রপাত। আগে থেকে পারিবারিক সমস্যাও রয়েছে। সিআইডির কাছে শিশুরা। আমরা (মা) গেছি, উনারা (বাবা) এসেছেন, এতে ক্ষতি কী হলো?’
বাবার হেফাজতে শিশুদের দেওয়ার আরজি জানিয়ে আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, ‘শিশুদের সঙ্গে মায়ের দেখা করা নিশ্চিত করা হবে। আইনজীবী বা সমাজকল্যাণ কর্মকর্তার তত্ত্বাবধান বা উপস্থিতিতে এই সাক্ষাৎ হতে পারে। অঙ্গীকার করব, যখনই কোর্টে শিশুদের নিয়ে আসতে বলবেন, নিয়ে আসা হবে।’ শিশুদের মায়ের পাসপোর্ট আদালতে দাখিল করার আরজি জানান তিনি।

পরে আইনজীবী শিশির মনির বলেন, শিশুদের ৩১ আগস্ট আদালতে হাজির করার কথা ছিল। তৃতীয় একজন ব্যক্তির যেখানে মা–বাবার পরিদর্শনের সমান সুযোগ থাকবে। এ সময় পর্যন্ত তারা জাপানের রাষ্ট্রদূতের কাছে থাকবে।

তবে এর বিরোধিতা করে ফাওজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, ‘একবার জাপান দূতাবাসে ঢুকে গেলে আমরা যেতে পারব না। ডিপ্লোমেটিক মিশনে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে দেয়াল হয়ে যাচ্ছে। বাবা শিশুদের আইনগত অভিভাবক। পাসপোর্ট ও বাবার সূত্রে শিশুরা বাংলাদেশি নাগরিক। ডিপ্লোমেটিক মিশনে হস্তক্ষেপ করতে পারব না। ধর্মীয় অনুশাসন মানা নিয়ে মা–বাবার মধ্যে বিভেদের অন্যতম কারণ।’

আদালত বলেন, সিআইডি হঠাৎ কেন হস্তক্ষেপ করেছে? জবাবে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার বলেন, শিশুদের বাবা ঠিকানা দুবার পরিবর্তন করেছেন। অন্য সূত্রে তথ্য চলে আসায় ও আদালতের আদেশ থাকায় শিশুদের উদ্ধার করে সিআইডি।আদালত বলেন, ‘প্রশ্ন হচ্ছে, আপাতত হেফাজত বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নিতে পারি? কার হেফাজতে থাকবে?’
তখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার বলেন, জাপান বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুরাষ্ট্র। জাপান, আমেরিকা বা রাশিয়া হোক, দূতাবাসে গেলে কূটনৈতিক জোন হয়ে যায়। এটি সার্বভৌম এলাকা হিসেবে গণ্য হয়। অন্তত নিজ রাষ্ট্রের এখতিয়ারের মধ্যে রাখা যেতে পারে।

ভালো সমাধানের প্রত্যাশা আদালতের :

আদেশের আগে দুই পক্ষের আইনজীবীর উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘বিষয়টি ৩১ আগস্টের মধ্যে সুরাহা করার চেষ্টা করেন। জেদ মেটানোর জন্য বহু কিছু করতে পারেন। ভুল–বোঝাবুঝি বা যা–ই হোক, এটি নিয়ে বহুদূর যেতে পারেন। অনুরোধ করব, ৩১ আগস্টের মধ্যে দুই পক্ষ বসে কোনো সমাধান করতে পারেন কি না দেখেন, পারলে স্বাগত জানাব। যদি মনে করেন, তৃতীয় কারও ভূমিকা রাখলে ভালো হয়, জানাবেন।

চেষ্টা করব, একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোক দিয়ে মধ্যস্থতা করার যদি এ রকম পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তবে এর সবচেয়ে বড় ভিকটিম হচ্ছে শিশুগুলো। তবে এর শাস্তিপূর্ণ সমাধান হোক আমরা চাই। সিআইডিকেও ও আপনাদের বলব যাতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টির জন্য দুই পক্ষ সহযোগিতা করে। আশা করব, ৩১ আগস্ট একটি ভালো সমাধান দেবেন। নিজেরাই সমাধান দেবেন প্রত্যাশা করি।’

Leave a Comment