বছরে ৩ হাজার কোটির ভারী মেশিনারিজের চাহিদা, আমদানিনির্ভর সরকার

গত এক দশকে দেশে মেগা প্রকল্পের সংখ্যা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। বাস্তবায়ন হচ্ছে মেট্রোরেলের মতো একাধিক মেগা প্রকল্প। ফলে ব্যাপকহারে বাড়ছে হেভি বা ভারী মেশিনারিজের ব্যবহারও। বড় হচ্ছে এসব মেশিনারিজের বাজার। অনেক মানুষ যুক্ত হওয়ায় বাড়ছে কর্মসংস্থান। বছরে এসব মেশিনারিজের চাহিদা প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার। তবু আমদানিনির্ভর থাকতে চায় সরকার। শুক্রবার (২২ অক্টোবর) সরেজমিনে দেখা যায়, নগরীর আগারগাঁও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পাশের সড়কে বড় বড় ক্রেন দিয়ে সড়ক পরিষ্কার করা হচ্ছে। শুরু থেকেই হেভি মেশিনারিজের মাধ্যমে এগিয়ে গেছে মেট্রোরেলের কাজ। শেষ সময়ও ব্যবহার করা হচ্ছে হেভি মেশিনারিজ।

এ বিষয়ে মেট্রোরেলের ট্রাফিক সুপারভাইজার পলাশ চন্দ্র রায় রংপুর ডেইলীকে বলেন, ক্রেনের সাহায্যে সড়ক পরিষ্কার করা হচ্ছে। কারণ মানুষের পক্ষে তিন টন ওজনের রোড ব্যারিয়ার সরানো সম্ভব নয়। মেট্রোরেল ভারী মেশিনারিজের সাহায্যেই নির্মিত। বলা যায় প্রতিটি কাজেই ভারী মেশিনারিজ ব্যবহার করা সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মেট্রোরেল নির্মাণ করতে গিয়ে ১০ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১৬০ টনের ক্রেন ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া শুরু থেকে চেক বোরিং, টেস্ট পাইল, মূল পাইল, পাইল ক্যাপ, আই গার্ডার, প্রিকাস্ট সেগমেন্ট কাস্টিং, পিয়ার হেড, ভায়াডাক্ট, ভায়াডাক্টের ওপর প্যারাপেট ওয়াল স্থাপন, লং স্প্যান ক্যান্টিলিভার নির্মাণ- সবকিছুই ভারী মেশিনারিজের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে।

দেশে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল-লাইন ৬, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রজেক্ট, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেল সেতু নির্মাণ, ডিপিডিসি এলাকায় বিদ্যুৎ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ এবং দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার ও রামু থেকে মিয়ানমারের নিকটবর্তী ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে।

বাস্তবায়ন হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প ও পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প। সবগুলো প্রকল্পই ভারী মেশিনারিজনির্ভর। মেরামত থেকে শুরু করে এসব ইক্যুইপমেন্ট অপারেট করেন দেশের প্রকৌশলীরাই। এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে দেশে। এসব ভারী মেশিনারিজ মেরামত ও অপারেট দক্ষতা অর্জন করে অনেকে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন উচ্চ বেতনের আশায়। বিশেষ করে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, কোরিয়া ও জাপানে বাংলাদেশি প্রকৌশলীরা সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। এসব মেশিনারিজ দেশে তৈরি হয় না। সবই আমদানি করতে হয়। দেশের বিভিন্ন ব্যবসায়ী এগুলো আমদানি করেন। অনেকে পুরোনো ভারী মেশিনারিজ ভাড়া দেন। অনেকে আবার বিদেশি কোম্পানির ডিলার হচ্ছেন। ফলে বড় হচ্ছে বাজার।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাধারণ কোনো প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ১০ শতাংশ খরচ হয় ভারী মেশিনারিজ কিনতে ও ভাড়া নিতে। বছরে দেশে তিন হাজার কোটি টাকার হেভি মেশিনারিজের চাহিদা রয়েছে। যার ৮০ শতাংশ আসে চীন থেকে, বাকি ১৫ শতাংশ আনে ভারত এবং ৫ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ থেকে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নতুন মেশিনারিজের দাম বেশি হওয়ায় পুরোনো মেশিনারিজের চাহিদা বেশি। দেশে প্রায় পাঁচ হাজার ভারী মেশিনারিজ প্রতি বছর আমদানি করা হয়। বেড়েছে আমদানি ব্যয়ও। চায়না জুহো কন্সট্রাকশন মেশিনারি গ্রুপ (এক্সসিএমজি) নির্মাণ মেশিনারি কোম্পানি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম। আর্থমুভিং সল্যুশন লিমিটেড বাংলাদেশের ডিস্ট্রিবিউটর।

আর্থমুভিং সল্যুশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. মজিবুল হক রংপুর ডেইলীকে বলেন, সরকার দেশের উন্নয়নে নানা ধরনের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। মেগা প্রকল্প ভারী মেশিনারি ছাড়া বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। ফলে বছরে তিন হাজার কোটি টাকার ভারী মেশিনারি আমদানি করা হয়। এখন গ্রামের উন্নয়ন প্রকল্পেও আমরা ভারী মেশিনারিজ দিচ্ছি। এসব ভারী যন্ত্রপাতির মাধ্যমে একদিকে যেমন দেশের উন্নয়ন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে অন্যদিকে কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হচ্ছে।

দেশের মেগা প্রকল্পে বর্তমানে এক্সকেভেটর, লোডার্স, হুইল ডোজার, সয়েল কমপ্যাক্টার্স, হরিজোনটাল ডাইরেক্টশনাল ড্রিলিং, রোটারি ড্রিলিং রিগ, কংক্রিট মিক্সিং প্ল্যান্ট, ট্রাক মাউন্টেড কংক্রিট পাম্প, ট্রেইলার পাম্প, হুইল লোডার, ব্যাকহো লোডার, স্কিড লোডার, ডোজার, ফ্রক লিফ্ট, অ্যাসফল্ট মিক্সিং প্ল্যান্ট, মটর গার্ডার, পাভার, টাওয়ার ক্রেন, কারহুইলার ক্রেন, ট্র্যাক ক্রেন ব্যবহার হচ্ছে। এছাড়া হুইল এক্সকেভেটর, ব্রিজ ইনস্পেকশন ট্র্যাক, গার্বেজ ট্র্যাক, মিনিং ট্র্যাক, টায়ার রোলার, সলিড কমপ্যাক্টার, থান্ডে পাইপ লেয়ার্স অ্যান্ড ব্যাকহুক লোডার্সসহ নানা ধরনের ভারী মেশিনারিজ সরকারের নানা প্রকল্পে ব্যবহার করা হচ্ছে।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, বাংলাদেশ রেলওয়ে, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিদ্যুৎ বিভাগ, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ), স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), স্থানীয়-বিদেশি ফার্ম, সরকারি-বেসরকারি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ভারী মেশিনারিজ ব্যবহারে শীর্ষে। দেশে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন, চায়না মেজর ব্রিজ, চায়না এক্সএমসি-সিএমসি কনসোর্টিয়াম, রাশিয়ার রোসাটম স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি করপোরেশন, জাপানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টেক্কেন, নিপ্পন কোই ও ভারতের ইরকন ইন্টারন্যাশনাল ভারী মেশিনারি বেশি ব্যবহার করে।

বাংলাদেশের আবদুল মোনেম লিমিটেডসহ (এএমএল) কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও ভারী মেশিনারি ব্যবহারে পারদর্শিতা দেখিয়েছে। এসব কোম্পানি সরাসরি বিদেশ থেকে মেশিনারিজ আমদানি করে। অনেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এসব ভারী মেশিনারিজ আছে। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পানিপথে বাংলাদেশে নিয়ে আসে এসব কোম্পানি। এছাড়া অনেক কোম্পানি আর্থমুভিং সল্যুশন লিমিটেডের মতো দেশীয় প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কেনেন ও ভাড়া নেন। ভারী মেশিনারি শিল্পের ব্যাপক চাহিদা থাকার পরও দেশে এ ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নেই সরকারের। কারণ ভারী মেশিনারি নির্দিষ্ট মেগা প্রকল্পে ব্যবহার করার পরে বিদেশে চলে যায়। ফলে আমদানি করেই প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহী সরকার।

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান রংপুর ডেইলীকে বলেন, প্রাইভেট সেক্টরগুলো ভারী মেশিনারি আমদানি করছে। ফলে আমরা মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। ভারী মেশিনারিজ দেশে তৈরি করে লাভ হবে না। যেমন- আমরা পদ্মা সেতুতে একটা জার্মানি হ্যামার ব্যবহার করেছি। এখন এ হ্যামারের প্রয়োজন নেই বা ব্যবহারের কোনো জায়গা নেই। দেশে পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্প কবে হবে জানা নেই। রূপপুর প্রকল্পে অনেক ভারী মেশনারিজ ব্যবহার করা হচ্ছে, যা বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে। রূপপুরের মতো বড় প্রকল্প দেশে কবে হবে জানি না। সুতরাং সিঙ্গেল প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য হেভি মেশিনারিজ কেনা বা ভাড়া নেওয়া উত্তম হবে। ভারী মেশিনারিজ তৈরির জন্য অনেক প্রযুক্তি ও মার্কেটের দরকার হয়, যেটা আমাদের নেই। ফলে দেশে উৎপাদনের চেয়ে আমদানি করাই মঙ্গল হবে বলে আমি মনে করি।’

Leave a Comment