প্রায় ১ কোটি টাকা দিয়েও স্বামীকে পাইনি

২০১৯ সালের ১৯ জুন রাজধানীর মিরপুরের মাজার রোডের প্রথম কলোনির ২১-এ/ই, লালকুঠির বাসা থেকে বের হওয়ার পর ভাষানটেক পুনর্বাসন প্রকল্পের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেনকে গোয়েন্দা সংস্থার পরিচয় দিয়ে একদল ব্যক্তি ধরে নিয়ে যায়। পরদিন ছোট ভাই খায়রুল শাহআলী থানায় সাধারণ ডায়েরি করলেও এখনো পুলিশ কোনো সন্ধান দিতে পারেনি।

ইসমাইলের মেয়ে আনিসা ইসলাম ইনসা বলেন ‘বাবা বেঁচে আছে কিনা, কোথায় আছে সেটা আমরা জানতে চাই। বাবার অপেক্ষায়। বাবাকে ফিরিয়ে দেন, বাবাকে ফিরিয়ে দেন।’

কুষ্টিয়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন সেতুর স্ত্রী জিনিয়া বলেন, ‘স্বামীর সন্ধানে সবার কাছে গিয়েছি। মন্ত্রী, এমপি, আওয়ামী লীগের নেতা থেকে শুরু করে পুলিশ ও র‌্যাবের দপ্তরে ধরনা দিতে দিতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। বিভিন্ন ব্যক্তি স্বামীকে উদ্ধার করার জন্য টাকা চেয়েছে। এ পর্যন্ত বিভিন্নজনকে প্রায় ১ কোটি টাকা দিয়েছি। তারপরও স্বামীকে পাইনি। এটা তো আমাদের সরকার। আমরা কেন গুম হব?’

মঙ্গলবার (৩০ আগস্ট) আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসের আগে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্য এসব মন্তব্য করে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

সারা পৃথিবীতে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক ভাবে দিবসটি পালিত হবে।

২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর গুম হওয়া সব ব্যক্তির জন্য আন্তর্জাতিক সনদ হিসেবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর প্রোটেকশন অব অল পারসন্স অ্যাগেইনস্ট এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়্যারেন্স’ সম্মেলনে আন্তর্জাতিক সনদটি কার্যকর হয়, তাতে ৩০ আগস্টকে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস ঘোষণা করা হয়। এর পরের বছর থেকে দিবসটিতে গুম হওয়া মানুষগুলোকে স্মরণ এবং সেই সঙ্গে তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানোর জন্য দিবসটি পালন করা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী।

এদিকে আন্তর্জাতিক গুম দিবস উপলক্ষে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রে গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদ স্বাক্ষর এবং এ সংক্রান্ত অভিযোগ তদন্তে নিরপেক্ষ কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে।

আসকের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের ২৯ আগস্ট পর্যন্ত ২৮ জন গুমের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে ১২ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং ৫ জন ফেরত এসেছেন। এখনো ১১ জন গুম রয়েছেন। এর আগে ২০০৭ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ৬০৪ জন গুমের শিকার হয়েছেন বলে ভুক্তভোগী পরিবার ও স্বজনরা অভিযোগ তুলেছেন।

আসক জানায়, এদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে, ৮৯ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং ৫৭ জন ফেরত এসেছেন। এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবার, স্বজন বা প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেছেন যে–বিশেষ বাহিনী-র‌্যাব, ডিবি পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয়ে সাদা পোশাকে ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের তুলে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রায়ই সংশ্লিষ্ট বাহিনী তাদের গ্রেপ্তার বা আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে।

২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি রামপুরা থানা ছাত্রলীগের সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন তপুকে ভাটারা থানাধীন বাসা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে একদল ব্যক্তি ধরে নিয়ে যায়। প্রায় সাড়ে ছয় বছর পরও তপু ফিরে আসেনি।

তপুর মা বলেন, ‘আমি তো আজও বিশ্বাস করতে পারি না যে আমাদের সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আমার ছেলে গুম হবে। আমি কার কাছে বিচার দেব? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার তপুকে ফিরিয়ে দিন। তপু কোনো দোষ করলে তার বিচার করুন। তাই বলে মায়ের আঁচল আপনি খালি করে রাখবেন না।’

বিএনপির ঢাকা মহানগরের নেতা চৌধুরী আলমের মেয়ে মাহফুজা আক্তার বলেন, ‘আমার বাবাকে যখন ধরে নিয়ে যাওয়া হয় আমি তখন ছোট ছিলাম। এখন বড় হয়েছি। আমার বাবাকে আমি প্রত্যেক দিন স্বপ্নে দেখি। আমরা আর কত কাঁদব! আমার বাবাকে ১২ বছর আগে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তোলা হয়েছে। যারা ধরে নিয়ে গেছে তারা বলেছে যে, তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক। আমরা তাদের কাছে ধরনা দিচ্ছি যে, আমার বাবাকে ফিরিয়ে দাও। কিন্তু আমার বাবার তারা সন্ধান দিচ্ছে না।’

২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর পল্লবী এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তৎকালীন সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সভাপতি সেলিম রেজা পিন্টুকে (৩১) ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে তাকে আর পাওয়া যায়নি।

সোমবার পিন্টুর বোন রেহেনা বেগম বলেন, ‘ছেলের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আমাদের বাবা দুই বছর আগে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। আমরা আমাদের ভাইকে ফিরে পেতে এখনো অপেক্ষা করছি। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করছি যে আমার ভাইকে ফিরিয়ে দিন।’

২০১৩ সালের ৪ জানুয়ারি র‌্যাবের পোশাক পরিহিত একটি টিম তুলে নিয়ে যায় বিএনপি নেতা সাদেকুলকে। সাদেকুলকে খুঁজে বের করতে র‌্যাব তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছিল। কিন্তু সাদেকুলকে ফেরত পায়নি তার পরিবার।

আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ দুপুর ১২টায় নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করবে দলটি।

গুম হওয়া নেতাকর্মীদের স্বজনদের সংগঠন মায়ের ডাকের আহ্বায়ক সানজিদা ইসলাম তুলি সোমবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশের বাইরে আমেরিকায় জাতিসংঘের সদর দপ্তর, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া পার্লামেন্টের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করবেন প্রবাসী বিএনপি নেতারা। এর মধ্যে আমেরিকায় যে কর্মসূচি পালন করা হবে সে কর্মসূচিতে অংশ নেবেন গুম হওয়াদের স্বজনদের একটি অংশ। এ ছাড়া ঢাকায় জাতীয় জাদুঘরের সামনে সকাল ১০টায় মায়ের ডাক সংগঠনের উদ্যোগে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হবে।’

Leave a Comment