প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদের মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।

সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর যিনি বিশ্ব জাহানের স্রষ্টা এবং মানবজাতির রব।

সুরা তাকাসুর কুরআনের অনন্য এক সুরা। কুরআনের ১০২ নাম্বার এই সুরাটির আয়াত সংখ্যা আট। এই সুরার প্রথম শব্দ আত তাকাসুর থেকে এই সুরার নামকরণ করা হয়েছে। ইমাম আবু হাইয়ান ও শাওকানি রাহ. বলেন, সকল তাফসিরকার একে মাক্কি সুরা হিসেবে গণ্য করেছেন। এ ব্যাপারে ইমাম সুয়ুতির বক্তব্য হচ্ছে, মাক্কি সুরা হিসেবেই এটি অধিক খ্যাতি অর্জন করেছে।

এই সুরায় মানুষকে দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা ও বৈষয়িক স্বার্থ পূজার অশুভ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। এই ভালোবাসা ও স্বার্থ পূজার কারণে মানুষ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বেশী বেশী ধন-সম্পদ আহরণ, পার্থিব লাভ, স্বার্থ উদ্ধার, ভোগ, প্রতিপত্তি, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভ এবং তার মধ্যে প্রতিযোগিতামূলকভাবে একজন আর একজনকে টপকে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। আর এসব অর্জন করার ব্যাপারে অহংকারে যেতে থাকে। এই একটি মাত্র চিন্তা তাদেরকে এমনভাবে মশগুল করে রেখেছে যার ফলে এর চেয়ে উন্নততর কোন জিনিসের প্রতি নজর দেবার মানসিকতাই তাদের নেই। এর অশুভ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দেবার পর লোকদেরকে বলা হয়েছে, এই যেসব নিয়ামত তোমরা নিশ্চিন্তে সংগ্রহ করতে ব্যস্ত, এগুলো শুধুমাত্র নিয়ামত নয় বরং এগুলো তোমাদের জন্য পরীক্ষার বস্তুও। এগুলোর মধ্য থেকে প্রত্যেকটি নিয়ামত সম্পর্কে তোমাদের আখেরাতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

 

আয়াত ১

اَلۡهٰکُمُ التَّکَاثُرُ ۙ﴿۱﴾

অধিক (পার্থিব) সুখ সম্ভোগ লাভের মোহ তোমাদেরকে (অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে) ভুলিয়ে রেখেছে।

এই আয়াতে সূরাটির কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু উঠে এসেছে। অর্থাৎ, বস্তুগত সম্পদ এবং পার্থিব লাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষার কারণে আখিরাতের পথ থেকে সরে যাওয়া। সম্পদের অন্বেষণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতার উৎস হয়ে ওঠে। সম্পদ মানুষকে আল্লাহর স্মরণ এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির সাধনা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। বর্তমান সমাজের সাধারণ চিত্র হচ্ছে, পরিবারের কর্তা সারাদিন ঘরের বাইরে অবস্থান করেন। বাইরে কাটিয়ে দেন কর্মক্ষেত্র থেকে সম্পদ আহরণের জন্য, আর কর্ত্রী ঘরে অবস্থান করে সেই সম্পদকে ব্যয় করবেন এবং তিনিও তা জমা করবেন ঘরে সঞ্চিত বিভিন্ন ভোগ্য বস্তুর আকারে – নতুন এটা, নতুন ওটা, বছর বছর ঘরে নতুন পর্দা, নতুন সোফা ইত্যাদি। তারা সম্পদ আহরণে কখনও পরিতৃপ্ত হতে পারেন না। উভয়পক্ষেই চলে এই সঞ্চয়ের প্রক্রিয়া, পুরুষ ঘরের বাইরে থেকে সম্পদাহরণে ব্যস্ত, আর নারী ঘরের ভেতর বিভিন্ন ভোগ্য পণ্যের আকারে সেই সম্পদকে জমা করতে সক্রিয়। কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সুরা আনফালের ২৮ নং আয়াতে আমাদেরকে সাবধান করে বলেছেন: “আর জেনে রাখ, তোমাদের সম্পদ এবং সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য পরীক্ষা বৈ কিছু নয়, আর নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট রয়েছে মহা পুরস্কার (যারা এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে তাদের জন্য)।”

 

আয়াত ২

حَتّٰی زُرۡتُمُ الۡمَقَابِرَ ؕ﴿۲﴾

যতক্ষণ না তোমরা কবরের সাক্ষাৎ করবে।

অর্থাৎ বিভিন্নভাবে সম্পদ আহরণের পেছনে সাধনা তোমাদেরকে ব্যস্ত রাখে একেবারে মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত। সূরা আনআমের ৪৪ নং আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন: “অতএব যখন তারা সতর্কবাণী ভুলে গেল, যার দ্বারা তাদেরকে স্মরণ করানো হয়েছিল, আমরা তাদের জন্য প্রতিটি (উপভোগ্য) বস্তুর দরজা খুলে দিলাম, যতক্ষণ না তারা এই ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে পড়ল এবং হঠাৎ এর মাঝে আমি তাদেরকে ছিনিয়ে নিলাম (মৃত্যু ঘটিয়ে দিয়ে শাস্তিতে নিক্ষেপ করলাম)…”

এই আয়াতটি সমস্ত মানুষকে তার চূড়ান্ত পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। মৃত্যুই আমাদের চূড়ান্ত পরিণতি। মানুষ তার পার্থিব সাধনা নির্বিশেষে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর মুখোমুখি হবে এবং তাদেরকে তাদের কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। যে ব্যক্তি সর্বদা মৃত্যুর কথা চিন্তা করবে, সে তার পুরো জীবনকে সম্পদ আহরণের পেছনে উৎসর্গ করবে না। সে দুনিয়ার বাস্তবতা নিয়ে ভাববে।

 

আয়াত ৩

کَلَّا سَوۡفَ تَعۡلَمُوۡنَ ۙ﴿۳﴾

(তোমরা যে ভুল ধারণায় ডুবে আছো তা) মোটেই ঠিক নয়, শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে।

 

অর্থাৎ তোমরা ভুল ধারণার শিকার হয়েছ। বৈষয়িক সম্পদের এ প্রাচুর্য এবং এর মধ্যে পরস্পর থেকে অগ্রবর্তী হয়ে যাওয়াকেই তোমরা উন্নতি ও সাফল্য মনে করে নিয়েছো। অথচ এটা মোটেই উন্নতি ও সাফল্য নয়। অবশ্যই অতি শীঘ্রই তোমরা এর অশুভ পরিণতি জানতে পারবে।

 

আয়াত ৪

ثُمَّ کَلَّا سَوۡفَ تَعۡلَمُوۡنَ ؕ﴿۴﴾

আবার বলি, মোটেই ঠিক নয়, শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে।

এই আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা একই কথা পুনরাবৃত্তি করার মাধ্যমে এ ব্যাপারটিকে জোর দিচ্ছেন যে জীবনের বাস্তবতা বুঝতে পারার এই মুহূর্তটি অতি অতি নিকটে! যেমন আমরাও কোন কিছু জোর দিয়ে বলতে চাইলে দুবার বলে থাকি। কুরআনে কোন কোন আয়াত এভাবে পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে বিশেষ জোর দেয়ার জন্য। কখনও কোন অতীব গুরুত্ববহ বক্তব্য বহনকারী আয়াতকে বিভিন্ন সূরায় পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে, কখনও একই সূরার শুরুতে এবং শেষে আনা হয়েছে, কখনও পর পর আনা হয়েছে। সুতরাং এই আয়াতটি পূর্ববর্তী বক্তব্যকে শক্তিশালী করে এবং একজনের কর্মের পরিণতি সম্পর্কে জ্ঞানের নিশ্চিততার উপর জোর দেয়। এটি বলে যে, ব্যক্তিরা নিঃসন্দেহে তাদের আবেশী সাধনার অসারতা উপলব্ধি করবে এবং পরকালের বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার গুরুত্বকে স্বীকৃতি দেবে।

 

 

আয়াত ৫

کَلَّا لَوۡ تَعۡلَمُوۡنَ عِلۡمَ الۡیَقِیۡنِ ؕ﴿۵﴾

কক্ষনো না, তোমরা যদি নিশ্চিত জ্ঞানের ভিত্তিতে জানতে! (তাহলে সাবধান হয়ে যেতে)।

যদি আমরা সত্যিই জানতাম এই পার্থিব জীবনের প্রকৃত রূপ, তাহলে আমরা যেভাবে জীবন যাপন করছি, সেভাবে জীবন যাপন করতাম না, আমাদের জীবন সম্পূর্ণ বদলে যেত। কিন্তু আমাদের যদি এই নিশ্চিত জ্ঞান থাকত, তাহলে এই জীবন পরীক্ষার বিষয় হত না, তাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ইচ্ছা করেই আমাদেরকে সেই জ্ঞান দান করেন নি।

এই আয়াতে মুমিনদের জ্ঞান ও উপলব্ধি অর্জনের আহবান জানানো হয়েছে। এটা ইঙ্গিত করে যে, মানুষের যদি প্রকৃত জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি থাকত, তাহলে তারা অনন্ত জীবন ও পরকালের পুরস্কারের তুলনায় পার্থিব সম্পদের তুচ্ছতা উপলব্ধি করতে পারত। মানুষ এটা উপলব্ধি করতে পারলে সে প্রকৃত গুরত্বপূর্ণ বিষয়ে অগ্রাধিকার দেবে।

 

আয়াত ৬

لَتَرَوُنَّ الۡجَحِیۡمَ ۙ﴿۶﴾

তোমরা তো জাহান্নাম দেখবেই।

এই আয়াতে ধর্মীয় ও আমলি উন্নতির সাধনাকে অবহেলা করার এবং শুধুমাত্র জাগতিক লাভের উপর মনোযোগ দেওয়ার পরিণতি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। এটি মানুষকে জাহান্নামের অস্তিত্ব সম্পর্কে সতর্ক করে। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির ওপরে অন্য কিছুকে প্রাধান্য দেয় তাদেরকেও এই আয়াতে সতর্ক করা হচ্ছে।

 

আয়াত ৭

ثُمَّ لَتَرَوُنَّهَا عَیۡنَ الۡیَقِیۡنِ ۙ﴿۷﴾

আবার বলি, তোমরাতো ওটা দেখবেই চাক্ষুষ প্রত্যয়ে।

এই আয়াতে বলা হয়েছে যে মুমিন ও পাপীরা উভয়ই তাদের কর্মের পরিণতি দেখতে পাবে। আর সেটা দেখতে পাবে চাক্ষুষ। জাহান্নামের বাস্তবতা তাদের চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। দুনিয়াতে তারা যেসব বদ কর্ম করেছিল সেগুলোর প্রতিদান তাদেরকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেওয়া হবে।

 

আয়াত ৮

ثُمَّ لَتُسۡـَٔلُنَّ یَوۡمَئِذٍ عَنِ النَّعِیۡمِ ﴿۸﴾

তারপর তোমাদেরকে অবশ্য অবশ্যই (যা কিছু দেয়া হয়েছে এমন সব) নিয়ামাত সম্পর্কে সেদিন জিজ্ঞেস করা হবে।

কিয়ামতে এই জিজ্ঞাসা ঐ সকল নিয়ামত (সুখ-সম্পদ) সম্পর্কে হবে, যা দুনিয়াতে আল্লাহ তাআলা মানুষকে দান করে থাকেন। যেমন, চোখ, কান, হৃদয়, মস্তিষ্ক, শান্তি, সুস্থতা, মাল-ধন ও সন্তান-সন্ততি ইত্যাদি। কোন কোন উলামাগণ বলেন, এই জিজ্ঞাসা কেবলমাত্র কাফেরদেরকেই করা হবে। আবার কেউ কেউ বলেন, প্রত্যেক ব্যক্তিকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হবে। কেননা, শুধুমাত্র জিজ্ঞাসা করা আজাবের জন্য জরুরী নয়। বরং যারা এ সব নিয়ামতকে আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী ব্যবহার করবে, তাকে প্রশ্ন করা সত্ত্বেও আজাব থেকে নিরাপদে রাখা হবে। আর যারা আল্লাহর নিয়ামতকে অস্বীকার করবে, তারা আজাবে পতিত হবে।

 

Leave a Comment