পানি ভবনে এসি বিলাস

সরকারের প্রশাসনিক সদর দপ্তর বাংলাদেশ সচিবালয়ে ৩৬টি মন্ত্রণালয়ের জন্য রয়েছে সব মিলিয়ে চার হাজার টন ক্ষমতার শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি)। সরকারিভাবে দেশের সবচেয়ে বড় কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ১ হাজার ২০০ টন ক্ষমতার এসির ব্যবস্থা থাকলেও ব্যবহার হয় ৮০০ টন। আরেক বড় স্থাপনা রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ব্যবহার হয় ২৫০ টন ক্ষমতার এসি। এছাড়া সরকার নিয়ন্ত্রিত দেশের পাঁচতারকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে রয়েছে ৯২০ টন ক্ষমতার কেন্দ্রীয় শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। তবে আগের সব রেকর্ড ভেঙে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সদর দপ্তর ‘পানি ভবন’-এ বসানো হয়েছে ২ হাজার ৪০০ টন ক্ষমতার শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র। আর এর মাধ্যমে দেশের প্রথম ‘সেন্ট্রাল এসি’ সরকারি অফিস হিসেবে নাম লিখিয়েছে রাজধানীর পান্থপথে অবস্থিত পাউবোর এ ভবনটি। যদিও বিশাল আকারের এই ভবনে এমন শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে বিলাসী চিন্তাভাবনার ফসল বলে মনে করছেন খোদ পাউবো কর্মকর্তাদেরই কেউ কেউ।

প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার বর্গফুট আয়তনের ১২ তলার পানি ভবনের জন্য প্রতি মাসে বিদ্যুৎ বিল গুনতে হচ্ছে ২৫ থেকে ২৭ লাখ টাকা। সেই হিসাবে বছরে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ৩ কোটি টাকার মতো। বিপুল টাকার বিদ্যুৎ বিল খরচ করে কেন্দ্রীয় শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার এমন আয়োজন সরকারের কোনো মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা সংস্থায় আর নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে পানি ভবনে কেন্দ্রীয় শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার আয়োজনে ক্ষোভ প্রকাশ করে পাউবোরই একজন উচ্চপর্যায়ের প্রকৌশলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার তাগিদ দিচ্ছে। এর আগে সচিবালয়ে বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার। তিনি বলেছিলেন, সরকারি অফিস-আদালত নির্মাণের ক্ষেত্রে আবদ্ধ ভবন নির্মাণ না করে প্রাকৃতিক আলো-বাতাস প্রবেশ করে এমন পরিকল্পনা করতে। কিন্তু আমাদের পাউবোর নির্মিত এ ভবনটি এর সম্পূর্ণ উল্টো। ২৬০ কোটি টাকার এই ভবনে যে কয়জনই অফিস করুক না কেন, এসি চলবে পুরো ১২ তলায়। যদিও আমরা প্রধান দপ্তরে বসে শুধু পরিকল্পনা ও মনিটরিং করে থাকি। আমাদের পুরো কাজ চলে মাঠপর্যায়ে। এই বিশাল আকারের ভবনে এমন এসি ব্যবস্থাকে আমার কাছে বিলাসী চিন্তাভাবনার ফসল বলে মনে হয়।’

পাউবো থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর পান্থপথে ‘আধুনিক পানি ভবন’ ২০২০ সালের ১ অক্টোবর উদ্বোধন করা হয়। ২৬০ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ের এ ভবনটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৫ সালের ৩১ জানুয়ারি। ১২ তলার পানি ভবনের মোট আয়তন ৪ লাখ ২০ হাজার বর্গফুট। এ বিশাল আয়তনের ভবনে কেন্দ্রীয় শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার জন্য ২ হাজার ৪০০ টন ক্ষমতার এসি বসানো হয়েছে। ভবনে ৫৩৬ জন ধারণক্ষমতার অডিটরিয়াম, ৪ হাজার ৫০০ বর্গফুটের হেলিপ্যাড ও ৩৭৬টি গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাউবোর একাধিক প্রকৌশলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, পানি ভবনে মন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও সচিবের জন্য বিশাল আকারের আলাদা আলাদা কক্ষ রাখা হয়েছে। এছাড়া তাদের পিএস, এপিএস ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তার জন্যও আলাদা কক্ষ রয়েছে। সরকারি কোনো মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা সংস্থায় এমন আয়োজন আর নেই। এটি মূলত সবাইকে খুশি করতেই করা হয়েছে। মন্ত্রী-সচিব সচিবালয়ে বসে অফিস করবেন না পানি ভবনে এসে বসবেন এমন প্রশ্নও রাখেন এক প্রকৌশলী।

জানা গেছে, পানি ভবনের দৈর্ঘ্য ২৭৬ ফুট ও প্রস্থ ১২৭ ফুট। অডিটরিয়াম দৈর্ঘ্যে ১০০ ফুট ও প্রস্থ ৫১ ফুট। এর মোট আয়তন ৫ হাজার ১০০ বর্গফুট। অডিটরিয়ামের উচ্চতা ২১ ফুট এবং ধারণক্ষমতা ৫৩৬ জন। ভবনের বেজমেন্ট এবং সেমি-বেজমেন্টে গাড়ি পার্কিং ক্ষমতা ১৭৬টি। ভবনের বাইরে খোলা জায়গায় গাড়ি পার্কিং ক্ষমতা ২০০টি। ভবনে কমন টয়লেটের সংখ্যা ৪৮টি। এছাড়া কক্ষের সঙ্গে সংযুক্ত টয়লেট সংখ্যা ৭০টি। ভবনটিতে রয়েছে আটটি লিফট।

বাংলাদেশ সার্ভিসেস লিমিটেডের (বিসিআই) সচিব (যুগ্ম সচিব) মো. নাজমুস সাদাত সেলিম গতকাল বুধবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সব মিলিয়ে ৯২০ টন ক্ষমতার এসির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় শীতাতপ ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর মধ্যে সার্বক্ষণিক রান্নার চুলা চালু থাকার কারণে এসির ব্যবহার বেশি হচ্ছে।’

গণপূর্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ঢাকা জোন) মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, গণপূর্ত অধিদপ্তর যেসব সরকারি ভবন বা স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে থাকে তার মধ্যে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ৮০০ টন ক্ষমতার এসি ব্যবহার হয়। আর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ২৫০ টন ক্ষমতার বেশি এসি ব্যবহার হয় না।

অন্যদিকে সচিবালয়ে দায়িত্বে থাকা গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী (ইএম) মো. মহিবুল ইসলাম জানান, সচিবালয়ে নয়টি ভবনে প্রায় ৩৬টি মন্ত্রণালয়ের জন্য সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ চার হাজার টন ক্ষমতার এসি ব্যবহার করা হচ্ছে।

পানি ভবনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে পাউবোর প্রধান প্রকৌশলী (ঢাকা জোন) এবং পানি ভবন নির্মাণকাজের তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) আবদুল মতিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ একসঙ্গে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী বসতে পারবেন এমন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এখানে কেন্দ্রীয় শীতাতপ ব্যবস্থায় ২ হাজার ৪০০ টন এসি বসানো হয়েছে। প্রতি মাসে বিদ্যুৎ বিল ১৯-২০ লাখ আসে। লকডাউনে একটু কম আসে। ধরাণা করছি বছরে ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা বিল আসবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘পানি ভবনে অব্যবহৃত জায়গা খুব একটা নেই। এখানে মন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও সচিবের জন্য পৃথক রুম রাখা হয়েছে। তাদের পিএস, এপিএস রুম পেয়েছেন। সব মিলিয়ে আমরা এক ভবনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান দপ্তরে সবাই বসতে পারব।’

তবে পাউবোর একাধিক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পাউবোর কাজ মূলত মাঠপর্যায়েই বেশি। প্রধান দপ্তর পরিকল্পনা ও মনিটরিং করার কাজটি করে থাকে। দেশের পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও টেকসই উন্নয়ন সাধন, বন্যা, খরা, জলাবদ্ধতা, নদীর প্রবাহ, লবণাক্ততা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা ও প্রাকৃতিক পরিবেশের যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি, মৎস্য, বন ক্ষেত্রেও পাউবো কাজ করে। ফলে প্রধান দপ্তরে এত বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ বিল আসবে এমন শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ার প্রয়োজন ছিল না। সরকারি আর কোনো ভবনে এত বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচের আয়োজন করা হয়নি।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে পাউবোর মহাপরিচালক ফজলুর রশীদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে কল করার কারণ জানিয়ে খুদেবার্তা পাঠানো হলেও সাড়া দেননি।

পানি ভবনে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচের বিষয়ে জানতে চাইলে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সেন্ট্রাল এসি থাকলে তো লোকজন কম থাকুক, বেশি থাকুক তা চলবেই। যেমন আমার পানি ভবনে রুম রয়েছে। আমি তো খুব একটা যাই না। যাই না বলতে বোঝাতে চেয়েছি যেতে পারি না; সময় হয় না। আমি বেশিরভাগ সময় মাঠের কাজ নিয়ে থাকি। আসলে এ ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগে। যদিও ফিনিশিংটা আমাদের সময়। এ বিষয়ে বিস্তারিত না জেনে কিছু বলতে পারছি না।’

Leave a Comment