না পাওয়া ভালবাসা

অপরাহ্ণের পর থেকেই নুজাইরার মনটা বিষাদে ছেঁয়ে আছে। ভালো লাগছে না কিছুই। মেকি হাসির খোলস এঁটে সবার সামনে হাসিমুখের অভিনয় করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছে সে।

নিজের ঘরে এসে দরজা লক করে সেখানেই ঠেস দিয়ে বসে রইল খানিকক্ষণ। ভাঁজ করা হাটুদ্বয় দু’হাতে জড়িয়ে তাতে আস্তে আস্তে কপাল ঠেকাল। অতীত স্মৃতিগুলো মানসপটে ভাসছে। এই প্রথম নিজেকে প্রতারক মনে হচ্ছে। নয়নপুকুর অশ্রুজলে টইটুম্বুর। অবিরাম ঝরা কষ্টের বারীশে নয়নোপান্ত উপছে পড়ছে। নিরব কান্নায় কষ্টগুলো বুকে জটলা বেঁধে আছে। হাউমাউ কান্নায় সেগুলো খুশিতে বের হয়ে গিয়েছে।

বেশ কিছুক্ষণ শব্দ ছাপিয়ে হাউমাউ কান্নার পর তার টনক নড়লো। এভাবে দরজা আটকিয়ে বসে থাকলেও এখন, যে কেউ যে কোনো মুহূর্তে তার দরজায় নক করতে পারে। তখন সে কতটা অপ্রস্তুত হয়ে যাবে! তার কাছে কান্নার হেতু জানতে চাইলে সে কী উত্তর দিবে!

এসব ভেবেই সে চোখ মুখ মুছে ওয়াসরুমে গেল। চোখেমুখে ঠান্ডা পানির ঝাপটা দিয়ে এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে তার। অযু করে এশার সালাত আদায় করে নিল। এরপর দোর খুলে রান্নাঘরে গিয়ে এক কাপ কড়া লিকারের মশলা চা নিয়ে তার নন্দকাননে চলে এলো।

শোবার ঘরের সাথে লাগোয়া পরিপাটি ছোট্ট একটি বারান্দা। নুজাইরা তার নাম দিয়েছে “নন্দকানন”। এখানে এলে তার সকল মন খারাপ গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে ঐ দূর আকাশে মিলিয়ে যায়। সে একদম নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছে তার এই ছোট্ট অলিন্দ।

দাওয়ার দক্ষিণে দেয়ালের সাথে ঠেস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি বইয়ের তাক। তাতে নুজাইরার সংগ্রহের প্রায় হাজার খানিক বই আছে। মন খারাপ থাকলে সাধারণত সে কবিতার বই পড়ে। আজও সে হায়াৎ মাহমুদের একটি বই নিল।

বইয়ের তাক বরাবর একদম উত্তর দিকে রয়েছে সিলিং থেকে ঝোলানো সুন্দর একটি দোলনা। তার একপাশে ফোল্ডিং করে রাখা ছোট্ট একটি টি টেবিল। সে দোলনায় বসে পাশের রাখা টি টেবিলটা সামনে নিয়ে এলো। পুরোটা মেলে রেখে তার উপর জানু ভাঁজ করে দুই পা রাখলো। কোলে কবিতার বই আর হাতে ধোঁয়া ওঠা সাদা চায়ের কাপ। সেই ধোঁয়ার সাথে মশলার সুমিষ্ট ঘ্রাণ নাকে ভেসে এসে তৃপ্ততা জানান দিচ্ছে।

দোলনার অন্য পাশে দেয়ালের সাথে শক্তভাবে আটকানো একটি শুকনো কাঠের গুঁড়ি । সেই গুঁড়িটির কয়েক জায়গায় গর্ত করে তাতে পোড়া মাটির নান্দনিক বাটি তার দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। সেগুলোতে মাটি পুরে লাগানো হয়েছে হরেক রকম ফুলের গাছ। নুজাইরা চায়ে চুমুক দিয়ে, একটু বাঁকা হয়ে সেই গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়েও ফেললো না।

দোলনাটা আবার ঘুরিয়ে নিয়ে সে আকাশ দেখতে মন দিল। আয়তকারের গ্রিলগুলো দিয়ে আকাশ দেখলে মনে হয়, আকাশও যেন আয়তকারে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। শুধুমাত্র আকাশ দেখার জন্যই দোলনার বাঁ দিকের গ্রিলগুলোতে কোনো গাছের টব লাগানো হয়নি। অনেকখানি জায়গা ফাঁকা রেখে বাকী অংশে বিভিন্ন চারাগাছের টব লাগানো হয়েছে।

এই নন্দকানন তার দখলে থাকবে আর মাত্র কয়েকটি দিন। তারপর তাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে। যদিও সে তার এই স্বপ্নের উদ্যান ছেড়ে যেতে চায় না, তবুও যেতে হবে। এটাই জাগতিক নিয়ম; যা কোনোভাবেই সে ভাঙ্গতে পারবে না। তার উপর সে একজনকে ঠকাচ্ছে। এটা ভাবতেই তার মন আরো বেশি খারাপ হয়ে গেল। সে আর কবিতার বই খুলে দেখলো না। টি টেবিলের উপর বইটি রেখে অর্ধেক চা সমেত কাপটি নিয়ে নন্দকানন থেকে চলে গেল।

১.

নুজাইরার বিয়ের কথা চলছিল বেশ কয়েক মাস থেকে। আজ একদম দিন, তারিখ সব সবকিছু পাকাপাকি হয়ে গেল।

আজ ১২ এপ্রিল, সোমবার। তার বিয়ের দিন ধার্য করা হয়েছে ১৬ এপ্রিল, শুক্রবার। আবার এই মাসেই আয়ানের দেশে আসার কথা। কবে আসবে সেটা সে বলেনি নুজাইরাকে সারপ্রাইজ দিবে বলে। কিন্তু গত তিনদিন থেকে তার ফোন বন্ধ। বিয়ের কথা পাকা হওয়ার দুই মিনিট আগেও নুজাইরা তাকে ফোন করে গেছে। কিন্তু তার কোনো খবর নেই।

আয়ান নুজাইরাকে খুব পছন্দ করতো। ফেইসবুকে পোস্টকৃত একটি গল্পের মাধ্যমেই তাদের পরিচয়। প্রথম প্রথম খুব সাধারণ কথা হতো। একটা সময় সাধারণ কথার চেয়েও অন্য সব বিষয় নিয়ে তাদের কথা হতে থাকে।

দু’জনেই ছিল আল্লাহর হিদায়াহ্ প্রাপ্ত। তাই শুধু এই কথা বলা নিয়েই নিজেদের মধ্যে অনুশোচনাবোধ কাজ করতো। কারণ তারা বাইরের সমাজে মাহরাম মেনে চলতে পারলেও এখন কী নিজেদের ধোঁকা দিচ্ছে না?

বিভিন্ন প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো। এত প্রশ্নের ভিড়ে তারা নিজেদের ভিতরে সূকুন খুঁজে পাচ্ছিলো না। অন্যান্য ইবাদতেও তাদের মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হতো। কিন্তু ভুল বোঝার ভয়ে কেউ কাউকে সেই বিষয়ে বলতে পারছিল না।

আয়ান খুবই আন্তরিক ছিল। নুজাইরার উদাসীনতার বিষয়টা সে খানিকটা আঁচ করতে পেরেছিল। কথাপ্রসঙ্গে একদিন আয়ান জিজ্ঞেসই করে ফেললো তার উদাসীনতা সম্পর্কে।

নুজাইরাও অবলীলায় সব বলে দিল। আয়ান জানালো তারও এমনটা হচ্ছে।
আয়ান বললো, “আল্লাহ্ সব শোনেন, আল্লাহ্ সব দেখেন এবং আল্লাহ সবই জানেন। অথচ আমরা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে ফেলছি। তিনি যে সীমারেখা টেনে দিয়েছেন একজন ছেলে এবং মেয়ের মধ্যে, আমরা সেই সীমারেখা লঙ্ঘন করছি। অথচ আল্লাহ সীমারেখা লঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করেন না।”

“তবে আপনি কী করতে চান?” নুজাইরা বললো।

“আমি আপনার বোধোদয় করে দেয়ার চেষ্টা করলাম। এরপর আপনিই বলুন আমাদের কী করা উচিত?” আয়ান প্রশ্ন রাখলো।

নুজাইরা খানিক সময় নিয়ে রিপ্লাই করলো, “আজকের পর থেকে আমি আর আপনার সাথে কোনো যোগাযোগ রাখবো না। আপনিও রাখবেন না।”

আয়ান আহত মনে বললো, “আমি আপনাকে ভালবাসি এবং বিয়ে করতে চাই। আপনি কী আমার জন্য মাত্র ২টা বছর অপেক্ষা করবেন?”

“আমি চেষ্টা করব, ইন শা আল্লাহ্। বাসায় বিয়ের কথা চলতে থাকলে আমি আপনাকে ইনফর্ম করবো। তারপর যা করার আপনি করিয়েন। আমার আর কিছু বলার নেই। আমি আগে আল্লাহকে ভালবাসি। সবকিছু তাঁর জন্য উৎসর্গ করতেও আমি রাজি।” নুজাইরা জবাব দিল।

সেইদিন থেকে তাদের যোগাযোগ বন্ধ। উভয়ের কাছেই যোগাযোগ করার হাজারটা পন্থা থাকলেও কেউ আর কাউকে নক করেনি।

এরপর ১.৫বছরের মাথায় আয়ানই ফোন করে জানায় সে এপ্রিলে আসছে। নুজাইরা খুশি হয়েছিল। কিন্তু পরিবারের কর্তা বাবাকে সে ভীষণ ভয় পেত। তাই আয়ানের বিষয়টা সে কোনোমতেই তার বাবাকে জানাতে পারেনি।

[৩]

এদিকে তার বিয়ের সব তোরজোড় চলছিল। সে না পারছে কাউকে কিছু বলতে আর না পারছে আয়ানকে জানাতে।

শেষমেশ চলে এলো ১৬ এপ্রিল, শুক্রবার। কবুল বলার এক ঘন্টা আগেও সে লুকিয়ে আয়ানকে কল এবং টেক্সট করেছিল। কিন্তু হতাশ হয়েছে।

বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর সে তার নতুন বাড়ির উদ্দেশ্যে চলতে লাগলো।

এক সপ্তাহ পর:

রহমান সাহেবের বাসার ড্রয়িংরুম। রহমান সাহেব এবং তার মিসেস এর বিপরীতে তিনটি মুখ। পাঁচজনই চুপচাপ।

নিরবতা ভেঙ্গে আয়ান উঠে দাঁড়ালো। রহমান সাহেবের সামনে মুসাহাফা ভঙ্গিতে হাত এগিয়ে দিয়ে একটু মুচকি হাসলো। বললো, “আংকেল আমরা আসি তাহলে? নুজাইরা আমার তাকদিরে ছিল না। আল্লাহর ফয়সালাই উত্তম। আপনি আমার জন্য শুধু দু’আ করবেন।”

রহমান সাহেব আয়ানকে জড়িয়ে ধরে বাম হাতে চোখ মুছলেন। আয়ানের ভিতর ফেটে কান্না আসছিল। কিন্তু সে তার চোখের জল কাউকে দেখাতে চায় না। তাই আর কোনো কথা না বাড়িয়ে সে দ্রুত ঐ বাসা থেকে বেরিয়ে এলো। আর রেখে এলো না পাওয়া ভালবাসা।

“না পাওয়া ভালবাসা”

লেখা: মেহেজাবীন শারমিন প্রিয়া।

Leave a Comment