নারী : সমাজের মৌলিক কাঠামো

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اتَّقُوۡا رَبَّکُمُ الَّذِیۡ خَلَقَکُمۡ مِّنۡ نَّفۡسٍ وَّاحِدَۃٍ وَّ خَلَقَ مِنۡهَا زَوۡجَهَا وَ بَثَّ مِنۡهُمَا رِجَالًا کَثِیۡرًا وَّ نِسَآءً ۚ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ الَّذِیۡ تَسَآءَلُوۡنَ بِهٖ وَ الۡاَرۡحَامَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ کَانَ عَلَیۡکُمۡ رَقِیۡبًا
হে মানুষ, তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, যিনি এক ব্যক্তি থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর থেকে তাঁর জোড়া সৃষ্টি করেছেন। তারপর সেই দুজন থেকে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যাঁর নামে তোমরা পরস্পর পরস্পরের কাছে চেয়ে থাকো এবং সতর্ক থাকো জ্ঞাতি-বন্ধন সম্পর্কে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন। [সুরা নিসা : ১]

নারী-পুরুষ উভয় এসেছে একই স্থান থেকে, তাই মানবতার দিক থেকে তারা সমকক্ষ। স্রষ্টার প্রশংসাজ্ঞাপন ও উপাসনার ক্ষেত্রে লিঙ্গভেদে কোনো পার্থক্য করেনি ইসলাম। ফলে নারীদের নৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। ইসলামে নারীর মর্যাদা সমতা ও সম্মানের। কুরআন স্বামী-স্ত্রীকে পরস্পরের পোশাক বলে ঘোষণা করেছে,

﴿هُنَّ لِبَاسٌ لَّکُمۡ وَ اَنۡتُمۡ لِبَاسٌ لَّهُنَّ﴾
তারা তোমাদের জন্য পোশাক এবং তোমরা তাদের জন্য পোশাক। [সুরা বাকারা : ১৮৭]

ইসলাম স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য সম্পর্ককে পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে দেখে। স্বামী পূর্ণতা দেন স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে। ইসলামের সমাজব্যবস্থা মানবপ্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং স্রষ্টার হুকুমের ভিত্তিতে গঠিত। আল্লাহর নির্ধারিত প্রকৃতি ও নিয়মনীতির বাইরে গিয়ে আমরা দুনিয়ায় টিকে থাকতে পারব না। অবশ্যই স্রষ্টানির্ধারিত নীতি মেনে জীবনযাপন করতে হবে। পশ্চিমা দেশের সমাজবিজ্ঞানী আর সমালোচকেরাও একই উপসংহারে পৌঁছেছেন।
ইসলাম নারীদের অবমাননা বা অবমূল্যায়ন করে, এমন বার্তা পশ্চিমা মিডিয়া মানুষের মনে ঢুকিয়ে দেয়; অথচ ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার বাস্তবায়ন সমাজে নারীদের সম্মান, সম্ভ্রম ও অধিকার রক্ষা করে। এর প্রমাণ হচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোতে ইসলামে প্রত্যাবর্তিতদের মধ্যে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি। ইউরোপ-আমেরিকায় ‘স্বাধীন’ পরিবেশে বেড়ে ওঠা বিশালসংখ্যক নারী কেন তাদের ‘স্বাধীনতা’ প্রত্যাখ্যান করে এমন এক ধর্মে প্রবেশ করছেন, যা তাদের ওপর জুলুম করে, দাসে পরিণত করে? কীভাবে ইসলাম নারীদের ওপর জুলুমবাজ হয়েও তাদের আকৃষ্ট করছে নিজের দিকে? ইসলাম যদি নারীদের সম্মান হানিই করত, তবে কেন অসংখ্য নারী নিজেদের জীবনব্যবস্থা হিসেবে একে মেনে নিচ্ছে? কারণ, পশ্চিমা নারীরা ইসলামের মধ্যেই প্রকৃত স্বাধীনতার দেখা পেয়েছেন। নিশ্চয় তাঁরা এমন ধর্ম গ্রহণ করবেন না, যা তাদেরই অবমূল্যায়ন করে।

লন্ডনের Times পত্রিকার লেখক লুসি বেরিংটন এই প্যারাডক্সটি ধরতে পেরেছিলেন। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ৯ নভেম্বর প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধ The Spread of a World Creed-এ তিনি লেখেন,
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে, ব্রিটিশ নওমুসলিমদের অধিকাংশই নারী; অথচ পশ্চিমাবিশ্বে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে—ইসলাম নারীদের নীচু চোখে দেখে। যুক্তরাষ্ট্রে পুরুষের তুলনায় নারীদের ইসলামগ্রহণের পরিমাণ চার গুণ। ব্রিটেনেও প্রায় ১০ থেকে ২০ হাজার ইসলামগ্রহণকারীর মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি।
জার্মানিতে সরকারি হিসাবমতে ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে 4 হাজার মানুষ ইসলামগ্রহণ করেছেন। ৯০-এর দশকে প্রতিবছর গড়ে ৩০০ জন ইসলাম গ্রহণ করতেন। ধারণা করা হয়, ইউরোপে প্রতিবছর ৫০ হাজার মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠই নারী। এই নারীরা নিশ্চয় ইসলামে স্বাধীনতার কোনো নিদর্শন দেখতে পেয়েই এসেছেন। কারণ, তাঁরা এমন ধর্ম গ্রহণ করবেন না, যা তাঁদের অবমূল্যায়ন করে।

যে সময়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ওহির ভিত্তিতে পুরুষের নির্দেশ দিচ্ছিলেন নারীদের প্রতি কোমল হতে, তখন ইউরোপের ধর্মতাত্ত্বিকরা আলোচনা করত—নারীদের কি কেবল দৈহিক সত্তা আছে, না তাদের পুরুষের মতো আত্মাও আছে? এটা সেই সময়, যখন অ্যারিস্টটলের দাবিকে পশ্চিমাবিশ্ব নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছিল। তিনি মনে করতেন, নারীরা পুরুষের তুলনায় জৈবিকভাবে নীচু প্রকৃতির। কারণ, তার ধারণা ছিল নারীর দাঁতের সংখ্যা পুরুষের চেয়ে কম!
ইসলামে নারীরা সমাজের অপরিহার্য উপাদান। তাদের ছাড়া একটি সুস্থ সমাজ কল্পনাও করা যায় না। ইসলাম নারীদের এতটাই মর্যাটা দিয়েছে যে, পবিত্র কুরআনে তিনটি সুরা বিশেষভাবে তাদের দিকেই সম্পর্কিত করা হয়েছে—সুরা নিসা, সুরা মারইয়াম ও সুরা মুজাদালা।
ইসলাম নারীদের চুক্তি, উপার্জন ও সম্পদ স্বাধীনভাবে ভক্ষণের সমানাধিকার দিয়েছে। তার জীবন, সম্পদ, সম্মান পুরুষের মতোই পবিত্র। সে অপরাধ করলে তার সাজাও পুরুষের চেয়ে কমবেশ হবে না। তার ক্ষতি বা জুলুম করা হলে এর ক্ষতিপূরণ তার সামাজিক অবস্থান বা মর্যাদার সমতুল্য পুরুষের মতোই হবে।

পুরুষের জন্য আধ্যাত্মিকতা অর্জনে নারীদের উপস্থিতিকে ইসলাম কখনো বাধা হিসেবে দেখেনি। রাসুল সাঃ তাঁর ক্ষুদ্র ঘরে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করতেন। তিনি সিজদা করতে নিচু হলে স্ত্রী আয়েশার পা আস্তে করে সরিয়ে দিতেন সিজদার জায়গা করার জন্য। যে বৈরাগী সন্ন্যাসী একাকী মন্দিরে বসে উপাসনা করে, তার সঙ্গে এই দৃশ্যপট কোনোভাবেই মেলে না।

প্রথম যিনি ইসলামে প্রবেশ করেন এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম-এর নবুওয়াতে বিশ্বাস স্থাপন করেন, তিনিও একজন নারী—নবিজির স্ত্রী খাদিজা বিনতু খুওয়াইলিদ রা.। আল্লাহর রাস্তায় প্রথম শহিদ যিনি, তিনিও একজন নারী–সুমাইয়া বিনতু খাইয়াত রা.। তিনি প্রখ্যাত সাহাবি আম্মার ইবনু ইয়াসির রা.-এর মা।
নবিজির স্ত্রী আয়েশা রা. অত্যন্ত মেধাবী এক আলিমা ছিলেন। বিখ্যাত অনেক সাহাবি তাঁর কাছে ইলম অর্জন করেছেন, তিনিও পর্দার আড়াল থেকে তাঁদের শিক্ষা দিতেন। যে ছয়জন সাহাবি সর্বাধিক হাদিস বর্ণনা করেছেন, আয়েশা তাঁদের একজন।
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব রা.। তাঁর ইসলামে প্রবেশ মক্কার নির্যাতিত মুসলিমদের অন্তরে উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। তাঁদের মনোবল বেড়ে যায়। তিনিও ইসলামে প্রবেশ করেন তাঁর বোন ফাতিমা বিনতু খাত্তাব রা.-এর মাধ্যমে। রাসুল সাঃ-এর ইনতিকালের পর প্রথম সংকলিত কুরআনের কপিটি সংরক্ষণের দায়িত্ব কোনো পুরুষকে নয়; দেওয়া হয়েছিল একজন নারীকে—হাফসা রা.। তিনি উমর ইবনুল খাত্তাবের মেয়ে এবং নবিজির স্ত্রী ছিলেন।
কুরআনে পবিত্র নারীদের ‘হাফিজাতুল গায়িব’ (যারা লোকচক্ষুর অন্তরালে হিফাজতকারিণী) বলা হয়েছে।
ইসলাম সর্বদা নারীর নারীত্বকে বিবেচনায় নিয়েছে, এর প্রশংসা করেছে। পুরুষের পরিপূরক ভূমিকা হিসেবে নারীত্বকে উপস্থাপন করেছে। নারী পুরুষের চেয়ে ভিন্ন; কুরআন সে ভিন্নতা উল্লেখও করেছে,

﴿وَ لَیۡسَ الذَّکَرُ کَالۡاُنۡثٰی﴾
আর পুত্রসন্তান কন্যাসন্তানের মতো নয়। [সুরা আলে ইমরান : ৩৬]

পার্থ্যকের অর্থ এটা নয় যে, তারা একে অপরের প্রতিপক্ষ। বরং নারী-পুরুষের পার্থক্য যখন একত্রিত হয়, তখন মানুষ পূর্ণতা পায়। আল্লাহ বলেন,

﴿مِّنۡ ذَکَرٍ اَوۡ اُنۡثٰی ۚ بَعۡضُکُمۡ مِّنۡۢ بَعۡضٍ﴾
তোমাদের মধ্যে পুরুষ হোক কিংবা নারী—কোনো কর্মীরই কর্মফল আমি নষ্ট করি না। তোমরা একে অপরের অংশ। [সুরা আলে ইমরান : ১৯৫]

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন,

﴿وَ اللّٰهُ جَعَلَ لَکُمۡ مِّنۡ اَنۡفُسِکُمۡ اَزۡوَاجًا﴾
আর আল্লাহ তোমাদের জন্য তোমাদের থেকে জোড়া সৃষ্টি করেছেন। [সুরা নাহল : ৭২]

নারীর অধিকার ও দায়িত্ব পুরুষের সমতুল্য, তবে সেগুলো সবসময় যে একই হবে, তা নয়। সমতা আর অভিন্নতা এক নয়। নারী-পুরুষ অভিন্ন নয়, তবে তাদের সমান হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে। সমতা ও অভিন্নতার ভেতরের এ পার্থক্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমতায় ন্যায্যতা আছে—এই পার্থক্যটি মাথায় রাখতে পারলে নারীরা যে পুরুষের চেয়ে কোনো অংশে ছোট, এমনটা ভাবার অবকাশ থাকবে না। নারী-পুরুষ হুবহু এক নয়—এর মানে নারী পুরুষের চেয়ে ছোট, এমন ভাবনাও ভিত্তিহীন। তবে নারী পুরুষের অবিকল প্রতিরূপ নয়; তার আছে নিজস্ব ব্যক্তিত্ব। নিজের কৃতকর্মের জন্য নারী-পুরুষ উভয়ই সমানভাবে বিচারদিবসে দায়বদ্ধ থাকবে।

ইসলাম নারী-পুরুষের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কাজকর্ম নির্ধারণ করে দিয়েছে। উভয় লিঙ্গের ভেতর যেন সুস্থ ও সঠিক পরিবেশ বিরাজ করে, এ জন্য নারীদের যেমন দিকনির্দেশনা দিয়েছে, তেমনই দিয়েছে পুরুষকেও। নারীরা যেন নিজেদের নারীত্ব রক্ষা করতে পারে, জুলুমের শিকার হওয়া থেকে বাঁচতে পারে, এ জন্য ইসলাম নারী ও পুরুষের মধ্যে শক্তিশালী এক বাধা সৃষ্টি করে দিয়েছে, যা সমাজে বসবাসকারী মানুষরূপী হায়েনা ও শিকারীর হাত থেকে তাদের বাঁচায়।
ইসলাম স্বীকার করে, পুরুষের তুলনায় নারীদের অন্তর্জাত শারীরিক দুর্বলতা আছে। ফলে পরিবারের সদস্যদের জন্য উপার্জনের ভার পুরুষের ওপরই ন্যস্ত করা হয়েছে। পুরুষেরা নারীদের স্বাভাবিক চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণ করবেন। তাই রিজিকের তালাশে মুসলিম নারীদের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার কোনো প্রয়োজন নেই। তবে এটা পশ্চিমা নারীদের আক্রান্ত করে ফেলেছে এবং মুসলিমবিশ্বেও এর চর্চা শুরু হয়েছে।

স্রষ্টাপ্রেরিত ধর্ম ইসলাম নারীদের নৈতিকতা ও সম্ভ্রম-রক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে, যেন তাঁরা নিজেদের পবিত্রতা রক্ষা করতে পারেন। কোনো নোংরা হাত যেন তাঁদের ক্ষতি করার চিন্তা করতে না পারে। এ মহৎ লক্ষ্য অর্জনে ইসলাম মুসলিম নারী ও পুরুষকে দৃষ্টি অবনত রাখার নির্দেশ দিয়েছে। মুসলিম নারীর জন্য পরিপূর্ণ হিজাব পরিধানের বিধান দিয়েছে, যেন তাঁরা তাঁদের পবিত্রতা রক্ষা করতে পারেন এবং নারী-পুরুষের উভয়ের চারিত্রিক পবিত্রতাই যেন সংরক্ষিত থাকে।

Leave a Comment